কাশি থাকলে মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করুন

ডিসেম্বরে ২০১৯-এ চীনের উহান প্রদেশের মাংসের বাজারে নতুন করোনাভাইরাসের আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে যে দুটো তত্ত্ব রয়েছে, তার প্রথমটি হলো : এটি প্রাণীদেহে অন্যান্য ভাইরাসের সঙ্গে জিনগত সংমিশ্রণের ফলে উদ্ভূত নতুন প্রজাতির এক ভাইরাস, যা মানুষের দেহেও বংশবিস্তার করতে পারে (এমন ঘটনা প্রাণীদেহে হামেশাই ঘটছে, কিন্তু উৎপন্ন বহু প্রজাতির মধ্যে হাতে গোনা যে কটি ভাইরাস প্রাণী ও মানবদেহে দু’ জায়গাতেই বংশবিস্তার করতে পারে, তারাই অসুখের উৎপত্তি করে)।

দ্বিতীয় তত্ত্বটি হলো : এই ভাইরাস চীন তার উহান প্রদেশে অবস্থিত জৈবাস্ত্র গবেষণাগারে জিনগত গবেষণায় তৈরি করেছে। এবং কোনও কারণে এটি বাইরে বেরিয়ে পড়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। রোগটি চীন ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ায় গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে প্যানডেমিক বা বিশ্ব-মহামারী ঘোষণা করেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ অসুখ সম্পর্কে আলোচিত বহু প্রশ্নের একটি হচ্ছে : ব্যক্তিগত স্তরে এর হাত থেকে বাঁচতে গেলে যা যা করণীয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মাস্ক’ বা মুখোশের ব্যবহার। এই ‘মাস্ক’ কীভাবে কাজ করে? কারা পরবে, আর কাকে কতটা সুরক্ষা দেবে?

করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এখনও সবকিছু জানা না গেলেও যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে এটা হাঁচি-কাশির সঙ্গে নির্গত জলকণার মধ্যে থাকে। সেই জলকণা ছড়ানো বন্ধ করতে পারে মাস্ক। ওই জলকণা অন্য কেউ সরাসরি নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিলে বা তার চোখে-মুখে পড়লে কিংবা তা পারিপার্শ্বিক জিনিসপত্রে পড়ার পর সেখানে হাত লাগালে সেই হাত চোখে বা মুখে লেগে দেহে সংক্রমণ আসতে পারে। ওই জলকণা বাতাসে শুকিয়ে গেলে সেই খোলা ভাইরাস কতটা দূরে গিয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে তা এখনও জানা যায়নি।

মাস্কে একটা ফিল্টার বা ছাঁকনি থাকে, যা রোগ-জীবাণু সংবলিত হাঁচি-কাশির জলকণা আটকে দেয়। ওই ছাঁকনি তৈরি হয় বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো এক ধরনের প্লাস্টিক শিট থেকে। বলা হচ্ছে ছাঁকনি– যদিও কেটলির চা যে পদ্ধতিতে ছাঁকা হয় মাস্কের ছাঁকার পদ্ধতি তার থেকে আলাদা। ছাঁকনি’র ফেব্রিকের স্তরে যে ছিদ্রগুলো রয়েছে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংবলিত জলকণা তার থেকে আকারে বড়ো হলেও ওই ছিদ্রে আটকে যায়। কারণ ওই ছাঁকনিতে একটা স্থির-বিদ্যুতের চার্জ দেওয়া থাকে এবং সেই চার্জ জীবাণুদেহের বিপরীত চার্জের জন্য তাকে ছাঁকনির গায়ে আটকে ফেলে। কতটা আটকায়, তা দিয়ে ওই মাস্কের কার্যকারিতার হিসেব হয়। মাস্কের কার্যকারিতার আর একটা নিয়ামকও রয়েছে; তা হলো মাস্ক এবং ব্যক্তির মুখের চামড়ার মধ্যে ফাঁক। ওই ফাক সাধারণত থাকে নাকের দু’পাশে এবং কম-বেশি অন্যত্রও। ওই ফাক দিয়ে সংক্রমণ হতেই পারে; তাতেমাস্কের কার্যকারিতাও কমে যায়। কিন্তু নির্মাণের কৌশলে মাস্ক রোগ প্রতিরোধে প্রায় ১০০ শতাংশ কার্যকরী হতে পারে।

