বাল্মীকি রামায়ণ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, স্বামী বেদানন্দ রচিত গুরুমুখী রামায়ণ থেকে আমরা জানতে পারি—আদি পুরুষ নিরঞ্জন। নিরঞ্জনের পুত্র ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও কন্যা ভানু। জমদগ্নির সঙ্গে ভানুর বিবাহ হয়। জমদগ্নির পুত্র মরীচ, মরীচের পুত্র কশ্যপ, কশ্যপের পুত্র সূর্য। সূর্যের পুত্র মনু। মনু থেকে সূর্য বংশের উৎপত্তি। সেই সময় সূর্যবংশের রাজ্যের নাম ছিল উত্তর কোশল। উত্তর কোশল রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল অযোধ্যা। সরযূ নদীর তীরে সূর্যপুত্র মনু অযোধ্যানগরী নির্মাণ করেন। মনুর পুত্র মান্ধাতা। মান্ধাতা প্রবল পরাক্রমী দিগবিজয়ী রাজা ছিলেন। মান্ধাতার পুত্র মুচকুন্দ। মুচকুন্দের পুত্র পৃথু। পৃথুর পুত্র শতাবর্ত। শতাবৰ্তর পুত্র আর্যাবর্ত। আর্যাবর্ত সমগ্র উত্তর ভারতের অধীশ্বর হন। এজন্য উত্তর ভারতের নাম আর্যাবর্ত। আর্যাবর্তের পুত্র ভরত। ভরত সমগ্রভূমির উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তাঁর নামানুসারে এই ভূভাগের নাম ভারতবর্ষ।
ভরতের পুত্র ভূধর। ভূধরের পুত্র খাণ্ড। খাণ্ডের পুত্র দণ্ড। দণ্ডের নামে তার জন্মস্থানের নাম দণ্ডকারণ্য হয়েছিল। দণ্ড শুক্রাচার্যের কন্যা অরজাকে বলপূর্বক বিবাহ। করেছিলেন। শুক্রাচার্যের অভিশাপে দণ্ডের অকাল মৃত্যু হয়। দণ্ডের ঔরসে অরজার গর্ভে হারীত নামে এক পুত্র জন্মে। বালক হারীতকে মহর্ষি বশিষ্ট অযোধ্যার সিংহাসনে। প্রতিষ্ঠিত করেন। হারীতের পুত্র হরিবীজ। হরিবীজের পুত্র বিখ্যাত হরিশ্চন্দ্র। হরিশ্চন্দ্র রাজসূয় যজ্ঞ করেন এবং অদ্বিতীয় দাতা বলে খ্যাত হন। হরিশ্চন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্ব। রোহিতাশ্বের পুত্র সগর। সগর শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। মহর্ষি কপিলের শাপে একজন পুত্র ছাড়া সকলে ভস্মীভূত হয়েছিলেন। জীবিত ওই একজন পুত্রের নাম অসমঞ্জ। অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান। অংশুমানের পুত্র দিলীপ। দিলীপের পুত্র ভগীরথ। ভগীরথই স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্তে এনে সগর বংশের উদ্ধার করেন।ভগীরথের পুত্র সৌদাস। সৌদাসের অন্য নাম কল্মষপাদ। সৌদাসের পুত্রের নাম সুদাম। সুদামের পুত্রের নাম দিলীপ। দিলীপের পুত্র ছিলেন রঘু। রঘু ছিলেন স্বর্গ মর্ত বিজয়ী বীর এবং অতুলনীয় দাতা। তার কীর্তিপ্রভাবে সূর্যবংশ রঘুবংশ নামে পরিচিত হয়। রঘুর পুত্র অজ। অজ-র পুত্রই হলেন মহারাজ দশরথ। দশরথের তিন রানির (কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রা) গর্ভে নারায়ণ চার অংশে (রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন) জন্মগ্রহণ করেন।
