ষোলো সালের ভোটের তাপ তখন গনগনে! সারদা-নারদা অভিযোগ উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দিদি হঠাৎ বলতে শুরু করেছিলেন, চোর বলবেন না! দরকার হলে আপনার বাড়ির বাসন মেজে দেব। ২৯৪ টা আসনে আমিই প্রার্থী!
সাত বাদে উনিশের ভোট শুরু। দিদির গলায় ফের এক কথা। ৪২ টা আসনে আমিই প্রার্থী! আমাকে ভোট দিন।
বিধানসভা ভোটে দিদির ফর্মুলারকারণ বোঝা গিয়েছিল। এক শ্রেণির বিধায়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন উপর্যুপরি দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, তখন ভোটারদের সামনে তাঁর ছবি রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে যাই করুক, তাঁর স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত,-এমনটাই দাবি ছিল তাঁর। তাতে ফলও মিলেছিল।
কিন্তু উনিশেও সেই এক ফর্মুলা কেন? প্রায় আট বছর বাংলায় ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। সাংসদদের অনেকেই লোকসভায় দুটি মেয়াদ কাটিয়ে দিয়েছেন। তার পরেও স্রেফ দিদির মুখই ভরসা কেন? তবে কি স্থানীয় ভাবে গ্রহণযোগ্য নেতা তৈরি হয়নি? তাঁদের বিরুদ্ধে কি স্থানীয় স্তরে অভিযোগ রয়েছে? তাঁরা কি মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন? নাকি অন্য আরও শঙ্কা রয়েছে তৃণমূলে?
বুধবার কোচবিহারের দিনহাটায় উনিশের ভোটের প্রথম সভা ছিল মমতার। সেখানে লোকসভা প্রার্থী একদা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ও বাম আমলের মন্ত্রী পরেশ অধিকারী। দেখা যায়, বক্তৃতায় শেষ দিকে পৌঁছে মমতা তাঁকে ইশারা করে ডাকছেন। পাশে এসে দাঁড়ান পরেশ। তার পরই দিদি বলেন, এখানে আমাদের প্রার্থী পরেশ অধিকারী। তবে মনে রাখবেন, ভোটটা শুধু পরেশদাকে দিচ্ছেন না, আমাকে দিচ্ছেন। কারণ আমার লড়াই দিল্লির বিরুদ্ধে। ওরা আমাদের টাকা দেয় না, পয়সা দেয় না, খুব জ্বালায়! ওঁরা জিতবেন, দিল্লিতে গিয়ে দাপাবেন। আর আমি এখানে বসে দেখব, দিল্লিতে যাতে জনগণের সরকার হয়।
কিন্তু শুধু কি এ কারণেই তাঁকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন মমতা?
তৃণমূলের অনেক নেতাই মনে করেন তা নয়! দলের একাধিক রাজ্য নেতার মতে, কোচবিহারের কথাই ধরা যাক। গত পাঁচ বছর সেখানে তৃণমূলের সাংসদ ছিলেন পার্থপ্রতিম রায়। তাঁর বিরুদ্ধে গোষ্ঠী কোন্দল থেকে শুরু করে দুর্নীতির অভিযোগ দলের মধ্যেই ছিল। দিদি তাঁকে এ বার টিকিট দেননি। এমনকী প্রার্থী ঘোষণার সময় বলেছিলেন, ওঁ যদি দলে থাকে, ভাল ভাবে চলে তা হলে আবার কাজ পাবে। কারণ, তৃণমূলেও খবর ছিল তলে তলে বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন পার্থ।
পার্থ-র স্থানে পরিবর্ত প্রার্থী হিসাবে আট মাস আগে পরেশ অধিকারী দলে টেনেছিল তৃণমূল। মজার ঘটনা হল, তার পরই রাতারাতি স্কুল সার্ভিসে সফল প্রার্থীর তালিকায় নাম উঠেছিল পরেশ কন্যার। শুধু তা নয়। গত কয়েক মাস ধরে দলের মধ্যে অভিযোগ উঠছিল, তেলে জলে মিশ খাচ্ছে না। একদা যে বামেদের হাতে কোচবিহারে তৃণমূল মার খেয়েছে। তাদেরই এক জন তৃণমূলেরই প্রার্থী। সংকট এখানেও থেমে ছিল না। পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও তৃণমূলের যে যুব নেতা দলের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়ে মূল সংগঠনকে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন, তিনিই এ বার বিজেপি-র প্রার্থী। এক কথায়, কোচবিহারের তৃণমূল ঘেঁটে রয়েছে। শাসক দলেরই অনেকের মতে, এই পরিস্থিতিতে দিদির ছবি সামনে রাখা ছাড়া উপায় কী? নইলে বাস্তব হল, পরেশকে নিয়ে তৃণমূলের জেলা স্তরে কোনও আবেগ নেই। দলের পুরনো নেতা, কর্মীরা তো উৎসাহ পাচ্ছেনই না, নতুনদেরও ঠেলে নামাতে হচ্ছে।
তৃণমূলের নেতারাই স্বীকার করছেন, কোচবিহার কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন সমস্যা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে ভুরি ভুরি। বড় সমস্যা ছিল, জেলা সংগঠনের মধ্যে থেকে গ্রহণযোগ্য কোনও নেতাকে প্রার্থী করা। মূলত সেই কারণেই যাদবপুরে মিমি চক্রবর্তী বা বসিরহাটে নুসরৎ জাহানদের প্রার্থী করা হয়েছে।
কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে, এখানেও শেষ নয়। বিজেপি তথা বিরোধীরা অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, ‘লোকসভা নির্বাচনে কেন ভোট দেবেন তৃণমূলকে? এটা তো পাড়ার ভোট নয়?’ তাঁদের বক্তব্য, এটা ঠিক যে সম্প্রতি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বিরোধী রাজনৈতিক চরিত্র হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছেন ঠিকই। কিন্তু সংসদে তৃণমূলের রাজনীতি বিশেষ ফারাক তৈরি করতে পারেনি। তৃণমূলের সাংসদদের মধ্যে অনেকেরই লোকসভায় উপস্থিত থাকা নিয়ে আগ্রহও দেখা যায়নি। অনেকেই কোনও বিতর্কে অংশ নেননি বা প্রশ্নও তোলেননি। কিংবা বাংলার জন্য কোনও প্রকল্প আদায় করে আনার ব্যাপারে তাঁদের লড়াইও বিশেষ দেখা যায়নি।
হতে পারে সেই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যই মমতা এও বোঝাতে চাইছেন, কলকাতায় থাকলেও বাংলার হকের জন্য এখান থেকেই তিনি লড়াই করবেন। চেষ্টা করবেন, যাতে বাংলায় জনগণের সরকার তৈরি হয়।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। সব ফর্মুলা কি বারবার খাটে? বিধানসভা আর লোকসভার ভোটটাও তো এক নয়!