#একটি_বাঙ্গালী_রান্নাঘরের_গল্প

#তৃতীয়_পর্ব

মৎস্য মাংস কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ।।
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছ।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ ।।
ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সুতা
তৈল পাক করি রান্ধে চিংড়ীর মাথা।।
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল ।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ।।
ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল চৈ
ছাল খসাইয়া রান্ধে বাইন মৎস্যের খৈ ।।

বাঙ্গালীর জীবনে পাকশালা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ,তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হল রান্না পদ্ধতি আর সবজি কাটা বা মাছ মাংস কাটা। পূর্বেই বলেছি একটা সময় রান্নাঘরে বঁটিই ছিল কাটাকুটির মূল সরঞ্জাম। তো বাঙ্গালী গৃহের অন্নপূর্ণারা ,শুধু বাঙ্গালী গৃহ কেন….আপামর ভারতবর্ষের গৃহলক্ষ্মীরা রন্ধনকে শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছিলেন। বিশেষ করে কুটনো কাটা প্রায় একটি শিল্পের পর্যায় পৌঁছে ছিল। এক এক পদের জন্য এক এক রকম স্টাইলে সবজি কাটা…কুটনো এবং বঁটির সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে । আগেকার দিনে এসব চপার, অটোমেটিক চপার, চপিং বোর্ড ইত্যাদি আতিশয্য ছিল না। তবে আমাদের মা , মাসি, ঠাকুমা , দিদিমারা কোনো ফাইভ স্টার হোটেলের নাম করা শেফের থেকে কম ছিলেন না। তাছাড়াও রন্ধন শিল্প চচ্চড়ি , ডালনা , ছেঁচকি , ঘন্ট ইত্যাদি বাঙ্গালী রান্নার প্রণালীতে যেমন পার্থক্য আছে তেমন পার্থক্য আছে তরকারি কাটাতে। ছোটবেলায় পুজোআচ্চার দিন বা রবিবার দিন  লুচি হতো বাড়িতে, তার সঙ্গে থাকত সাদা আলুর তরকারী। সেই আলুর চ্চড়ির আলু কাটা হতো অনেকটা ছোট ছোট ঘন চৌক ডুমো করে। মাছের ঝোলের আলু কাটা হতো আবার অর্ধ গোলক লম্বা। ছেঁচকির আবার অন্য ধরন …. ভিন্ন তরকারীতে ভিন্ন সবজি কাটা হবে বা একই সবজি কাটা হবে ভিন্ন আকারে। কুটনো কোটার ছিল নানা ধরণ, না পারলে রাঁধুনির দুর্নাম হতো। 


সে যুগে পাত্রী দেখতে এসে সে গৃহ কর্মে কতটা নিপুণা পরীক্ষার জন্য , কন্যাকে কলাই শাক কাটতে দেওয়া হতো। কলাই শাক বেছে কাটা অতো সহজ কাজ ছিল না। কলাই শাক বলতে মনে পড়ল , ছোট বেলায় দেখেছি কোনো শাকই বেছে কাটা সহজ ছিল না। আমাদের বাড়িতে পালং, লাল, কলমি, কড়াই, লাউ , পুঁই ইত্যাদি শাক আসত। আমাদের বাড়িতে সব সবজি গরম জলে ধোয়া হতো। একটা বড় মাটির হাঁড়িতে জল গরম করে তাতে ধুয়ে তারপর সেগুলোর ঝাড়াই , বাছাই হতো। আমার ন পিসি চশমা পড়ে খুঁটে খুঁটে শাক বাচতেন। তখন আমাদের এলাকা শহুরে হয়ে যায় নি। চাষী বাড়ির লোকজন জলা ,ডোবা বা পুকুর থেকে শাক তুলে এনে হাটে , বাজারে বিক্রি করতেন। তাই সেগুলো ভালো করে ধোয়া এবং বাছা আবশ্যক ছিল। তখন আলুতে বালি, মাটির পরিমাণও অধিক থাকত। 


