করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু চীন থেকে। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর। হুবেই প্রদেশের উহান শহর। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ চীনের দেশীয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আউট ব্রেক ঘোষণা করে।৩০ জানুয়ারি গ্লোবাল পাবলিক হেলথ এমার্জেন্সি ঘোষণা করে। গত ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) করোনাকে বিশ্বব্যাপী ‘মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং করোনার নামকরণ করেছে কোভিড-১৯। কো হলো করোনা, ভি হলো ভাইরাস এবং ডি হলো রোগ। ২০১৯ সালে রোগটি ধরা পড়ে তাই নামকরণ হয় কোভিড-১৯। এই মারণ ব্যাধি ছড়িয়ে গিয়েছে ১৬০টির মতো দেশে। মৃতের সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে দশ হাজারের বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। ভারতে এই সংক্রমণ রুখতে সেই ব্রিটিশ জমনার আইনই ভরসা। ১৮৯৬ লালে বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে অধুনা মুম্বাইতে প্লেগের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতে ১৮৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৈরি করা। হয়েছিল ‘দ্য এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট বা মহামারি প্রতিরোধ আইন। এই আইনের প্রভাবে সরকার বিভিন্ন বাড়িতে, যাত্রীদের মধ্যে সন্দেহজনক প্লেগের রোগী খুঁজে বের করত। সংক্রামিতদের জোর করে আলাদা করে রাখা হতো। ধবংস করে দেওয়া হতো সংক্রমিত এলাকাগুলি। এই আইনে চারটি ধারা রয়েছে। আইনের প্রথমেই স্পষ্ট বলা 26369—“An Act to provide for the better prevention of the spread of Dangerous Epidemic Diseases” per ও রাজ্য উভয়েরই এই আইন প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। আইনের দ্বিতীয় ধারায় রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিধি তৈরির অধিকার দেওয়া হয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে—
(১) যখনই কোনও রাজ্য সরকার মনে করবে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং বর্তমান আইনে তা রোধ করা সম্ভব নয়, তখন সরকার নিজে বা কোনও ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে অধিকার দিতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনীয় নোটিস জারি করতে পারে। (২) ট্রেন বা অন্য কোনও পরিবহণে যাতায়াতকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। এর জন্য কোনও অনুমতির প্রয়োজন নেই। (৩) স্বাস্থ্যপরীক্ষকদের সন্দেহ হলে সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আলাদা করে হাসপাতাল বা অন্য কোনও অস্থায়ী জায়গায়। থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। (৪) এই আইন অমান্য করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। এমনকী হতে পারে জেলও। উক্ত আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে স্পষ্ট এইরূপ :
“Any person disobeying any regulation or order made under this Act shall be deemed to have committed an offence punishable under Section 188 of the Indian Penal Code.”
ভারতীয় দণ্ড বিধির ১৮৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বোধগম্য হওয়ার জন্য দুটি সহজ উদাহরণ। তুলে ধরছি। মনে করুন, সেন্ট্রাল রোড দিয়ে মিছিল করে গিয়ে আপনি গণেশ পূজার মুর্তি বিসর্জন করবেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এক নির্দেশ প্রদান করে আপনাকে মিছিল না করা কথা জানায়। তার পর আপনি স্থানীয় প্রশাসনের কথা অমান্য করে মিছিল করেন। তার জন্য সেন্ট্রাল রোডে এক দাঙ্গা হয়। সেক্ষেত্রে আপনি ১৮৮ নম্বর ধারায় দোষী হতে পারেন। এখন মনে করন, আপনি সন্দেহজনক ভাবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী, সেজন্য স্থানীয় প্রশাসন (স্বাস্থ্য বিভাগ) আপনাকে আইসোলেশন বা কোয়রান্টিন বা হোম কোয়রান্টিনে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু আপনি নির্দেশ অমান্য করে লোকালয়ে। ঘোরাফেরা করছেন। তারজন্য অন্যের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা রয়েছে বা অন্য ব্যক্তির মধ্যে এই করোনা ভাইরাস রোগ সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।তখন আপনি এই ১৮৮ নম্বর ধারায় দোষী হতে পারেন এবং সাজাও হতে পারে। এই আইনের আওতায় জারি বিজ্ঞপ্তি অনুসারের বিধিনিষেধ মেনে চলা প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের কর্তব্য। এই বাধা-নিষেধ অমান্য করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। ভারতীয় দণ্ড বিধির ১৮৮ নম্বর ধারা অনুসারে দু’মাস থেকে ছ’মাস পর্যন্ত কারাবাস এবং ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা জরিমানার সংস্থান রয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় দণ্ড বিধির ২৭০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে ক্ষতিকারক রোগ সংক্রমণ ছড়ানোয় সহায়তা করা অপরাধ। এতে সর্বোচ্চ দু’ বছরের সাজা হতে পারে।