বিশ্বামিত্র : বিশ্বামিত্র জীবনের প্রথম ভাগে ছিলেন রাজা। পরে তিনি তপস্যা করে বহু দিব্যাস্ত্র লাভ করেন। তিনি ছিলেন মহাতপঃ শক্তিশালী ত্রিকালজ্ঞ। তিনি রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন যে নারায়ণের চার অংশ তা জানতেন এবং নারায়ণের অবতার রূপেরামচন্দ্র রাক্ষসকুল বিনাশ করে ধর্মরাষ্ট্র গঠনের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন তাও তিনি জ্ঞাত ছিলেন।
তারকা : সুকেতু নামে এক যক্ষ ব্রহ্মার ধ্যান করে কন্যারূপে তারকাকে। লাভ করেন। ব্রহ্মার বরে তারকা সহস্র মত্ত হস্তীর বল লাভ করে। জম্ভাসুরের পুত্র সুন্দের সঙ্গে তারকার বিবাহ হয়েছিল। তারকা ও সুন্দের পুত্রের নাম মারীচ। অগস্ত্যঋষির অভিশাপে তারকা ও মারীচ রাক্ষসে পরিণত হয়। তারকা যেখানে থাকত সেখানে মলদ ও কারুষ। নামে দুটি জনপদ ছিল। তারকা রাক্ষসে পরিণত হবার পর ওই নগর দুটি ধ্বংস করে। এর ফলে তা পুনরায় অরণ্যে পরিণত হয়। তখন সেই স্থানের নাম হয়ে যায় তারকার অরণ্য।
তারকা বধ : হিন্দুশাস্ত্রে নারীহত্যা মহাপাতক বলে কথিত আছে। রামচন্দ্র। তারকাকে হত্যা বা বধ করেন। কিন্তু রাম সেই বধের কারণে মহাপাতক হননি। তার কারণ, মনুস্মৃতিতে কথিত আছে— “আততায়িনমায়ন্তং হন্যাদেবাবিচারয়।”
উদ্যত আততায়ীকে বিনা বিচারে হত্যা করা উচিত। তারকা ছিল শতসহস্র নর-নারীর হত্যাকারিণী। সমাজে নিরাপত্তা এবং শান্তি স্থাপনের জন্য তারকাকে বধের প্রয়োজন ছিল। তাই রামচন্দ্র তারকাকে বধ করে মহাপাতক হননি। হরধনু :
একমতে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করার সময় আবার অন্য মতে ত্রিপুরাসুর। বধের সময় মহাদেব যে ধনু ব্যবহার করেছিলেন, পরে সেই ধনু দেবতাদের কাছে থাকে। দেবতারা সেই ধনু জনকরাজার পূর্বপুরুষ দেবরাতের নিকট গচ্ছিত রেখেছিলেন। অন্য মতে পরশুরাম তার। গুরু মহাদেবের নিকট এই ধনু পেয়েছিলেন। তিনি জনককে এই ধনু দেন এবং তিনিই নির্দেশ দেন এই ধনুকে যে গুণ পরাতে পারবে তার সঙ্গেই যেন সীতার বিবাহ দেওয়া হয়। মহাদেবের আর এক নাম ‘হর। তাই এই ধনুর নাম হরধনু।
জনক : ধর্মাত্মা রাজা নিমির পুত্র মিথি; মিথির পুত্র প্রথমজনক। তার তিন পুরুষ পর দেবরাত। দেবরাতের চৌদ্দপুরুষ পরে হ্রস্বরোমা। হ্রস্বরোমার দুই পুত্র সীরধ্বজ এবং কুশধ্বজ। সীরধ্বজই হলেন সীতার পিতা জনক।
সীতা : দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কুশধ্বজের একটি কন্যা ছিলেন। সেই কন্যার নাম বেদবতী। পিতার ইচ্ছা ছিল বিষ্ণুর সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেবেন। কিন্তু তৎপূর্বেই কুশধ্বজ শুম্ভ দৈত্যের হস্তে নিহত হলেন, তার সাধ্বী পত্নীও পতির সহমৃতা হন। তখন বেদবতী নারায়ণকে পতিরূপে পাবার জন্য তপস্যা করতে গেলেন। দুর্মতি রাবণ তাঁকে নির্জনে একাকিনী দেখে হরণ করার উদ্দেশ্যে কেশধারণ করেন। বেদবতী দ্রুত কেশপাশ ছেদন করে রাবণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করলেন। রাবণকে বেদবতী বলেছিলেন- “তোর ধ্বংসের জন্য আমি পুনরায় কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করব।”