আমাদের বাড়িতেই অবশ্য রান্নাঘরের পিছনে একটা লাউমাচা , একটা পুঁই মাচা এবং কিছু সীম গাছ ছিল। মা , ঠাকুমা ওগুলোকে এঁটো গাছ বলত। মানে কোনো পাখি, বা রান্নার সময় ফেলে দেওয়া বীজ বা অংশ থেকে গাছ গুলো হয়েছিল। তারমানে সেই গাছে উৎপন্ন ফসল খেত না এমন নয়। ওই পুঁইগাছের মিটুলী কত খেয়েছি ছোট বেলায়। বাবা বাড়ির সামনে ফাঁকা জমিতে একদিকে নানা ফুল গাছ করে ছিলেন আর একদিকে ছিল কিচেন গার্ডেন।  সেখানে শীতে বেশ কিছু সবজি উঠত। একটা বড় শিউলি গাছ ছিল। সেই শিউলি পাতার বড়া বানানো হতো, শুক্তোয় দেওয়া হতো। এছাড়া পাশের বাড়ির ছিল অনেক গুলো সজনে গাছ। তাই, বসন্তকালে প্রচুর সজনে ফুল ও ডাঁটা খাওয়ার সুযোগ থাকত । ডাঁটা পোস্ত বা ডাঁটা দিয়ে মিষ্টি স্বাদের ঝোল….সজনে ফুল ভাজা …আহাঃ অমৃত ছিল। ঠাকুমা খেতে বসে ডাঁটা চিবতে চিবতে বলতেন, ” এই সময় ডাঁটা চেবা পিঙ্কি , এখন ডাঁটা খেলে হাম, বসন্ত হয় না । “


রান্নাঘরের বাসন বলতে ছিল হাঁড়ি, কুঁড়ি, চাটু , কড়া( ছোট, বড়, মেজ, সেজ….) গামলা, হাতা, ঝাঁঝরি, বেড়ি, খুন্তি, চিমটা,চাকি বেলুন, ধুচুনি ইত্যাদি।  মাটির হাঁড়ি, কলসী ইত্যাদিও ছিল। মাটির হাঁড়িতেই ভাত রান্না হতো। প্রতি গ্রহণের পর মাটির হাঁড়িকুড়ি বদলানো হতো। লুচি ইত্যাদি ভাজার জন্য একটা পেল্লায় সাইজের লোহার কড়াই ছিল। সেটা রবিবার বা পুজোপার্বনের দিনে বেরোত। তাকে মাজা হতো তিনজন মিলে। তারপর সেই ঘ্যাচাং ফু তোকে খাব করে তেল ভর্তি কড়াই উনুনে চাপতো। তাছাড়া মাটির কড়াই ছিল আমিষ ও নিরামিষ। সেসব কড়াইতে মাছের ঝোল, মাংসের ঝোল , নিরামিষ ঝোল থেকে শুরু করে বেগুন ভাজা ইত্যাদি সব কাজ হতো। রান্নাঘরে নিরামিষ দিকে একটি জাল দেওয়া আলমারি ছিল। তার উপরের তাকে আমাদের গৃহদেবতা নাড়ুগোপালের দুধ , দই , মিষ্টি এসব রাখা থাকত , আর নীচের তাকে আমাদের খাবার জন্য একটা বড় পিতলের ডেকচিতে দুধ রাখা থাকত।  রান্নার জন্য কাঠের হাতা ,খুন্তি এসব ব্যবহার হতো  । এছাড়াও লোহার খুন্তি, হাতা , ঝাঁঝরি এসব যখন রাবণের গুষ্টি যজ্ঞি বাড়ি হয়ে উঠত তখন ব্যবহারের জন্য বেরোত।  একটা লোহার চিমটা ছিল। রাতে রুটি করার সময় ওটা ব্যবহার হতো। ওটা আমার ঠাকুরদা ঠাকুমাকে এনে দিয়েছিল। কারন ঠাকুমার রুটি করতে গিয়ে উনুনে হাত পুড়ে যেত। পুড়ে গেলে আলুর চোকলা লাগানো ছাড়া বৃহৎ কোনো ঔষধ ছিল না, অন্তত সে সময়। ওষুধ আনার ঝামেলায় বাড়ির লোক খুব কমই যেতেন। কারন আমাদের বাড়ি থেকে মূল জনবহুল এলাকা অনেক দূরে ছিল। তাই জ্বর থেকে কাটা পোড়া সবের চরম রেমেডি ছিল রান্নাঘরে মা , পিসীদের টোটকা। 


