জটার দেউল

এ মন্দির-বৃন্দ হেথা কে নির্মিল কবে ?

কোন জন ? কোন কালে? জিজ্ঞাসিব কারে?

কহ মোরে তুমি কল কল রবে,

ভুলে যদি, কল্লোলিনি, না থাকলো তারে।

এ দেউল-বর্গ গাঁথি উৎসর্গিল যবে

সে জন ,ভাবিল কি সে, মাতি অহঙ্কারে,

থাকিবে এ কীর্তি তার চিরদিন ভাবি,-

দীপরূপে আলো করি বিস্মৃত আঁধারে ?

বৈতল দেউল

যে কোন শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কলার মতই মন্দির ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলার জন্ম প্রকৃতি ও মনোভূমি থেকে। এক্ষেত্রে প্রকৃতিটি হলো ভারত তথা বঙ্গপ্রকৃতি এবং মনভূমি হলো ভারত তথা বঙ্গের মনোভূমি। বঙ্গের মেয়েদের ব্রতছড়ায় এই দুটি দিকের সহজ-স্বাভাবিক, আন্তরিক প্রকাশ আছে। তা এতই সহজ যে বোঝাই যায়না এর অন্তহীন গভীরতা;  এত স্বাভাবিক যে বীজ থেকে অঙ্কুর , শাখা হতে পত্র , অথবা ফুল থেকে ফল হওয়ার মতোই তা টের পাওয়া  যায় না।  এত আন্তরিক যে শ্বাস-প্রশ্বাসের মত তা স্তব্ধ হলে প্রাণটিই থাকেনা।
যেমন – পৃথিবী ব্রত,

“এসো পৃথিবী, বসো পদ্মপাতে,

তোমার পতি শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হাতে

তিনি বৈকুণ্ঠেশ্বর নারায়ণ, আজকে পূজব তার দু’চরণ

খাওয়াব ক্ষীর, মাখন, ননী যেন জন্মে জন্মে হই রাজার রাণী

নাওয়াবো দুধে মাখাব ঘি জন্মে জন্মে হব রাজার ঝি।।

অথবা , আছে ভাদুলি ব্রত : 

এ নদী সে নদী একখানে মুখ,

ভাদুলি ঠাকুরানী ঘুচাবেন দুখ

।এ নদী সে নদী একখানে মুখ,

দিবেন ভাদুলি তিন কুলে সুখ।

*******

নদী নদী কোথা যাও

 বাপ ভায়ে বার্তা দাও,

নদী নদী কোথা যাও 

শ্বশুর স্বামীর খবর দাও।


আর আছে বসুধারা ব্রত,


বট আছেন ,পাকুড় আছেন ,

তুলসী আছেন পাটে,

বসুধারা ব্রত করলাম তিন বৃক্ষের মাঝে।

মায়ের কুলে ফুল, শ্বশুর কুলে তারা,

তিন কুলে পড়বে জল গঙ্গার ধারা।

ইছাই ঘোষের দেউল

বাস্তু শাস্ত্র সমূহে বলা হয়েছে যে মন্দির হল ব্রহ্মাণ্ডের অনুকৃতি। মন্দিরের ইষ্টক বিন্যাস হল পৃথিবীর গর্ভধান।ব্রত ছড়াতে পৃথিবীকে শঙ্খ চক্র হাতে পদ্মপাতায় বসতে বলেন গ্রাম বাংলার পুরনারীগন। তাঁরা শাস্ত্র ব্যতীতই সেই সত্য প্রকাশ করলেন অন্তরের সহজ অনুভবে। 

বান্দা দেউল


ব্রত ছড়াগুলি পরিবেশ রক্ষায় মেয়েদের সদর্থক ভূমিকা তুলে ধরে নিঃসন্দেহে। মনে পড়ে যায় হালে আমাদের দেশের ‘চিপকো’ বা কেনিয়ার ‘সবুজ বন্ধনী’ আন্দোলনে মেয়েদের বিশেষ অবদানের কথা।  ব্রতের ছড়াগুলিতে যথেচ্ছ পাখি মারা, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার অতি জরুরি প্রসঙ্গও আছে। আর আছে প্রকৃতির মঙ্গলকামনার মধ্যে দিয়ে নিজের সংসারের মঙ্গলকামনা করার কথা।