অগস্ত্যঋষি রামকে বলেছিলেন—সেই বেদবতীই সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। প্রাচীনকালে নিয়ম ছিল—রাজারা স্বহস্তে যজ্ঞভূমি কর্ষণ ও শোধন করবেন। একদা রাজা জনক যজ্ঞভূমি কর্ষণ করছিলেন। ভূমি কর্ষণের সময়ে লাঙ্গলের ফালার দ্বারা জমিতে যে রেখা অঙ্কিত হয়ে যায় তার নাম সীতা।
অথ মে কৃষতঃ ক্ষেত্রংলাঙ্গলা দুহিতা ততঃ। —আদি ৬৬১৩
ক্ষেত্রং শোধয়তা লব্ধা নাম্মা সীতেতি বিশ্রতা।
ভূতলাদুহিতা সাতু ব্যবৰ্ধত সমাত্মজা। —আদি ৬৬১৪
যজ্ঞভূমি কর্ষণকলে সীতার মধ্যে আকস্মিকভাবে কন্যাকে পেয়ে জনক ঔরসজাত কন্যাপেক্ষা তাকে স্নেহযত্নে লালন পালন করেন। সীতার মধ্যে প্রাপ্ত বলে কন্যাটির নাম রাখেন সীতা। ভূমি হতে উৎপন্ন বা প্রাপ্ত বলে সীতাকে বলা হয় পৃথিবীকন্যা। বিদেহ রাজ্যের কন্যা বলে তার নাম বৈদেহী। জনকের কন্যা, এজন্য তাঁকে জানকীও বলা হয়।
বিবাহ : মিথিলার রাজা জনকের পালিতা কন্যা সীতার সঙ্গে রামের; জনকের ঔরসজাত কন্যা ঊর্মিলার সঙ্গে লক্ষ্মণের; জনকের আপনভাই কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবীর সঙ্গে ভরতের এবং শ্রুতকীর্তির সঙ্গে শত্রুঘ্নের বিবাহ হয়। সম্পাতি ও জটায়ু :
কশ্যপের পত্নী বিনতার গর্ভে অরুণ ও গরুড়ের জন্ম হয়। অরুণের দুই পুত্র সম্পাতি ও জটায়ু।
হনুমান : পুঞ্জিকাস্থলী নামে এক অপ্সরা ঋষি শাপে যূথপতি কুঞ্জরের কন্যা অঞ্জনা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। বানররাজ কেশরীর সঙ্গে অঞ্জনার বিবাহ হয়। বায়ুদেবতার বরে অঞ্জনার গর্ভে হনুমানের জন্ম হয়। বায়ুকে মরুৎ বা পবন বলা হয়। তাই হনুমানের নাম মারুতি বা পবননন্দন।
রাবণ : রাবণকে বলা হয় দশানন। রাবণ ছিলেন বিরাট পণ্ডিত। বহুবিধ, বহুমুখী শক্তি, প্রতিভা এবং জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যুদ্ধেও ছিলেন পারদর্শী।
রাক্ষসাধিপতি মাল্যবানের আদেশে তার কন্যা নিকষা বা কৈকসী বিশ্রবা মুনিকে পতিরূপে বরণ করেন। কৈকসীর গর্ভে তিন পুত্র— রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ জন্মগ্রহণ করেন।তিন ভাই কঠোর তপস্যা করলে ব্রহ্মা তুষ্ট হন। রাবণ ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব চাইলেন। ব্রহ্মা রাবণকে অমরত্ব বাদে অন্য বর চাইতে বললেন। রাবণ স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের সব জীবের নাম উল্লেখ করলেন (কিন্তু সেই নামের তালিকায় নর ও বানরের নাম উল্লেখ করেননি)—- তাদের হাতে তার মৃত্যু হবে না, এই বর চাইলেন। ব্রহ্মা তথাস্তু বললেন। কুম্ভকর্ণ ছয়মাস নিদ্রা এবং একদিন জাগরণ এবং ওই জাগরণের দিন অজেয় হবার বর চাইলেন। ব্রহ্মা শর্ত-সহ বর দিলেন। শর্ত ছিল—অকালে নিদ্রা ভঙ্গ হলে মৃত্যু হবে। বিভীষণকে ব্রহ্মা অমরত্ব বর দেন।