সে সময়ে কাঁসা, পিতল আর পাথরের বাসনের চল ছিল। বাড়িতে দই বসত বড় পাথরের বাটিতে। ঠাকুরের রোজকারের ব্যবহারের বাসন সব ছিল সাদা পাথরের। আর ? আর আমের রস জমিয়ে আমস্বত্ত জমানোর জন্য নানা রকমের নকশার পাথরের বাটি। গরম পড়লেই আমাদের গাছের আম দিয়ে আচার আর আমস্বত্ত বানানোর ধুম পড়ত বাড়িতে।  বৈশাখের ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আম….অনেক চীনা মাটির বৈয়ম ছিল ভাঁড়ার ঘরে । সেগুলোতে গরম পড়লেই ভরে উঠত নানা রকমের আচারে। কাঁচা আমের আচার, শুকনো আমের আচার, লঙ্কার আচার, তেঁতুলের আচার,  লেবুর আচার। আমার ঠাকুমা জন্মসূত্রে শিখ পাঞ্জাবি হবার জন্য একটা স্পেশাল আচার জানতেন। বেসনের গোল গোল লাড্ডু করে তার আচার। গরমের দুপুরে অবসর যাপনের এরথেকে বৃহৎ জিনিস ওই সময় কিছু ছিল না। গরমের দুপুরে রান্নাঘরের পিছনের দরজা পুকুরের হাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে আচার বানানো হত। সেগুলো ছাদে আর উঠোনে রোদে দেওয়া হত। কাক তাড়ানোর জন্য একটা কাকতাড়ুয়াও বানানো হয়েছিল গরম কালের জন্য, শীতে বাড়ির কচিরাই কাকতাড়ুয়ার ভূমিকা পালন করতাম। আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময় টিভি ছিল না , দুপুরে বা সন্ধ্যায় অর্ধেক দিন বিদ্যুৎ থাকত না। ছোট পিসি , কাকা এনারা লুকিয়ে সিনেমায় যেতেন। তো অবসর যাপনের জন্য দুপুরে কাজ ব্যতীত অন্যকিছু ছিল না। 


সেসময় দিনগুলো কাজের মাঝে মাঝে কান্না হাঁসির দোলদুলুনিতেই কেটে যেত। সেই ভোর চারটের সময় বাড়ির পাকশালে উনুন জ্বলত। কোনো পিসি বা মা পুকুর থেকে মাটি তুলে এনে বা বাবার ঠাকুর তৈরির বেঁচে যাওয়া মাটি পা দিয়ে চটকে উনুনের গা লেপে দিতেন। শীত ,  গ্রীষ্ম,  বর্ষা ওই রাগ ভৈরবী প্রভাতে বাড়ির সব মেয়েরা পুকুরে স্নান সেরে চলে আসতেন। তারপর গোপালের পুজো দিয়ে ভোর পাঁচটায় রান্না চাপিয়ে দিতেন। ভাত বসে গেলে কুটনো কোটা, বাসন মাজা, ঘর মোছা সব কাজ ভাগ থাকত। যে যার কাজে লেগে যেত। আমাদের বাড়িতে একটা বড় কুয়ো ছিল। সেই জলই খাবার জল এবং রান্না জল হিসাবে ব্যবহার হতো । রান্না ঘরে দুটো বড় মাটির জালায় থাকত দিনভোর রান্নায় ব্যাবহারের জল। তখন তো আর এত ফ্রিজ ছিল না। আমাদের বাড়ি ফ্রিজ , টিভি এসব অনেক পরে ঢুকেছে। তো, সব ঘরে একটা করে কালো রঙের মাটির কুঁজোতে জল থাকত। সেশন জালা আর কুঁজো জলে ফিটকিরি দেওয়া থাকত। কুঁজো মুখে একটা করে পিতলের গ্লাস ঢাকা থাকত। যাঁর যেমন প্রয়োজন হতে জল বেড়ে খেতেন। জালার মুখে একটা বড় ডান্ডাওলা গ্লাস ঝোলানো থাকত। সেটা দিয়ে জল তোলা হত। যা হোক, এখনের ফ্রিজের জলের থেকে সেই জল ছিল ঢের ভালো। প্রাণটা জুড়িয়ে যেত….. সেই জল তোলাও একটা কাজ ছিল। লোহা বালতিতে করে জল তুলে সব জালা , কুঁজো ভরা একটি বৃহৎ কাজ ছিল। 
এরমধ্যে ঠাকুমার একটা ছোট্ট পিতলের হামান দিস্তা ছিল। সেটায় ঠাকুমা বসে বসে পান ছেঁচতেন। তারপর বিকালে ঠাকুমার সইরা এলে তাদের সেই পান দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত বা গীতা পাঠ করতেন। 


