করোনা মহামারীর উৎস খুঁজতে গিয়ে করোনা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে ভারতের বামপন্থীদের একটা অংশ প্রত্যক্ষভাবে ও অন্যান্যরা প্রচ্ছন্নভাবে নিজের দেশের কেন্দ্র সরকারকে ভিত্তিহীন দোষারোপ ছাড়াও যেটা ক্রমাগত চালিয়ে গেছে, তা হল চীনের ধামাধরার কাজ। চীনের জীবাণু যুদ্ধকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক মহামারী বা বড়ো জোর চৈনিক খাদ্যাভ্যাস জনিত দুর্ঘটনা, তথ্য গোপন করে সারা গ্রহে ইচ্ছাকৃত সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়াকে জানুয়ারির শুরুতেই বিশ্বকে অবহিত করার গল্প দিয়ে আড়াল, আর এখন বিশ্বজুড়ে মেডিকেল কিট সরবরাহের বাণিজ্যকে মানবতার প্রতীক বানিয়ে আক্ষরিক অর্থেই লাল ঝাণ্ডার দেশটির যাবতীয় কালো অপকর্মের ওপর ধামা চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
একই সঙ্গে দিল্লীতে যাদের ইচ্ছাকৃত সমাবেশ, অসহযোগিতা ও অসভ্যতার জন্য সারা ভারতে করোনার সংক্রমণ হুহু করে বেড়ে গেছে, তাদের হয়েও ক্রমাগত সত্য অস্বীকার, অসত্য প্রচার, কুযুক্তি, নকল ছবি ভিডিও ইত্যাদির মাধ্যমে ওকালতিও করে চলেছে পুরোদ্যমে। কারণ ঐ সমাবেশকারীরাই চৈনিক জীবাণু অস্ত্রের প্রধান অস্ত্রাগার। তাই সংখ্যাগুরু মানুষকে ক্রম বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়ে সংখ্যালঘু তকমার আড়ালে একটি সন্ত্রাসী সম্প্রদায়ের একচেটিয়া সংখ্যাগুরুত্ব লাভের উচ্চাশাকে ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছে। ‘ইয়ে আজ়াদি ঝুটা হ্যায়‘ স্লোগান তোলা মানুষগুলো দেশের সর্বত্র অবাঞ্ছিত পরিত্যক্ত হওয়ার পর প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছে আজ়াদির নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদে হাওয়া দেওয়াকে।
এরই মধ্যে অত্যুৎসাহী কেউ আবার নিজের পোস্টে চাড্ডি সরকারকে তুলোধোনা করতে গিয়ে লিখে ফেলেছে, চীন ২৫ বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আজ দাদাগিরি করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। এতদিন আমেরিকার দাদাগিরি সহ্য করল সবাই, এখন চীনের দাদাগিরিতে বুক (সে ভাষায় অন্য কিছু) ফাটছে কেন? তখনই মনে হয়েছিল চীনের দাদাগিরি করার সুদীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পর্কে ভারতীয় বামপন্থীরা অনেকেই অবগত এবং হয়তো বা অংশীদারও। দুই, এরা মানছে চীন সত্যিই এই আন্তর্জাতিক মহামারীতে উপকৃত হয়েছে। আর তিন, চীনের দাদাগিরিতে এরা যারপরনাই খুশি। আমেরিকাকে জব্দ করা গেছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী বা এদের পরিভাষায় ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিপাকে ফেলা গেছে। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ ঘোষণাটি বাস্তবায়নের সুযোগ হিসাবে এখন মারণ চীনা ভাইরাসকেই হাতিয়ার হিসাবে পাওয়া গেছে। সেই হাতিয়ার দিয়ে “ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে ঈনশাল্লা…” অঙ্গীকারও পালন করে দেশটাকে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে তার রিমোট কন্ট্রোল চীনের হাতে তুলে দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগও চলে এসেছে।