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাসের সতর্কতা হিসেবে আমরা তিনটি শব্দ ইদানীং প্রায়ই শুনে থাকি। শব্দগুলি হচ্ছে আইসোলেশন, কোয়রান্টিন ও হোম কোয়রান্টিন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কথায় এই তিনটি শব্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ওইসব চিকিৎসকদের মতে আইসোলেশন হচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগীকেই আইসোলেশনে পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে ১৪ দিনের মেয়াদে আইসোলেশন চলে। সেই মেয়াদ প্রয়োজনে বাড়ানোও হতে পারে। সেই সময় রোগীর সঙ্গে পরিজন-সহ বাইরের কেউ যোগাযোগ করতে পারেন না। আবার কোয়রান্টিন হচ্ছে ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কথায় করোনা ভাইরাস রোগীর শরীরে সংক্রমিত হয়েছে কি না সেটা জানার জন্যই সন্দেহজনক রোগীকে কোয়রান্টিনে (অনদের থেকে পৃথক করে রাখা হয়) পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে ১৪ দিনের মেয়াদে কোয়রান্টিন পিরিয়ড চলে। এই সময় রোগীকে কোনো ওষুধপত্র দেওয়া হয় না, শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়। এই সময় মাস্ক ব্যবহারের কথা বলা হয়। এই সময় হাসপাতালে রাখা হয় না। সরকার নিয়ন্ত্রিত কোয়রান্টিনে রাখা হয়। আর হোম কোয়রান্টিনও প্রায় কোয়রান্টিনের মতো, শুধু ‘হোম কোয়রান্টিন’ বাড়িতে হয় এবং ‘কোয়ারান্টিন’ সরকার নিয়ন্ত্রিত স্থানে হয়। ১৮৯৭ সালের ‘দ্য এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট’ বামহামারী প্রতিরোধ আইনের ৪ নম্বর ধারায় এই আইন বলবকারী আধিকারীকদের। আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলা 26369485984—“No suit of other proceeding shall lie against any person for anything done or in good faith intended to be done under this Act.”
স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে একাধিবার এই ১৮৯৭ সালের ‘দ্য এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট’ বা মহামারী প্রতিরোধ আইন কার্যকর করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্রের পুনেতে ‘সোয়াইন-ফ্লু’ আটকাতে গোটা শহরের সমস্ত হাসপাতালগুলিকে পরীক্ষার জন্য উক্ত আইনের ২ নম্বর ধারা প্রয়োগ করা হয়। যদিও পরে সোয়াইন-ফু রোগ বলে। চিহ্নিত করা হয়। ২০১৫ সালে চণ্ডীগড়ে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর মোকাবিলায় ওই আইন প্রয়োগ করা হয়। আইন অনুসারে আধিকারিকদের নোটিশ জারি করে নিদের্শ দেওয়া হয়েছিল ৫০০ টাকার চালান কাটতে৷ সম্প্রতি ২০১৮ সালে গুজরাটের বদোদরার জেলা কালেক্টর এই আইনের আওতায় নোটিফিকেশন জারি করে ওয়াগোড়িয়া তালুকের খেদকর্মাসিয়া গ্রামকে কলেরা অধ্যুষিত ঘোষণা করেন। তার আগে সেখানে ৩১ জনের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে সমগ্র দেশে ১৮৯৭ সালের মহামারী আইন বলবৎ করা হয়েছে। কর্ণাটক রাজ্য সরকার উক্ত আইনের ২ নম্বর ধারা অনুসারে গত ১১ মার্চ একটি রেগুলেশন বলবৎকরে কর্ণাটক রাজ্যে। ওই রেগুলেশনে। ‘Epidemic Disease’-র সংজ্ঞার ভিতরে ‘কোভিড-১৯’-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে করোনার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। পরিশেষে, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। দেখতে হবে একজন নাগরিকও করোনা সংক্রমণের জেরে কোনও প্রকার বিদ্বেষের শিকার না হন এবং এই মওকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং ওষুধপত্রের কালোবাজারির চেনা ব্যাধিটিও যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে সেটাও সরকার ও স্থানীয় প্রসাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্র সরকার ‘মাস্ক’ ও ‘স্যানিটাইজার’উভয় দ্রব্যকেনিত্য প্রয়োজনীয়। দ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করেছে ১৯৫৫ সালের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আইনের আওতায়। মনে রাখা দরকার, এই আইনে অপরাধ সংঘটিত হলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। সে যাই হোক, ‘কোভিড-১৯’-র সংক্রমণ প্রতিরোধ জনসচেতনতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের জনস্বাস্থ্য কর্মীদের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করা এই মুহূর্তে খুব দরকার। সেইসঙ্গে সরকারি কর্মীদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার আমজনতার। প্রধানমন্ত্রীর জনতা কারফুর আবেদনে দেশবাসীকেও পূর্ণমাত্রায় সাড়া দিতে হবে।
ধর্মানন্দ দেব
(লেখক অসম নিবাসী বিশিষ্ট আইনজীবী)