সকাল দশটায় বাবা ,কাকা , আমি সবাই ভাত ,আলুভাতে , ঘি আর মাছ ভাজা দিয়ে খেয়ে নিতাম। কাকা আমাকে স্কুলে দিয়ে অফিস চলে যেতেন। কিন্তু পাকশালের কাজ শেষ হতো না। কোনো ছুটির দিনে বাড়ি থাকলে দেখতাম মা, পিসিরা না খেয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সেই যে ভোরে উনুন ধরত তা জ্বলেই যেত। সবাই বেরিয়ে যাবার পরে পিসিরা রান্নাঘর গোবর দিয়ে নিকিয়ে নিয়ে দুপুরের রান্না চাপাতেন। দুপুরে গোপালের ভোগ দেবার পর সবাই মিলে খেয়ে নিয়ে পুকুরে বাসন মাজতে যেতেন।
আমাদের বাড়িতে বড় বড় কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে দেওয়া হতো। পাশে পাথরের বা চীনা মাটির ছোট বাটিতে থাকত চাটনি আর পিতলের গ্লাসে জল। ঠাকুমা সারাজীবন একটি সাদা পাথরের থালা, গ্লাস এবং বাটিতে খাবার খেয়ে এসেছেন। রান্নাঘরের এক কোনে দাঁড় করানো থাকত কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি। সবাইকে সেই পিঁড়ি পেতে ভাত খেতে দেওয়া হতো। টেবিলে চেয়ারে বসে সাহেব হয়ে ভাত খাবার চল আমাদের মধ্যে কোনোদিনই ছিল না। খুব এঁটো , সগরি যেহেতু মানা হতো , আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে সেই জায়গা ভালো করে মুছে নিয়ে, পিঁড়ি ধোয়া হতো। খাবার পরিবেশন করা হতো পিতলের হাতা দিয়ে। মা,পিসিরা একসঙ্গে খেতে বসতেন। কেউ তাঁদের বেড়ে দেওয়ার ছিল না। খেতে খেতে দুপুর তিনটে বাজত। নিজেরাই বাঁ হাতে খাবার তুলে পাতে নিতেন। খাওয়া শেষ হলে বাড়ির কর্তারা আসবেন, তাই তাঁদের চা জলখাবার বানানোর জন্য উনুনের আঁচ আবার জোরে কর হতো। অনেক দিন দেখেছি কাজ বেশি থাকলে নিজেদের বাসন যাতে না মাজতে হয় তারজন্য মা, পিসিরা কলাপাতায় ভাত খেতেন।


 অনেকক্ষন ধরে চা পাতা ভিজিয়ে চায়ের লিকার বের করে নেওয়া হতো। বিকালে চীনামাটির সুদৃশ্য পটে সেই লিকার চা, দুধ, চিনি আলাদা পটে নিয়ে বাবা ,কাকা এবং যদি কোনো অতিথি আসতেন তাঁদের সামনে হাজির করা হতো। সঙ্গে বেগুনি, আলুরচপ ইত্যাদি টাও উপস্থিত করতে হতো। এসবের মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসত। তুলসী তলায় মা , ঠাকুমা প্রদীপ দেখিয়ে, ঠাকুর ঘরে ধূপ জ্বালিয়ে শঙ্খে ফুৎকার দিতেন। গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে সংসারের মঙ্গলকামনা করতেন। তারপর আবার রান্নাঘর। পাকশালের গরমে বসে আবার রুটির জন্য আটা মাখা শুরু হতো। একটা বড় গামলায় আটা মাখা হতো। মাখতে মাখতে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসত মা ,পিসিদের। আটা মাখালেই তো হলো, সকালে যেহেতু বাবা ,কাকারা কেউ ব্যঞ্জন খেয়ে যেতে পারতেন না । তাই সব তরকারি গরম করতে হতো। রুটি করতে করতে ঘুমের ঘোরে কতো দিন রুটি পুড়েছে, হাত পুড়েছে ….দিনের শেষে মানুষগুলোর শরীর জবাব দিয়ে দিত ক্লান্তিতে। একবার এভাবেই ভাতের হাঁড়ি নামাতে গিয়ে মায়ের পা পুড়ে যায়। অনেক বড় ফোস্কা পড়েছিল। সেই নিয়েই সব কাজ করতেন।


রাত দশটার সময় আবার পাকশালের এক কোনে পাত পড়তো। বাবা ,কাকা, ঠাকুমা ,বাড়ির ছোটদের খাইয়ে ওঠাতে ওঠাতে প্রায় এগারোটা হয়ে যেত। তারপর মা, পিসিরা  খেতে বসতেন । মা একদম রুটি খেতে পারতেন না। তাই দুপুরের করা ভাত একটু থাকত। সেটাই কোনোক্রমে খেয়ে নিতেন। তারপর সব বাসন মেঝে, রান্না ঘর নিকিয়ে, উনুনের আঁচ কমিয়ে শুতে যেতে যেতে প্রায় রাত একটা বাজত। সে সময় আবার উনুনের ছাই দিয়ে বাসন মাঝতে হতো…..