নিজের অনুমানের সত্যতা এত তাড়াতাড়ি যাচাই হয়ে যাবে, সেটা নিজেও কল্পনা করিনি। করোনার কারণে যে বিশ্বের প্রায় সব দেশের শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে ও সেই সুযোগে চীন জলের দরে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে নিয়ে মালিকানা হাতানোর চেষ্টা করছে, সে খবর তো এর মধ্যে বাসী। বস্তুত কোভিড-১৯ ভাইরাস যে চীনের জৈব হাতিয়ার সেই সন্দেহের অন্যতম কারণই হল দেশে দেশে চীনের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের থাবা বিস্তার। সুতরাং চীনের আগ্রাসী থাবায় কিছু ভারতীয় কোম্পানিরও মাংস খুবলে যেতে পারে, সেই আশঙ্কা ছিলই। তাই ভারতীয় গৃহঋণ সংস্থা HDFC-র ১.১% শেয়ার চীনের People’s Bank of China (PBoC) কিনে নেওয়ায় ধাক্কা খেলেও আশ্চর্য হইনি। তবে অবাক লাগল জনৈক ভারতীয় কমিউনিস্টের এই খবরটির সূত্র বেশ সগর্বে মুখপুস্তিকায় পোস্ট করা দেখে। এখনও পর্যন্ত একজন কমি দাদাকেই এই প্রচ্ছন্ন উল্লাস প্রকাশ করতে দেখেছি। তবে চিন্তা নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেয়াল হুক্কাহুয়া, আচ্ছা হুয়া শুরু করল বলে। দেশবাসীর এত বড় সর্বনাশ করেও এরা তাদেরই পরিশ্রমের ফসলে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে, বাতেলা ঝাড়ে, দেশের পরিবেশ কলুষিত করেও দিব্যি বাতাসে শ্বাস নেয়, মানুষের এত ঘৃণা অভিশাপ হজম করেও এরা নির্লজ্জের মতো বেঁচেও থাকে।
যাইহোক, ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্চের দুই স্তম্ভ সেনসেক্স ও নিফটি করোনার কারণে লকডাউনের ফলে গত মাস খানেক ধরেই ভালুকের গুহায় ঝিমোচ্ছে। নিফটি ২০ জানুয়ারির তুলনায় ৩০% পড়ে যায় মার্চের শেষে। আর ভারতের সর্ববৃহৎ গৃহঋণ সংস্থা HDFC ব্যাংকের শেয়ার এমনিতেই রিয়েল এস্টেট বা আবাসন শিল্পে মন্দার কারণে ২০১৯-২০-র শেষ কোয়ার্টরে ক্রমাগত পতনশীল ছিলই, তার ওপর করোনাতঙ্কে আরও বেহাল দশা। ১৪ জানুয়ারি শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম ২৪৯৯.৬৫ টাকার তুলনায় গত সিকি বর্ষে প্রায় ৩২ শতাংশ পড়ে ১০ই এপ্রিল তার দাম দাঁড়ায় ১৭০১.৯৫ টাকা। মাঝখানে দাম প্রায় ৪০% পড়ে ১৪৭৩ টাকা পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। যদিও ভারত সরকার ওষুধ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় ভারতের একাধিক ফার্মাসিউটিকল কোম্পানি আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন সরবাহের বরাত পাওয়ার আনন্দে ৯ এপ্রিল বাজার অনেকটাই (Sensex 2476 points, Nifty 708 points) ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু এই ফাঁকে Moneycontrol-এর রিপোর্ট অনুযায়ী চীনের কেন্দ্রীয় বা সেন্ট্রাল ব্যাংক People’s Bank of China (PBoC) ১.১% শেয়ার অর্থাৎ ১.৭৫ কোটি শেয়ার কিনে ফেলেছে। অবশ্য স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যানুসারে চীনের কেনা মোট শেয়ারের সংখ্যা ১,৭৪,৯২,৯০৯ বা ১.০১%। বিশেষজ্ঞদের অনুমান কাজটা জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে করা হয়েছে, তবে বিষয়টা সামনে এসেছে ১২ এপ্রিল স্টক এক্সচেঞ্জ (BSE) সংস্থাটির শেয়ার হোল্ডিং খতিয়ে দেখার পর। প্রসঙ্গত চীনের People’s Bank of China চীনের আর্থিক নীতি নির্ধারণ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা নেয় এবং চীনের তুলনায় কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তার টিকি বাঁধা আছে স্টেট কাউন্সিলে; অর্থাৎ সরকারের অর্থমন্ত্রকের মুখপত্রের ভূমিকাই বলা যায়। সোজা কথায় এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা শেয়ার কেনার মানে কার্যত চীনা সরকার দ্বারাই শেয়ার দখল।