দামোদর নদের প্রায় কোল ঘেঁষে আছে এক সুপ্রাচীন-ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং অপরিসীম প্রত্নতাত্বিক মূল্যের মন্দিররাজি। বর্তমানে চারটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের দেউল দাঁড়িয়ে আছে(আগে পাঁচটি ছিল), যার সমষ্টিগত নাম সিদ্ধেশ্বর মন্দির।

পুণ্যিপুকুর ব্রতমালাকে করে গো দুপুরবেলা
আমি সতী,লীলাবতীসাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী

আচার্য বরাহমিহির বৃহৎসংহিতায় বলেছেন , কেবল তিনি কেন সেই কোনো প্রাচীন ঋক্ বৈদিক যুগ থেকে মুনি ঋষিরা উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারণ করে গেছেন – 
ভূমি-মঙ্গলম / উদক-মঙ্গলম / অগ্নি-মঙ্গলম / ভ্যু-মঙ্গলম/ গগনা-মঙ্গলম / সূর্য- মঙ্গলম/ চন্দ্র  মঙ্গলম /  জগ-মঙ্গলম/ জীবন-মঙ্গলম / দেহা-মঙ্গলম /  মানো-মঙ্গলম /আত্মা-মঙ্গলম / সর্ব-মঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা সর্বমঙ্গলম ভবতুহ ভবতুহ ভবতুহ স্বাহা ভবতুহ ভবতুহ…..

বাহিরী জগন্নাথ বড়া দেউল

সকল বাস্তুশাস্ত্রে বলা হয়েছে , যেখানে নদী নেই, পুকুর নেই, বৃক্ষ নেই বা পুষ্পকানন নেই সেখানে দেবতারা থাকেন না। 


সন্ধ্যামণি কনকতারা 

সন্ধ্যামণি জলের ধারা।

এই ব্রত যে নারী করে ।

সাত ভায়ের বোন বলি তারে।

সাতদেউল


প্রকৃতিই মানুষ ও দেবতার মেলবন্ধন ঘটায়। এই সত্যানুভব প্রকাশ করতে গ্রাম বাংলার মা ,ঠাকুমাদের কোনো শাস্ত্র , কোনো গুরুভার তত্ত্বদর্শন দরকার হয় নি একেবারেই। বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে শিব ও শক্তি একাত্মক প্রকাশ – 
শিল শিলাটন,শিলে বাটন,শিল ঝরঝর ঝরে।
স্বর্গ হতে বলেন মহাদেব,গৌরি! কি ব্রত করে ?
নড়ে আশ,নড়ে পাশ,নড়ে সিংহাসন।
হরগৌরী কোলে করে গৌরী আরাধন।।’

দেউলঘাটা

বঙ্গের মেয়েদের ব্রতে শিবের মাথায় জল ঢালার সময় মেয়েরা এই ছড়াটি বলেন। বঙ্গের যে মেয়েরা ” হরগৌরী কোলে  করে গৌরী আরাধনা ” করেন তা কষ্ট করে শাস্ত্র পড়ে জানতে হয় নি। হর – হরি এই সুবিশাল ভারতের প্রতিটি সনাতনী গৃহে নিতান্তই পরিবারের আপনজন। তাই হরি নাড়ুগোপাল বা লাড্ডু গোপাল – একটু বেশি চন্দন মাখালেই ঠান্ডা লেগে যায় – 


হরি হরি বৈশাখ মাস ,

কোন শাস্ত্রে পড়লো মাস ?

চন্দনে ডুবু ডুবু হরির পা,

হরি বলেন মাগো মা

 আজ কেন আমার শীতল পা ?

Baidyapur Jora Deul

 
দেবতাকে এই ভাবে গৃহের একজন মনে করা , নিজের ঘরকে দেবতা এবং দেবতার ঘরকে নিজের মনে করাই বাংলার মন্দির স্থাপত্যের সার কথা ।

Terracotta Panels on the walls of Jora Shiva Deul at Moukhira Kalikapur in Purba Bardhaman district


মন্দির যে বাঙ্গালী তথা ভারতীয় সনাতনী সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ আছে বিভিন্ন ব্রত ছড়া গুলিতে। বাঙ্গালীর সংস্কৃতির একে বারে অন্দরমহলে প্রবেশ না করলে মেয়েলী ব্রতকথা ,ছড়া গুলিতে মন্দিরের উল্লেখ থাকত না।  কিছু উদাহরণ প্রদান করা যাক – 