সে যুগে যেহেতু পিতল কাঁসার চল ছিল , সেহেতু আমাদের রান্না ঘরের একপাশে একটা জলচৌকির উপর গুছিয়ে রাখা থাকত ঝকঝকে করে মাজা কাঁসা, পিতলের বাটি, থালা, গেলাস, চাল মাপার একটা পিতলের কুনকে, একটা তামার ঘটি। তামার ঘটি ছিল রান্নায় জল মেপে দেবার জন্য। সেকালে আমার ঠাকুমা আর দিদিমা উভয়েরই শখ  ছিল কাঁসা পিতলের সুদৃশ্য বাসন সংগ্রহের। কেবল কাঁসা পিতল কেন? তামা, পাথর , চীনামাটি , কাঁচ মায় কাঠের যা কিছু সুদৃশ্য তাই ওনারা সংগ্রহ করে গৃহের শোভা বর্ধন করতেন। আমার ঠাকুমার মাটি, চীনামাটি, কাঁচ , কাঠ এসবের কত পুতুল ছিল। ঠাকুরদা কিনে দিতেন…..আমার মায়ের আবার নানা রঙের কাঁচের চুড়ি জমানোর শখ ছিল। সেজ পিসি , ছোট পিসি খুব ভালো কুরুশের কাজ , নকশাদার কাঁথা সেলাই জানতেন। মেজ পিসি চিকন , আসন বোনা এসব আর বড় পিসি আর ন পিসি উল ইত্যাদির হাতের কাজ জানতেন। ঠাকুমা ৩২ রকমের হাতের কাজ ও সেলাই জানতেন। 


ওই সময় মুর্শিদাবাদের খাগড়াই বাসনের খুব চল ছিল।এর মধ্যে ধুতরো ফুলি গ্লাস, পদ্মকাটা বাটি, কামরাঙা বাটি এসব সংগ্রহ ছিল সেরার সেরা।
“মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল
ছাল খসাইয়া রান্ধে বুড়া খাসির তেল।
ছাগ মাংস কলার মূলে অতি অনুপম
ডুম ডুম করি রান্ধে গাড়রের চাম।
একে একে যত ব্যঞ্জন রাঁধিল সকল
শৌল মৎস্য দিয়া রান্ধে আমের অম্বল।। “

রবিবার করে মাংস আসত। ইন্দ্রর দোকান থেকে বলির পাঁঠার মাংস আনা হতো। বাড়িতে মুরগির মাংস ঢুকতো না বহুদিন অবধি। রবিবার করে দুপুরে খাবার সময় সবার জন্য বরাদ্দ থাকত একটা বড় পিতলের জাম বাটি ভর্তি কচি পাঁঠার স্বাদু মাংস , ঝোল , আলু। 
এমনি করে দিন বয়ে যেত। রোজ ভোর চারটের সময় মা পিসিরা ঘুম থেকে উঠতেন । তারপর সারাদিন রান্না ও গৃহকর্ম করতেন নিপুণ হাতে। মা স্নান করে কাচা কাপড় পড়ে , ভিজে চুল এলো করে এক মাথা সিঁদুর পড়ে রান্না শুরু করতেন ঠাকুর প্রণাম করে। রামাশিষ দুধের ক্যান এনে হাঁকা হাঁকি করতেন। আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। আমাদের স্কুল ,কলেজ ,অফিস ছুটি হতো। লেখা পড়ার থেকে ছুটি থাকত। কিন্তু আমার মা ,পিসিদের কোনো ছুটি থাকত না। জ্বর হোক, মাথা ঘুরুক, পুড়ে যাক তাঁদের কোনো ছুটি হতো না আর সংসারের প্রতি মায়া, মমতা, ভালোবাসারও একটুও খামতি হতো না।  মা , ঠাকুমা, পিসিদের ভালোবাসা দিয়ে ঘেরা আমার সেই ছোট্টবেলা সাবেকি হেঁশেলের চেহারা …..আমার স্মৃতিতে আজও যা উজ্জ্বল।


সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ D. N. Shukla, Vastu-Sastra: Hindu Science of Architecture

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.