এখন যে কোনও সংস্থার শেয়ারই বাজারে কেনাবেচা চলে। HDFC ব্যাংকে ভারতীয় জীবন বীমা সংস্থার (LIC) ৪.৬৭% শেয়ার আছে। শেয়ার আছে সাধারণ জনগণের হাতেও। এইচডিএফসি-র চেয়ারম্যান কেকী মিস্ত্রী সংবাদ সংস্থাগুলোকে জানিয়েছেন, People’s Bank of China-র আগে থেকেই HDFC-র শেয়ার ছিল। গত এক বছর ধরে চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংক তা বাড়িয়ে চলেছে। ২০১৯-এর মার্চে যা ছিল .৮%, ২০২০-র মার্চে তা ১.১%-এ এসে দাঁড়ায়। এখন কোনও সংস্থার ১ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকলে হোল্ডারের কোম্পানি নিয়ন্ত্রণের এক্তিয়ার জন্মায়। এই ১%কে Regulatory Threshold বলে। তবে সংস্থার চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার দীপক পারেখের মতে এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। যে কোনও দেশেরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সম্পদ বাড়ানোর জন্য এভাবে শেয়ার কিনেই থাকে। সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় ব্যাংক Saudi Arabian Monetary Authority (SAMA)ও সে দেশের সার্বভৌম সম্পদ ভাণ্ডার (sovereign wealth fund)-এর তরফে HDFC-র .৭% কিনে রেখেছে। ১%-এর কম বলে তার নামটা আলোচিত হয়নি। তিনি জানিয়েছেন তাঁর সংস্থায় ইতিমধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ ৭০.৮৮% যার মধ্যে ৩.২৩% শেয়ার আছে সিঙ্গাপুর সরকারের। সুতরাং এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা বা ষড়যন্ত্রর কিছু নেই।
এই ১%-এর নিয়ন্ত্রক সীমা (Regulatory Threshold) তো অন্যান্য কিছু বৈদেশিক সংস্থাও পার করেছে। তাহলে এই চীনের ১.১% নিয়ে এত হৈচৈ কেন? কেন, কারণ দেশটা চীন বলে। বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই চীন পাকিস্তান বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে বেশ আগ্রাসী ভঙ্গীতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো সংস্থাগুলিতে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার – এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্য ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় নেওয়া। সারা বিশ্বেরই নামকরা কোম্পানিগুলোতে নিজের অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইছে। BP Plc, Royal Dutch Shell Plc, ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস
কোম্পানি BG group ইত্যাদিতে চীনের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। ২০১৪-তে ইটালির Eurozone debt crisis-এর সময় ইটালির অধিকাংশ বড়ো কোম্পানিগুলোকে শেয়ার কিনে কব্জা করে ফেলে। আমাদের পড়শী দেশ পাকিস্তানের তো চেহারাই বদলে দিয়েছে। Financial Times-এর রিপোর্ট অনুযায়ী চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে গড়ে ওঠা China-Pakistan economic corridors খাতে চীন ৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে চীন। করাচি বন্দর চীনের দখলে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও যথেষ্ট চীনা আধিপত্য। এমনকি শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলিও কব্জা করার তালে। আর চীনের এই আগ্রাসী সাম্রাজ্য বিস্তারকেই ভয় পাচ্ছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা ও যথাসাধ্য প্রতিহত করতে চাইছে ভারত।
চালচিত্রে ইটালি:
চীনকে বন্ধু ভেবে আঁকড়ে থাকার কী পরিণতি হয় তার বিশদ ছবি এঁকেছেন Giacomino Nicolazzo তাঁর ITALY’S RECIPE FOR DISASTER প্রবন্ধে। ১২ই এপ্রিল ২০২০ পোস্ট করেন তিনি যখন করোনা ভাইরাস ইটালিকে শবাগারে পরিণত করেছে, যখন আর সামাজিক দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, তালাবন্ধ ইত্যাদি দ্বারাও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রাতারাতি ৭৪৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ৬ কোটি জনতা এখন লকডাউনে স্থবির। ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। ২০১৪ সালে ইটালিয়ান কমিউনিস্ট দল Partito Democratico-র নেতা ম্যাটিও রেনজ়ি (Matteo Renzi) যিনি ফ্লোরেন্সের প্রাক্তন মেয়রও ছিলেন, কোনওভাবে নির্বাচন জিতে ইটালির প্রধানমন্ত্রী হলেন। ভদ্রলোক এতটাই অতিবাম যে লেখকের ভাষায় “….he would make Barack Obama look like Barry Goldwater!” যেখানে বিশ্ব রাজনীতির চোখে বারাক ওবামা নিতান্ত উদারপন্থী ভদ্রলোক আর ব্যারি গোল্ডওয়াটার চরম রক্ষণশীল হিসাবে কুখ্যাত।
