ঢাকায় গত বেশ কয়েক বৎসর ধরে শুরু হওয়া প্রতি ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখের মঙ্গল যাত্রার রেশ পশ্চিমবঙ্গেও পৌঁছে গেছে। এই যাত্রায় হরেক রকমের মুখোশ, প্ল্যাকার্ড ইত্যাদি নিয়ে, কেউ রংচং মেখে শোভাযাত্রা হয় ঢাকার রাজপথে। রাজপথে দেওয়া হয় আল্পনা। ব্যাপারটি ছড়িয়ে গেছে এখন বাংলাদেশের ছোটবড় অন্যান্য শহরেও। এমনিতে ভালোই, ইসলামী বাংলাদেশে বঙ্গসংস্কৃতির এমন প্রসারে খুশী হওয়াই উচিত। এটির সূচনাও হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উৎসাহে। বাংলাদেশের মুক্তমনা মানুষেরা এটাকে বড় জয় মনে করেন। ইসলামী কট্টরপন্থীরা এতে বড়ই ক্রুদ্ধ। ইসলামের হিজরী ক্যালেন্ডার থাকতে বাঙ্গলা ক্যালেন্ডারের নববর্ষ নিয়ে মাতামাতি কেনই বা তাদের সহ্য হবে? কিন্তু আমরাও একটু চিন্তিত। কারণ লক্ষ করবেন ওটা ‘পয়লা বৈশাখ’ নয় ‘পহেলা বৈশাখ’! পহেলা কি বাঙ্গলা শব্দ? আরো লক্ষ্য করবেন যে ওটা হয় প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল, অথচ বাঙ্গালী হিন্দুর পঞ্জিকায় সাধারণতঃ পয়লা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল। (এ বছর ২০২০ ইংরাজী সালে লিপ ইয়ার বলে ১লা বৈশাখ পড়েছে ১৪ এপ্রিল)। হিন্দু বাঙ্গালীর প্রায় দেড় হাজার বছরের ক্যালেন্ডারের অধিকার দাবী করে ইসলামী বাংলাদেশ অবলীলাক্রমে বাঙ্গলা ক্যালেন্ডারকেই পাল্টে দিয়েছে।
কিভাবে ১৪ই এপ্রিল পাকাপাকি ১লা বৈশাখ হলো? ১৯৬৬ সালে ঘোর পাকিস্তানী আমলে মহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি বাংলা ক্যালেন্ডারাকে আধুনিক করে গ্রেগরিয়ান (ইংরেজী) ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে বাংলা ক্যালেন্ডার পালটে দিলেন। ১৪ই এপ্রিল পাকাপাকি পয়লা বৈশাখ হল। পাকিস্তানী আমলে এটি চালু আর হয়নি। বাংলাদেশ হবার পর ১৯৮৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি এরসাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলেন আর এই নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করলেন। বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমানের কোন ধর্মীয় যোগাযোগ নেই, আজকাল সরকারী কাজেও চলে ইংরেজী ক্যালেন্ডার, শুধু চাষবাসের ঋতু বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দুর ধর্মীয় কাজকর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবন চলে বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে। সুতরাং বাংলাদেশের হিন্দুরা এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেননি। এইভাবে একেবারে বিংশ শতাব্দীর শেষে বাঙ্গালী হিন্দুর ক্যালেন্ডার ও নববর্যের দিনটি কেড়ে নিল ইসলামী বাংলাদেশ। নীরব রইলো সেকুলার পশ্চিমবঙ্গ।
শুধু তাই নয় কোন ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র ছাড়াই বঙ্গাব্দর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মোগল রাজ আকবরকে। তিনি নাকি বাঙ্গলায় ফসল আদায়ের সুবিধার জন্য এই বঙ্গাব্দ চালু করেন। আকবরপন্থীদের যুক্তি, খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর তারিখ-ই-ইলাহী নামে একটি সৌর বর্ষপঞ্জী চালু করেন। কিন্তু তার ভিত্তিবর্য ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, আকবরের শাসনকালের প্রথম বছর। ওদিকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৬৩ হিজরী। আকবরপন্থীদের মতে ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দকে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে তারিখ-ই-ইলাহীর সাথে সাথে বঙ্গাব্দও চালু করেন আকবর। অর্থাৎ বঙ্গাব্দ শুরু হয় তার ৯৬৩, ২৯ ও ৯৯১তম বর্ষ থেকে। আকবর