‘নববর্ষ এল আজি/ দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে…’, কবিগুরুর এই পংক্তি দু’টি এ বছর পয়লা বৈশাখে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও লকডাউন চলছে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে ভারতবর্ষ অবশ্যই জিতবে। তবে নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়ে আর দরিদ্রদের মুখের গ্রাসটুকু শেষ করে এই অভিশাপ কবে বিদায় নেবে সেটাই বড় প্রশ্ন।
আজ ১৪ এপ্রিল এই লকডাউন শেষ হওয়ার কথা ছিল। আজই পয়লা বৈশাখ। নতুন বছরের সকালে হল না প্রভাতফেরি, মন্দিরে পুজোর ডালা হাতে লম্বা লাইনও দেখা গেল না। দোকানে দোকানে এ বছর হবে না হালখাতা।
বাংলাদেশেও করোনা প্রকোপ বাড়ছে। তাই এ বছর বন্ধ থাকল মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের দিন নির্দিষ্ট। গ্রেগরিয়ান মানে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসাবে ১৪ এপ্রিল। এদিন সকালে ঢাকায় এক বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। ঢাক, ঢোল, কাঁসর-ঘণ্টা, বাংলার বাঘ, লক্ষ্মী প্যাঁচার মুখোশে একেবারে এলাহি ব্যাপার। এই সব দেখেশুনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রা ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। করোনা এবার ছিনিয়ে নিল মঙ্গল শোভাযাত্রার আনন্দও।

পারিবারিক সূত্রে আমিও ‘ঢাকার পোলা’। দেশভাগ না হলে এখনও হয়তো আমার বাড়ির ঠিকানা হত গ্যান্ডারিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ জিউয়ের মন্দিরের গলি। সূত্রাপুর থানার সামনেই যে লোহাপুল, যে লোহারপুলের উপর দিয়ে এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে যাওয়ার সময়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চিন্তায় তাঁর কালজয়ী ‘হয়তো’ গল্পের প্লট এসেছিল, সেই লোহারপুল পার হয়েই আমার বাবা, ঠাকুরদাদারা বাজার করতে যেতেন।
ঢাকার বাসায় থাকলে আজও হয়তো চৈত্র সংক্রান্তির দিনে স্নান করে ডান হাতে খইয়ের ছাতু আর বাম হাতে এক মুঠো ছাই নিয়ে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সামনের তিন মাথার মোড়ে যেতাম। পায়ের তলা দিয়ে বাম হাতের ছাইটা ছুড়ে আর ডান হাতের ছাতু হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলতাম— ‘শত্রু মুখে দিয়া ছাই/ ছাতু উড়াইয়া বাড়ি যাই’।
বাড়ি ফিরে সাত রকমের তেতো আর এঁচোড় দিয়ে মটরডাল খেতাম। একেবারে বাঁধা হিসেব। পরের দিন নতুন বছরে গোস্বামীদের লক্ষ্মীনারায়ণ জিউয়ের মন্দিরে সকাল থেকে পুজোর ভিড়। অনেকের বাড়িতেও গণেশ আর লক্ষ্ণীপুজোর ব্যবস্থা হত। ঢাকা শহরটা মূলত বৈষ্ণবপ্রধান শহর ছিল। সেদিন সব বাড়িতেই তুলসী গাছের উপর মাটির ভাঁড় ফুটো করে জলের ঝারি দেওয়ার নিয়ম ছিল। আর খাওয়াদাওয়া, একেবারে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সবকিছু। কিন্তু কোনও সর্বজনীন অনুষ্ঠান হত না।
ঢাকাতে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা হত। বুড়িগঙ্গায় দুর্গাপ্রতিমা আনা ও বিসর্জন দুটোই ঢাকঢোল পিটিয়ে হত। ঈদের দিন মস্ত মিছিল বের হত। কিন্তু পয়লা বৈশাখের কোনও শোভাযাত্রা ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র ও শিক্ষকরাই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে যখন সামরিক স্বৈরতন্ত্র চলছে তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাবনার আন্দোলন শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি তখন হুসেন মোহম্মদ এরশাদ। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষিত হল। মুক্তিযুদ্ধ, এত মানুষের বলিদান, মুক্তমনা দেশ, সংবিধান সব ব্যর্থ হয়ে যাবে? কিছুটা মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যই আয়োজন করা হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল সকালে কলাবিভাগের ছাত্ররা বানালেন কাগজের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।

৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সাল গণনা শুরু। গৌড়রাজ শশাঙ্ক তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণতে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। ভারতবর্ষ না থাকলে বাংলার না আছে গৌরব না আছে সুষমা। ভারতবর্ষের জাতীয় ক্যালেন্ডার শালিবাহন শক, পৃথিবীর অন্যতম বিজ্ঞানভিত্তিক প্রাচীন বর্ষপঞ্জি। বঙ্গাব্দ আদতে চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জি হলেও এর মূল ভিত্তি সূর্য সিদ্ধান্ত।
করোনার আতঙ্ক থেকে বের হয়ে উঠুক আশার দিন হয়ে উঠুক এই পয়লা বৈশাখ। কাজী নজরুল ইসলামের সেই মৃত্যুঞ্জয়ী কবিতা আজ বারবার মনে হচ্ছে— ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়’

ড. জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.