রেনজ়ি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সে দেশের অর্থনীতিতে কিছু বিচিত্র পটপরিবর্তন শুরু হল। ব্যাংকগুলো বসে যাচ্ছে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না, অবসর গ্রহণের বয়স বাড়ানো হল, পেনশন ফান্ড অদৃশ্য কিংবা না থাকার মতো। জাতীয় বিক্রয় কর যাকে ইটালিতে IVA (Value Added Tax) বলে তা ১৮% থেকে ২০% তারপর ২১% ও শেষে ২২% হয়ে গেল। অর্থনৈতিক এই মরণদশায় চীনারা ইটালির বিশেষ করে উত্তর দিকে জমি বাড়ি মানে রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য বাণিজ্যে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ শুরু করল। আর ইটালিয়ানরা বাড়িতে ব্যালকনি রাখলেও তার ছায়া রাস্তায় পড়ার জন্য ট্যাক্স দিতে বাধ্য হচ্ছে।
রেনজ়ি চীনাদের আর্থিক সংস্থা, টেলিকমিউনিকেশন, অন্যান্য শিল্প ও ফ্যাশন ক্ষেত্রে এলোপাতাড়ি বিনিয়োগ ও আধিপত্য দেখেও কিছু করলেন না। ইটালি ও চীন সরকারের মধ্যে কোনও একটা রফার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেল। কারণ চীনের এই কেনাকাটা ইটালির আইন কিংবা যুক্তরাজ্য (UK) ও যুক্তরাষ্ট্রের (US)-র সঙ্গে করা চুক্তির EU Trade Agreements-এর পরিপন্থী। পুরো ব্যাপারটাই ইটালির জনগণের কাছে সযত্নে গোপন রাখা হল। ইটালির ফ্যাশন রাজধানী লম্বার্ডি প্রদেশের মিলানো শহর চীনাদের গ্রাসে।
চীন ১০০ মিলিয়ন ইউরোর কম মূল্যের কোম্পানিগুলো মোট ৫ বিলিয়ান ইউরো (€) নিয়োগ দ্বারা আত্মসাৎ করতে লাগল। ২০১৬-য় যখন রেনজ়ি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন, ততদিনে চীনের বিনিয়োগ €৫২ বিলিয়ান ছাড়িয়ে গেছে। চীনের মালিকানায় ৩০০-র বেশি ইটালিয়ান কোম্পানি যা ও দেশের মোট শিল্প সংস্থার ২৭%। Bank of China বর্তমানে ইটালির ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের মালিক, যার নেপথ্যে পেনশন ফান্ড গায়েব হওয়ার যোগাযোগ স্পষ্ট। China Milano Equity Exchange খোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ করা অর্থ চীনের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যেতে লাগল বিপুল লাভ বগলদাবা করে।
ইটালির প্রধান টেলিকমিউনিকেশন সংস্থার মালিকানা হস্তগত করে সেগ্রেট (Segrate) শহরে চীনা Huawei কোম্পানি মাইক্রোওয়েব গবেষণাগার খুলে বিপজ্জনক 5G ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে ফেলল। বড় বড় অটোমোবাইল কোম্পানি Fiat-Chrysler, Prysmian ও Terna – এদের লভ্যাংশ বর্তমানে চীনেই চলে যায়। এমনকি ইওরোপের বৃহত্তম নির্মাণ সংস্থা Ferretti Yachts আর Ferretti পরিবারের হাতে নেই। ইটালির বিখ্যাত ফ্যাশন শিল্প চলছে চীনা কারিগরদের দক্ষিণা ও চীন সরকারকে লাভ দিয়েই। Pinco Pallino, Miss Sixty, Sergio Tacchini, Roberta di Camerino ও Mariella Burani এই ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর ১০০ শতাংশ মালিকানা এখন চীনের। Renzi সরকার চীনকে শুধু অবাধ বাণিজ্য করার সুবিধা নয়, কাস্টমস্ চেকিং থেকেও পুরোপুরি ছাড় দিয়ে রেখেছিল। এর ফলে কম করে ১০ হাজার চীনা মিলানো শহরে অবৈধভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়ে গেল। অর্থ প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেট গোপনীয়তাও চীনে পাচার হতে থাকল। সস্তায় শ্রমদান করে শ্রমের বাজারটাই চীনারা হাতিয়ে নিল, বিশেষত পোশাক তৈরির কারখানাগুলো। তালিকা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। শুধু মজার ব্যাপার বলি, অধিকাংশ পণ্যই বিশেষত পোশাক ও সৌখিন দ্রব্য দিব্যি ‘মেড ইন ইটালি’ ছাপ দিয়েই বিক্রিবাটা চলছে; কিন্তু লাভের গুড় চলে যাচ্ছে চীনে।