হিজরী সাল পছন্দ করতেন না ফলে চালু করেন তারিখ-ই-ইলাহী, তবে তিনি কেন বঙ্গাব্দে হিজরীকে ঢোকাতে যাবেন? “আইন-ই-আকবরী’-তে ৩০ পাতা জুড়ে বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর কালানুক্রমিক বিবরণ রয়েছে। সব শেষে রয়েছে তারিখ-ই-ইলাহী। কিন্তু বঙ্গাব্দ বা ‘বাংলা সন’-এর কোনো উল্লেখ নেই। আকবর যদি সত্যিই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ প্রবর্তন করতেন, তাহলে আইন-ই-আকবরীতে তার উল্লেখ থাকবে না, একি সম্ভব? আকবরের অধীনে পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে বাঙ্গলা পর্যন্ত ১২টি সুবা ছিল কিন্তু কোথাও তিনি নতুন ক্যালেন্ডার না করে হঠাৎ বাঙ্গলায় কেন করতে যাবেন? তাছাড়া সেই সময় বাঙ্গলায় বারভূঁইয়াদের দাপট, তাদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে তখন আকবরের, ফলে বাঙ্গলার শস্য আদায়ের ক্যালেন্ডার তৈরী করছেন একেবারেই ইসলামী গপ্পো। মনে রাখতে হবে ক্যালেন্ডার তৈরীর সঙ্গে যুক্ত জ্যোতির্বিদ্যার ভারতীয় জ্ঞান দুহাজার বছরের পুরানো। ভারতীয় ক্যালেন্ডার তৈরী হয় সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে যা এখনও সমান মান্য। ভারতে ৫৭ খ্রীষ্টপূর্বকে বিক্রমাদিত্যর শাসনকালের শুরু ধরে বিক্রমাব্দ চালু ছিল, পরে চালু হয় শকাব্দ যা এখনো ভারতের সরকারী ভারতীয় ক্যালেন্ডার। এইসব ক্যালেন্ডারের পর বাঙ্গলার মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে আকবরের। আর এই আকবরী গপ্পে সাম্প্রতিক যিনি সবচেয়ে ইন্ধন যুগিয়েছেন তিনি কোন ঐতিহাসিক নন, এক সবজান্তা উদ্বাস্তু হিন্দু, যিনি কখনোই পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে কোন কথা বলেন না। এই আগমার্কা হিন্দু বিরোধী বঙ্গ সন্তানটি নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন। তিনি তাঁর বইয়ে ও বক্তৃতায় বেশ খোঁটা দিয়ে বলেছেন যে বাঙ্গালী পুরুতরা জানে না যে পঞ্জিকার দিন নিয়ে তাদের এত আচার বিচার তা তৈরী মুসলমান আকবরের। তাহলে বঙ্গাব্দের শুরু কিভাবে হল?
গত বেশ কয়েক দশক ধরে ইসলামপন্থী মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা ভারতের প্রকৃত ইতিহাসটাই সরস্বতী নদীর মতন প্রায় গায়েব করে দিচ্ছিল। সেজনা বাঙ্গালী ছাত্রছাত্রীরা জানেই না বাঙলার গৌরব গৌড় সম্রাট শশাঙ্কের নাম। জানে না সেই সাম্রাজ্যের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ রয়েছে মুর্শিদাবাদের কাছেই। কোন টুরিস্ট গাইডে এ নাম পাওয়া যাবে না। সম্রাট শশাঙ্ক বঙ্গাব্দ শুরু করেন তাঁর রাজত্বকালের শুরু ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দকে ভিত্তিবর্য ধরে। ২০২০ সালে সেজন্য ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। তার পাথুরে প্রমাণও রয়েছে। নীতীশ সেনগুপ্তর বই ‘দ্য ল্যান্ড অফ টু রিভার্স’-এ উল্লেখ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ডিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন টেরাকোটার শিব মন্দিরের। ওই মন্দির দুটির গায়ে বঙ্গাব্দের কথা খোদিত রয়েছে, যা আকবরের থেকেও প্রাচীন। এছাড়া অন্যান্য গবেষকরাও (মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, কুণাল চক্রবর্তী ইত্যাদি) একই কথা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানাতে একটি অস্ত্র যেমন মুসলমান অনুপ্রবেশ, আরেকটি অস্ত্র হলো বাঙ্গালী হিন্দুর ভাষা ও সংস্কৃতির ইসলামীকরণ। পশ্চিমবঙ্গকে ভারতীয় সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ করে রাখতে হলে পয়লা বৈশাখকে “পহেলা বৈশাখ’ হতে দেবেন না, শশাঙ্ক প্রবর্তিত বঙ্গাব্দকে কলুষিত হতে দেবেন না।
মোহিত রায়