সেঁজুতি_ব্রত ,
নাট মন্দির জোড় বাঙ্গাল

াদোরে হাতি ,বাইরে ঘোড়া।

দাসদাসী ,গো মহিষী

গির্দ্দে আসে পাশে

রূপ যৌবন সবাই সুখী

স্বামী ভালোবাসে।


দেউলপূজা_ব্রত,
আগদেউল পাছদেউল

 মধ্যে হইল চম্পা দেউল

চম্পা দেউলে হবে বাজা

মুই তার প্রিয় ভার্যা।

বটেশ্বর_পূজা
আসকৌটি বাসকৌটি

নিত্য পূজোং ঘর দেউটি

ঘর দেউটিক নমস্কার,

নিত্য আসুক ধানের ভার

Twin Temples, Kalikapur



নাট মন্দির ও জোড়বাংলা স্থাপত্য অধিকারীর আর্থিক স্বচ্ছলতা বোঝাত।দরজায় হাতি ঘোড়া শুধুমাত্র ধনী মানুষেরই থাকত । গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান এক সময় স্বচ্ছল পরিবারের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। সংসারে অনেক দাসদাসী থাকলে গিন্নী মহারাণীর ন্যায় থাকেন , তার আর কিছু বা করার থাকে না। নরম বিছানায় আরাম করে শুয়ে কেবল হুকুম করেন।এমন ধারা ঘর পাওয়া গ্রাম্য জীবনে মেয়েদের গভীর থেকে গভীরতম স্বপ্ন ছিল। নাট মন্দির , জোড়বাংলা যে এমন প্রাণের স্বপ্নেও স্থান করে নিল। এতেই উপলব্ধি করা যায় যে সাধারণ বঙ্গ জীবনে মন্দির , দেব দেউল গুলির ভূমিকা ছিল কত গুরুত্বপূর্ণ।

Bahulara Ancient Temple

 
দেউল বা নাগর দেউল উত্তর ভারতীয় মন্দিরকলার অতি সম্মানিত রূপ । সুদূর দক্ষিণ ব্যতীত ভারতের সর্বত্রই বক্ররেখা দেউল ভক্ত ও কলারসিক উভয়কেই মুগ্ধ করে। কিন্তু বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে শিব ও শক্তির একাত্মক প্রকাশ হিসাবে দেউল নিজেই ধ্যেয় এবং পূজ্য। দেউলপূজা ব্রত যেন আশ্চর্যজনক ভাবে সেই স্মৃতি বহন করছে। বিষয়টি আরোও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এই ব্রতের দেউল নির্মাণ পদ্ধতিটি লক্ষ্য করলে।

Deul at Bazarpara Illambazar

 
ডঃ শীলা বসাক এবং শম্ভু ভট্টাচার্য মহাশয়ের রচনা থেকে জানা যায় , দেউলপূজা ব্রতে প্রথমে দেউল নির্মাণ করে তার পূজা করতে হয় । চারটি মাটির ঢেলা চতুর্ভুজ আকারে এবং তার উপরে আরও চারিটি ও তার উপর দুটি মাটির ঢেলা রেখে মন্দিরের মতো দেউল নির্মাণ করতে হয়। দেউলের চতুর্ভুজ গর্ভগৃহ বৈদিক যজ্ঞবেদীর স্মারক, বক্র রেখ আকার বাঁশ খড়ের বৈদিক পটমন্ডপের – প্রথম চারটি মাটির ঢেলা হল বেড় ও তার উপরে দুটি মাটির ঢেলা হল গন্ডী এবং এই একই ভাবে বক্ররেখ শিখর দেউলের আদল পাওয়া গেল। বহুযুগ – লালিত একটি স্মৃতি এইভাবে গ্রামবাংলার ব্রতিনীদের মাধ্যেমে মূর্ত হল।
সংসারে যে ঘরে দেবীদেবতার নিত্য পূজা হয়, সেই গৃহই তো ঈশ্বরের গৃহ। সে ঘরের দীপ বা দেউটি ঈশ্বরে ঘরের আলোক, তাই ঘর দেউটি নমস্কার – ঘর ও মন্দির এককার হয়ে আছে সনাতনী বঙ্গ জীবনে।

Twin Temples, Kalikapur


©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ 
১. বাংলার ব্রত পার্বন : ডঃ শীলা বসাক 
২. পশ্চিমবঙ্গের মন্দির

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.