শুধু তাই নয়, ২০১৫-য় ভয়াবহ ভূমিকম্পে রোমের পাহাড়ি অঞ্চল বিধ্বস্ত হলে সারা বিশ্ব থেকে প্রচুর ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ইটালির কমিউনিস্ট সরকারের ফরমানে কোনও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা চিকিৎসালয়কে সরাসরি ত্রাণ দেওয়া যাবে না, ব্যক্তিগত অনুদান হলেও নয়; সবটাই তুলে দিতে হবে ইটালি সরকারের হাতে। বিপুল সেই অর্থের এক কানাকড়িও নাকি দুর্গতদের কাছে পৌঁছয়নি, Renzi সরকার পুরোটাই ব্যবহার করেছিল শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীদের জন্য!! আর্থিক এই ভয়াবহ মন্দায় বেকারত্ব যখন চরমে, তখন চিকিৎসা ক্ষেত্র থেকে সরকারি বিনিয়োগ সরিয়ে নিশ্চিত রোজগার (guaranteed income) যোজনায় ঢালা হল, যাতে কেউ কাজ করুক বা না করুক প্রয়োজন ও বিলাসিতার জন্য অর্থাভাব হবে না। তরুণ প্রজন্মকে উচ্ছন্নে পাঠানোর এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?
এখম মনে হচ্ছে না কি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সেই “ঐতিহাসিক ভুল” না করে জ্যোতি বসুকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে দিলে ভারতবর্যও ইটালির মতো চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত হত? আর মিল পাচ্ছেন ভারতীয় বামেদের অনুপ্রবেশকারী দরদের সাথে? অনুপ্রবেশে বাঁধ দিয়ে নিপীড়ত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মানবিক আইনের বিরোধিতা করার নামে তুলকামাল দিয়েই কিন্তু বামেদের হায়নাবৃত্তি শুরু হয়েছিল।
Lega Nord part-র নেতা ম্যাটিও সালভিনি (Matteo Salvini) ক্ষমতায় আসার পর সর্বাগ্রে শ্রম আইন অমান্য করা বেআইনি ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ করা শুরু করলেন আর অবৈধ অনুপ্রবেশে রাশ টেনে বিদেশীদের যথাস্থানে ফেরত পাঠানো শুরু করলেন। কিন্তু সালভিনি টিঁকে থাকতে পারলেন না। ইটালি সমাজবাদী দেশ, কমিউনিজ়ম তার জাতীয় ডিএনএ-তে। সালভিনিকে সরিয়ে ক্ষমতায় এলেন গুসেপি কন্টে (Giuseppe Conte)। আর এসেই সব বিধি নিষেধ শিথিল করে চীন তো বটেই, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার শত সহস্র অবৈধ শরণার্থীর জন্যও দরজা হাট করে দিলেন। ফলে চীন বিশেষত উহান শহর থেকে হাজার হাজার চীনা মিলানো শহরে ঘাঁটি গাড়তে লাগল। তার পর ডিসেম্বর ২০১৯ থেকেই করোনা ভাইরাসের ইটালিতে শুভ মহরত।
চিকিৎসকদের এর উৎস নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু ইটালির বামপন্থী নেতাদের ‘চীনাদের জড়িয়ে ধরো’, ‘আদর করো’, ‘কোনও ভয় নেই পার্টি করো’ জাতীয় প্রচারে গোটা দেশে রোগ মহামারীর চেহারা নিল। আর অসুখ দিয়ে হাসপাতাল ডাক্তারদের নাস্তানাবুদ করে, প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মীকে কবরে পাঠিয়ে এখন নিম্নমানের মেডিকেল কিট, ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি চীন থেকেই আমদানি করতে বাধ্য করিয়ে দেশটার বিশ্ব বিখ্যাত চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রটিও ক্রমশ মহাচীন দখল করে নিল। ব্যাস! ইটালির কিস্সা আপাতত খতম।