মাল্যবান্ যখন সংবাদ পেলেন যে তাঁর দৌহিত্রেরা বর পেয়ে অজেয় হয়েছে, তখন তিনি তাদের আদেশ দিলেন— কুবেরকে পরাজিত করে লঙ্কা অধিকার করার। রাবণ কুবেরকে পরাজিত করে লঙ্কা ও পুষ্ককবিমান অধিকার করলেন। কুবেরকে পরাজিত করার পর রাবণ পুষ্ককবিমান নিয়ে হিমালয়ে গেলেন। সেখানে তার পুষ্পকথ অকস্মাৎ অচল হয়ে গেল।নন্দী তাকে ফিরে যেতে বলল। রাবণ নন্দীকে অপমান করলেন। নন্দী রাবণকে অভিশাপ দিলেন। যে বানরের দ্বারাই রাবণের সাম্রাজ্য এবং বংশ ধ্বংস হবে। রাবণ তাচ্ছিল্য করলেন এবং শিবের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে কৈলাশকে ধারণ করে উঠাতে চেষ্টা করলেন। শিব তার পায়ের আঙুলের চাপ দিয়ে রাখলেন। যে চাপে রবণের হাত চাপা পড়ে যাওয়ায় সে আর্তরবে শিবের স্তব জপ করতে লগল। নীলকণ্ঠ তুষ্ট হয়ে রাবণকে মুক্তি দেন। ভীষণ ‘রব’ করে আর্তনাদ করেছিলেন বলে সেদিন থেকে দশাননের নাম হলো রাবণ।
বালিবধ : বালিবধ ছিল অত্যাচার, ব্যাভিচার থেকে সমাজকে রক্ষা করা। রামচন্দ্র ছিলেন ক্ষত্রিয় তাই রাজ্য-ধর্ম ইত্যাদিকে রক্ষা করা ছিল তার পরম কর্তব্য। তিনি শুধু বালীকে বধ করতে চেয়েছিলেন। সামনাসামনি লড়াই করলে অযথা সৈন্য ক্ষয় হতো, তাই রামচন্দ্র গোপনে বালীকে বধ করেন, যা ছিল ক্ষাত্রধর্মের অন্যতম কৌশল।
রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা : পুরাণে ও কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা আছে। কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে নেই। বাল্মীকি রামায়ণে আছে যে তিনি আদিত্যহৃদয় স্তোত্র দ্বারা সূর্যের উপাসনা করেছিলেন।
শূদ্রতপস্বী শম্বুক বধ : রামচন্দ্র কখনই শূদ্র বিদ্বেষী ছিলেন না। কারণ নিষাদরাজ গুহককে মিত্র বলে গ্রহণ করে তার উচ্ছিষ্ট ফল সাদরে খেয়েছিলেন। যিনি ব্যাধকন্যা শবরীকে সস্নেহে আশীর্বাদ করে তার প্রদত্ত ফলসমূহ খেয়েছিলেন, যিনি বানর, ভল্লুকগণের সঙ্গে বাস ও ভোজন করতেন, রাজ্যাভিষেক উৎসবে ও অশ্বমেধ যজ্ঞে যিনি বানরগণের উপর ভার দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণগণের আহার্য পরিবেশনের। সেই রামচন্দ্র যে শূদ্রকে ঘৃণা করতেন বা তার রাজ্যে শূদ্রের কোনও প্রকার অসম্মান ছিল— একথা নিতান্ত অভিসন্ধি পরায়ণ লোক ভিন্ন কেউ বলতে পারে না। শম্বুকের তপস্যার অন্তরালে নিশ্চয়ই অনুল্লিখিত গুরুতর সমাজ বা রাষ্ট্রের অনিষ্টকর কার্যকলাপের অভিসন্ধি ছিল, যার জন্য রামচন্দ্র তার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করেন। মনে রাখতে হবে, রাবণ ও কুম্ভকর্ণও তপস্যা করেছিলেন।
