চার কার্যকর্তার আত্মবলিদানে রঞ্জিত কাঞ্চনছড়া রতনমণি শিশুশিক্ষা নিকেতন

ত্রিপুরার চার আর এস এস কার্যকর্তার মর্মান্তিক অপহরণের ইতিহাস বড়ােই বেদনাদায়ক। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ১৯৯৯ সালের ৬ আগস্টের সেই অঘটন রহস্যই হয়ে রয়েছে। কী কারণে চারজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবককে সঙ্ঘের কার্যকতাকে অপহরণ করে চিরতরে গুম করা হয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার কোনাে তদন্তই করেননি বলে অভিযােগ।

দায়সারাভাবে একটি মামলা দায়ের করে এই স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়েছে তৎকালীন সিপিএম সরকার। সুচতুরভাবে উগ্রপন্থীদের উপর দায় চাপানাে হয়েছে। গােটা রাজ্যে। সেইসময় সিপিএমের হামর্দরা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তাদের তাণ্ডবে জনগণ ছিলেন নীরব দর্শক। কিন্তু ২০১৮ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সেই রহস্য সামনে আসতে শুরু করেছে।

গত ৮ মার্চ নিহত চারজন কার্যকর্তার বধ্যভূমি ধলাই জেলায় মনু ব্লকের কাঞ্চনছড়া রতনমণি শিশুশিক্ষা নিকেতনে পা রাখেন। স্বস্তিকার ব্যবস্থাপক জয়রাম মণ্ডল, স্থানীয় প্রচারক কানু মালাকার। আলাপচারিতায় তাঁরা উল্লেখ করেন ১৯৯৯ সালের ৬ই আগস্ট সকাল এগারােটায় শুভঙ্কর চক্রবর্তী, সুধাময় দত্ত, দ্বীনেন্দ্র নাথ দে, শ্যামল সেনগুপ্তকে অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীদের বন্দুক উঁচিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। তখনকার কমবয়সি বিভাগ প্রচারক শুভঙ্কর চক্রবর্তী দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অস্ত্রের মুখে আশ্রমের প্রার্থনা সভাকক্ষ থেকে তুলে নিয়ে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায় তারা। সেই সময় ৫০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রী রতনমণি শিক্ষা নিকেতনের অভ্যন্তরেই ছিল। প্রকাশ্য দিবালােকে বন্দুক উঁচিয়ে গ্রামের উপর দিয়ে নিয়ে যায় চার কার্যকতাকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই অপহরণকাণ্ড সংঘটিত করা হয়। এমনকী মনু থানায় এই সংবাদ পৌঁছায় ২৪ ঘণ্টা পর। পুলিশ সব জেনেশুনে নীরব দর্শক ছিল। ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চম থানায় একটি এফ আই আর দায়ের করা হয়, নং Case No. 41/99 U/S-448/365/34 and 27 of arm’s act’s.। এই মামলা করার পর পুলিশ দায়সারাভাবে কাঞ্চনছড়া শিশুশিক্ষা নিকেতনের কাছাকাছি চিরুনি তল্লাশি করার নাটক করে। কিন্তু সত্যিকারের কোনাে আসামি গ্রেপ্তার করেনি। এর বিরুদ্ধে মনু। থানার সামনে দশদিন গণঅবস্থান সংঘটিত করে স্বয়ংসেবকরা। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে দশজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন ধনঞ্জয় মুণ্ডা, আনন্দ রিয়াং, খলেন্দ্ররাম রিয়াং, গণ ত্রিপুরাসহ অন্যান্য। এটি ছিল পুলিশের একটি সাজানাে নাটক। এতবড়াে অপহরণের পর মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার একটি দুঃখজনক বিবৃতি পর্যন্ত দেননি বলে। কোনাে ম্যাজিসট্রেট পর্যায়ের অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করার প্রয়ােজন অনুভব করেননি। গ্রাম থেকে পাহাড়, নগর সর্বত্রই জল্লাদরদপী ক্যাডাররা দখল নিয়েছিল। চার কর্মকতার অপহরণস্থল রতনমণি শিশুশিক্ষা নিকেতন আজও সমানভাবে কাজ করে চলেছে, এক মুহূর্তের জন্যও স্তব্ধ হয়নি। ১৯৮৯ সালে এই আশ্রমের সূচনা হয়। তখন আবাসিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বে ছিলেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা কে কে সত্যমজী। ওই সময় ছাত্র ও ছাত্রী উভয় আবাসিক হস্টেল ছিল। এরপর হরিহর প্রসাদ এই আশ্রমের দায়িত্বভার নেন।

সেই সময়ই এই অপহরণ কাণ্ড ঘটে। ভূমিপুত্রদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য সি পি এমের এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এই অপহরণ কাণ্ড তারই অঙ্গ রূপে চিহ্নিত। বৈরীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হরিহর প্রসাদ সঙ্রে কাজ চালিয়ে যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। লালসন্ত্রাসের মােকাবিলা করেই কাঞ্চনছড়া আশ্রমে হরিহর প্রসাদ, শ্রীকৃষ্ণ ভীড়া, রাজেশ দাস, বর্তমানে সঞ্জিত পাল এই আবাসিক আশ্রমের দায়িত্ব পরিচালনা করছেন। এখনাে ৫০-এর বেশি আবাসিক উপজাতি ছাত্র রয়েছে। তাদের পঠন পাঠনের দায়িত্ব নিয়ে সঙ্ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। দীর্ঘ চার দশক উপজাতি ভূমিপুত্রদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সঙ্ঘ যে ভূমিকা নিয়েছে। লালসন্ত্রাসের মুখে আত্মাহুতির পরও আবাসিক শিক্ষাঙ্গন রাজ্যের আটটি জেলায় চলছে। মানব কল্যাণে এই আত্মবলিদান কাঞ্চনছড়া রতনমণি শিশু শিক্ষা নিকেতন এক ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

লক্ষ্মণ দেব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.