আশা করি ভারত থেকে চীনের কী প্রত্যাশা তা এই গল্পে পরিষ্কার। এর থেকে ভারতের অনেক কিছু শিক্ষনীয় আছে। বামপন্থীদের মতে নোট বাতিলের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে জিএসটি, একের পর এক ব্যাংক জালিয়াতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিলগ্নীকরণ ইত্যাদির মিলিত অভিঘাতেই ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার এমনিতেই কমতে কমতে সাড়ে চার শতাংশের আশে পাশে ঘুরছিল। তারা অবশ্য নিজেদের লাগাতার অসহযোগিতা, অপপ্রচার কিংবা দুর্নীতির সাল-সনের ব্যাপারটা কখনই উল্লেখ করে না। তাও এই অভিযোগের মধ্যে কিছুটা সত্যতা যে নেই তা নয়। নেতিবাচক বাম রাজনীতি ও তাদের দোসর ধ্বংসাত্মক ইসলামিক বেয়াদপিকে প্রশ্রয় না দিয়েও মাত্রাতিরিক্ত উদারীকরণের পথ বেয়ে বিশ্ব অর্থনীতির মূল স্রোতে ভাসতে গিয়ে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদে দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। দেশীয় সংস্থাগুলোর সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া হলে খাল কেটে চীনের মতো কুমীরকে ডেকে আনার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর যে আমেরিকা আজ ভারতের পাশে দাঁড়াচ্ছে নিজের স্বার্থে, এক সময় সেও কিন্তু অ্যানথ্রাক্স ভাইরাস ব্যবহার করেছিল প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাত দেওয়ার জন্য। সাম্রাজ্যের আকাঙ্খা রাশিয়ারও মরে গেছে ভাবার কোনও কারণ নেই। এই আর্থিক মন্দার আবহে কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে দেশজুড়ে লকডাউন বিশাল ধাক্কা দিয়ে যাবে। ধাক্কাটা কতখানি, সেটা টের পেতে অন্তত মাস ছয়েক লাগবে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, বৃদ্ধির হার আনুমানিক আরও ২ শতাংশ কমে যেতে পারে।
তবে এই সর্বনাশে বামপন্থীরা আদৌ দুঃখিত মনে হচ্ছে না। বরং সাম্প্রদায়িক গুণ্ডামিতে হাওয়া দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নিজেদের অনুমান যাকে পূর্বপরিকল্পিত বলাই যায়, তা মিলিয়ে দিতে প্রাণপণে ঝাঁপাবে। আর মুসলিমদের তো ওয়ান পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা – হিন্দু ও ভারতবর্ষের সমূহ সর্বনাশ! সারা বিশ্ব যেখানে চীনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে, জাপান চীনে নিজের উৎপাদন সংস্থাগুলো গুটিয়ে নিচ্ছে ২.২ বিলিয়ন ডলারের বিপুল ক্ষতিপূরণ দিয়েও, ব্রিটেন চীনের Huawei কোম্পানিকে 5G প্রযুক্তির জন্য সম্মতি দিয়েও পিছিয়ে গেছে, মার্কিন মুলুকও চাইছে মহামারী সামলে উঠেই চীনে নিজেদের সমস্ত বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে, সেখানে আমাদের দেশের কয়েক কোটি ম্যাটিও রেনজ়ির ভাব শিষ্য-শিষ্যারা নিজেদের উল্লাস যেন গোপন রাখতে পারছে না।
এতদিন যারা বিদেশী বিনিয়োগের পথ খুলে সংস্কার, বিলগ্নীকরণ, বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে মোদী দেশকে বিদেশীদের হাতে বেচে দিচ্ছে বলে গালাগাল করে এসেছে, তারাই দেশীয় কোম্পানি চীনের হাতে বিকিয়ে যাওয়ার সূত্রপাত দেখে উদ্বাহু হয়ে নাচছে। অর্থাৎ দেশ আমেরিকা বা ইওরোপীয় রাষ্ট্রের কাছে বিকোলে আপত্তি, কিন্তু চীনের কাছে নতজানু হলে আনন্দ! যদিও বিকিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। অন্যতম আর্থিক সংস্থা এইচডিএফসি ব্যাংকের মাত্র ১.০১% শেয়ার এখনই বড় কোনও ক্ষতি না করলেও, সিঁদুরে মেঘ দেখেও ভয় পাওয়ার কারণ যে একেবারে নেই তা নয়। কারণ দাবানলে বন কে বন উজাড় হওয়ার সূত্রপাত সামান্য স্ফুলিঙ্গই করে দেয়।
Reference links :
https://cms.frontpagemag.com/fpm/2020/04/italys-communist-recipe-disaster-frontpagemagcom
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়