লক্ষ্মণের রাম কর্তৃক বিসর্জিত এবং দেহত্যাগ : মহর্ষি অতিবলের দূত মহর্ষি কাল রামের সঙ্গে গোপনে আলাপ করতে চেয়ে নিয়ম করলেন যে, তাদের আলাপনের কালে যদি কেউ তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়, তবে সে বধ্য হবে। রাম সম্মত হয়ে লক্ষ্মণকে দ্বারে রাখলেন। এমন সময়ে মহর্ষি দুর্বাসা এসে রামের দর্শন চাইলেন। লক্ষ্মণ অপেক্ষা করতে বলায় ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্বাসা বললেন– অবিলম্বে রামকে সংবাদ দাও, নতুবা আমি তোমাদের সকলকে অভিশাপ দেব। লক্ষ্মণ অগত্যা সকলকে অভিশাপ থেকে। বাঁচাবার জন্য নিজেকে বিপন্ন করে রামের নিকট সংবাদ দিলেন। দুর্বাসা বহুকাল উপবাসের পর ভোজন করতে চাইলেন। রাম ভোজনের ব্যবস্থা করলেন। দুর্বাসা ভোজন শেষ করে তৃপ্ত হয়ে চলে গেলেন।
গুরু বশিষ্ঠকে ডেকে রাম লক্ষ্মণের সম্পর্কে কর্তব্য জানতে চাইলেন। বশিষ্ঠ বললেন—“প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলে ধর্ম লোপহবে। তুমি লক্ষ্মণকে ত্যাগ করো।”
রাম বললেন—
“বিসর্জয়ে ত্বাং সৌমিত্রে মাভূদ্ধর্ম বিপর্যয়ঃ।
ত্যাগোবধো বা বিহিতঃ সাধুনাং হৃভয়ং সমম্ ৷৷
—উত্তর ১০৬।১৩
“লক্ষ্মণ ! তোমাকে বিসর্জন দিলাম। ধর্মের বিপর্যয় না হয়। প্রিয়জন কতৃর্ক ত্যাগ বহা মৃত্যু সাধুজনের পক্ষে দুই-ই সমান।”রাম কর্তৃক বিসর্জিত, রামগত প্রাণ লক্ষ্মণ সরযূতীরে গমন পূর্বক যোগসমাহিত হয়ে দেহত্যাগ করলেন।
রামের বিষ্ণুলোক যাত্রা : লক্ষ্মণের দেহত্যাগের পর কুশকে দক্ষিণ কোশলের এবং লবকে উত্তর কোশলের সিংহাসনে অভিষেক করলেন। বিন্ধ্যপর্বতের পার্শ্বস্থ কুশাবতীনগরীতে কুশ ও শ্রাবস্তীপুরে লবের অভিষেক কার্য সুসম্পন্ন হলো। শত্রুঘর দুই পুত্র— সুবাহুকে মথুরা এবং শত্রুঘাতীকে বৈদিশপুরীর রাজপদে অভিষিক্ত করা হলো। অতঃপর রাম, ভরত, শত্রুঘ্ন, স্ত্রীগণ, সুগ্রীবাদি বানর ও ভল্লুকগণকে সঙ্গে নিয়ে সরযু নদীতে আত্মনিমজ্জন পূর্বক বিষ্ণুলোকে প্রস্থান করলেন। বানর ও ভল্লুকগণ। যে যে দেবতার অংশে জন্মেছিলেন সেই সেই দেবতায় প্রবেশ । করলেন। সুগ্রীব সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করলেন।
রাম : রাম নাম জপ ও লীলা ধ্যান করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত, সাধক, তপস্বী মহাপুরুষ জীবনে পরম ও চরম মুক্তিলাভ করে জগৎকে আলোকিত করে গেছেন। তার আদর্শ চরিত্র ও মহত্ত্ব স্মরণ, মনন, আলোচনা ও অনুসরণ করে একটা বিরাট জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি- সুগঠিত, সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে শতসহস্রাব্দ যাবৎ টিকে আছে।
তাঁর চরিত্র মহিমা ও লীলা কাহিনি পুরাণে, ইতিহাসে, কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পে, ধর্মে, কর্মে, আচরণে, চিন্তায়, ভাবনায়, কল্পনায়, স্মরণে, বচনে, আলোচনায় সামগ্রিক প্রভাব বিস্তার পূর্বক বিরাট জাতীয় চেতনাকে শতশত যুগ ধরে আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট করে রেখেছে।
যাবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবৎ রামায়ণকথা লোকে প্রচরিষ্যতি॥
অমিত ঘোষ দস্তিদার