অশোধিত তেলের দাম শূন্যের নীচে তলিয়ে যাওয়ার খবরে যাঁরা যুগপৎ হরষ বিষাদে আচ্ছন্ন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে দুইখান কথা

না, আমি আদার ব্যাপারি কিমবা জাহাজের কাপ্তেন -কোনওটাই নয়। অনুসন্ধিৎসা বশতঃ এইমাত্র জানলাম আজ্ঞে।

প্রথম কথা, দাম ‘কমা’টা ঠিক কমেছেই বলা যাবে না। বাজারে এটাকে বলে ‘ফিউচার কনট্রাক্ট‘ (Futures contract)। আগাম বায়না। একটি “এক্সপায়ারি তারিখ” থাকে এই বায়নানামায়। সেই তারিখে বিক্রেতা তেল দেবে, ক্রেতা দেবে টাকা। সেই হাতবদলের দিন তেলের দর অনু্যায়ী টাকার হিসেব হবে। ‘ফিউচার কনট্রাক্ট‘ (Futures contract) প্রাইস ইনডেক্স তাহলে হঠাৎ করে শূণ্যের তলায়, ঋণাত্মক মানে পৌঁছল কেন?

এর কারণ একুশে এপ্রিল কনট্রাক্ট অনুসারে যাদের তেল নেওয়ার কথা ছিল, তারা বিশ্বব্যাপী লকডাউন জনিত মন্দা, তেলের নিম্নমুখী চাহিদার কারণে তা নিতে পারছে না। তাদের তেলের গুদামগুলি ইতিমধ্যেই তেলে ভর্তি। নতুন আমদানি করা তেল তারা রাখবে কোথায়! অতএব তারাও কনট্রাক্টের তেল ঘরে না তুলে বিক্রি করে দিতে চায়। এতে অবস্থা যা দাঁড়াল, দেখা গেল ক্রেতার চাইতে বিক্রেতা অনেক অনেক বেশি। অশোধিত তেলের দাম এই প্রথমবারের (নাকি দ্বিতীয়বার!) জন্য নেমে গেল শূন্যের নীচে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তেলের বাজার খোলার দিনও এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে শোনা যায়।

যাকগে, আমাদের এখানে অনেকে হাহুতাশ করছেন, সরকারের বাপবাপান্তও করা হচ্ছে – বিনি পয়সায় না হোক, জলের দরেও না হোক, নিদেনপক্ষে এক লিটার দুধের দরেও তো তেল দিতে পারে সরকার! আজ্ঞে, না দিতে পারে না। এই যে তেলের দর পড়েছে, এটা পড়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার তেল বাজারে। ওটাকে বলে ডব্লুটিআই (WTI) (ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট)। কম সালফারযুক্ত হালকা তেল। আমরা কিনি ব্রেন্ট অয়েল। ব্রেন্ট অয়েল যুক্তরাষ্ট্র বাদে বিশ্বের প্রায় বাকি সমস্ত দেশের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ওপেক দেশগুলি থেকেই আমরা মূলত অশোধিত এই তেল আমদানি করি। এই ব্রেন্ট অয়েলের বাজারে এমন ঋণাত্মক দরের খবর নেই। তবে হ্যাঁ, মন্দার কারণে ব্রেন্ট অয়েলের দামও পড়েছে।

অশোধিত তেল শোধনের পর, সরকার তেলের মূল্য নির্ধারণ করেন। যদিও বলা হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ এতে নেই, ওটা ছেলেভোলানো কথা। সরকার (কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুইই) ঐ তেলের ওপর নানাধরণের কর, সেস ইত্যাদি বসিয়ে রাজকোষ ভরে থাকেন। সেই টাকায় সরকারি খরচ যেমন চলে, তেমনই সরকার ঘোষিত নানা প্রকল্পের অর্থসংস্থানও হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকা, রাস্তাঘাট, বন্দর, পরিকাঠামো – ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প চালু আছে। কর কমিয়ে দিলে আপাতভাবে মানুষের সুবিধে হতে পারে ঠিকই, তবে ঘুরপথে অন্য কোথাও সমপরিমাণ কর বসিয়ে সেই ঘাটতি ঠিক পুষিয়ে নেবে সরকার। নিতেই হবে। তেলের ওপর কর বসানোর সুবিধে হল, এত বড় কর ছাঁকনি দেশে আর দুটি নেই

আসলে ‘সরকারের টাকা‘ বলে তো কিছু হয়না, সবই জনগণের টাকা। সরকার জনগণের টাকায় ফুর্তিফার্তা না করে, কাটমানি না খেয়ে কাজ করলেই হল। সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা জনগণের সেবক। মানুষের টাকার দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয়েছে তাঁদের ওপর। মানুষ এই কারণেই নির্বাচন করেছে তাঁদের। ভিভিআইপিগিরি দেখানোর জন্য তো নয়! দুঃখের কথা, এটা এই আমরা, সাধারণ মানুষও ঠিক বুঝি না, সরকারি নেতা নেত্রী, সরকারি বড় বড় বাবুরাও বোঝেন না। মনে মনে আমরা সেই প্রভু ভৃত্যই থাকতে ভালোবাসি

সুপ্রীতি শাণতাল মাইতি (Supriti Shanthal Maiti)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.