বাজারে মোটামুটিভাবে তিন রকমের মাস্ক পাওয়া যয় :সার্জিক্যাল মাস্ক, এন-৯৫ বা ওই জাতীয় মাস্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক মাস্ক। সার্জিক্যাল মাস্ক (ভেতর দিকে সাদা, আর বাইরের দিকে নীল বা সবুজ)-এর তিনটে স্তর; মাঝের স্তরে থাকে ওই বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো ছাঁকনি’। সার্জিক্যাল মাস্কের ব্যবহার হয় ব্যবহারকারীর শরীর থেকে হাঁচি-কাশির জলকণা ও রোগজীবাণু যাতে বাইরে না ছড়ায় তা নিশ্চিত করতে। শল্যচিকিৎসক যখন অপারেশন করেন, তিনি এবং তার সঙ্গের অন্যান্যরা রুগির সুরক্ষার জন্যই মাস্ক পরেন।

সার্জিক্যাল মাস্ক ছাড়াও দ্বিতীয় যেসব মাস্ক রয়েছে তা হচ্ছে :এন-৯৫, এন-৯৭,এন-৯৯, এন-১০০ ইত্যাদি; এই মাস্কগুলোর নামে যে সংখ্যাটা রয়েছে, তাতে বাতাসে অবস্থিত বিভিন্ন কণার কত শতাংশ ওই মাস্কটি ফিল্টার করে বা ঘেঁকে আটকে দেবে তা বোঝায়। এগুলো ভাইরাস আটকাতে সক্ষম। এগুলোকে আসলে মাস্ক না বলে রেসপিরেটর’বলা হয়। মাস্ক আর রেসপিরেটরের মূল পার্থক্য হচ্ছে মাস্ক যিনি পরবেন তার হাঁচি-কাশির সংক্রমণ বাইরে ছড়াবে না; আর রেসপিরেটর যিনি পরবেন তিনি বাতাসে ঘুরে বেড়ানো ভাইরাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিয়ে নিজে সংক্রামিত হবেন না। বলাই বাহুল্য, ওই রেসপিরেটরগুলোর কোনোটাই খুব সহজলভ্য নয়, সবগুলোই দামি, ব্যবহারকারীর মুখে এগুলো খুব আঁটোসাটো হয়ে সেঁটে বসার ব্যবস্থা করা হয়। এবং প্রত্যেকের মুখের গড়ন আলাদা হয় বলে একটি মাস্ক একজনই ব্যবহার করতে পারেন। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ওগুলো শুধুমাত্র ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্যই সুপারিশ করেন, যাঁরা এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তার চিকিৎসা ও শুশ্রুষা করছেন। ওগুলো সাধারণ মানুষের জন্য নয়।

তৃতীয় ধরনের অর্থাৎ বাজারের অন্যান্য বাণিজ্যিক মাস্কগুলো এই সময়ে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে এবং মানুষ সেগুলো হই হই করে কিনে চলেছেন। সেগুলো কতটা সুচারু পদ্ধতিতে তৈরি ? প্রশ্নটি অত্যন্ত বড়ো প্রশ্ন এবং ব্যবসায়ীরা এই বর্তমান পরিস্থিতির ফায়দা তুলবেন কিনা, সেটা মাথায় রেখেই। বাজারে অনেক রকমের ফেব্রিক (কাপড় ও প্লাস্টিক) পাওয়া যায়; বেশিরভাগই (যেমন রুমাল) ভাঁজ করে নাকে চাপা দিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস করা চলে। (অর্থাৎ ওই ফেব্রিকে ছিদ্র যথেষ্ট বড়ো)। আবার এমন ফেব্রিকও বিশেষভাবে তৈরি করা যায় যার ভেতর দিয়ে ওই রকমভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আদান-প্রদান দৃশ্যতই করা যায় না। সাধারণ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যে বাণিজ্যিক মাস্কগুলো বিক্রি হয় সেগুলোতে ঠিক কী ধরনের ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়েছে সেই ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায় এবং কাজে কাজেই, তাদের কার্যকারিতাও প্রশ্নাতীত নয়। এগুলোর কার্যকারিতা কমবার আর একটা কারণ মাস্ক এবং মুখের চামড়ার মধ্যে ফাঁকও।

মাস্ক কারা ব্যবহার করবেন? আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা একমত যে, মাস্ক তাঁদেরই ব্যবহার করা উচিত, যাঁদের সর্দি-কাশি হয়েছে, অর্থাৎ যাঁরা হাঁচছেন বা কাশছেন। মাস্ক পরলে তাদের হাঁচি-কাশির সঙ্গে নির্গত জলকণা-পরিবৃত জীবাণু বাতাসে ছড়াবে অনেকটাই কম, অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়াবে কম। তবে কি যাঁরা অসুস্থ নন, অর্থাৎ যাঁদের হাঁচি-কাশি নেই, তারা মাস্ক পরবেন না? না, প্রয়োজন নেই; মাস্ক পরলে তাদের মনে একটা ‘আমি সুরক্ষিত’ ভাব আসতে পারে, যা সঠিক নয়, কেননা অন্যের হাঁচি-কাশি তাদের জামাকাপড়ে পড়ে সেগুলো থেকে তার হাতে এবং হাত থেকে চোখে সংক্রমণ পৌঁছে দিতে পারে। এই মুহূর্তে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে মাস্ক কিনছেন, ফলে বাজারে মাস্কের আকাল দেখা দিয়েছে বা অচিরেই দেবে। মাস্ক পরার দরকার হলে এবং পাওয়া না গেলে বাড়িতে কাগজ বা রুমাল একাধিক স্তরে ভাজ করে মাস্ক বানিয়ে নিন। আর রেসপিরেটরের সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে, ওগুলো ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী বা আক্রান্ত রুগির পরিচর্যাকারীর জন্য।

সুস্থ মানুষ মাস্ক না পরলেও তারা সবার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন, বিশেষত যাঁরা হাঁচছেন বা কাশছেন তাদের থেকে। এই দূরত্ব কতটা? গবেষণায় দেখা গেছে যে, হাঁচি বা কাশির ফলে নির্গত জলকণা সর্বাধিক ছয় মিটার (১৮ ফিট!) অবধি ছড়াতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দু’এক মিটারের বেশি যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কমপক্ষে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলেছেন। বলাই বাহুল্য, যত বেশি দূরত্ব বজায় রাখা যায়, সুরক্ষা ততই বেশি। আর এছাড়া ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং বিশেষত ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান মেখে হাত ধোওয়ার ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু এই করোনা ভাইরাস হাঁচি-কাশির সঙ্গে নির্গত জলকণার ভেতরে থাকে, ওই জলকণা যেখানে পড়বে, সেখানে আপনার হাত লাগলে আপনার হাতে এসে যাবে ওই ভাইরাস, আর তারপর আপনি নিজেকে সংক্রামিত বা আশেপাশের অন্যান্য নির্জীব বস্তুকে সংক্রামক করে ফেলতে পারেন। সেই কারণেই বারবার ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান মেখে হাত ধুতে বলা হচ্ছে। জল ব্যবহার করার অবস্থা না থাকলে হাতে অ্যালকোহল-যুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতেও বলা হচ্ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সত্যিই কোনও বিকল্প নেই। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প সেই কারণেই দেশের সর্বকলের সবচেয়ে জরুরি প্রকল্পগুলোর একটি।

ডাঃ উচ্ছল কুমার ভদ্র

(লেখক বেলেঘাটার সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং পরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.