অবশেষে সেই বন্দি বীর বান্দা সিং বাহাদুরকে ৯ ই জুন ১৭১৬ … লৌহ শৃঙ্খলিত করে দিল্লির দরবারে উপস্থিত করা হল…তখনও বান্দার চিত্ত ভয়শূন্য, বীরের ন্যায় উন্নত শির, মাথায় কেশরী পাগড়ি…হুঙ্কার দিলেন ” জয় গুরু জীর জয়..”ইতিমধ্যেই সাতশো তাজা শিখ নিজ ধর্ম ও কর্ম রক্ষার হেতু প্রাণ বলিদান করেছেন। বাকি আছে এক বন্দি বীর আর তাঁর কচি সন্তান অজয়…
সাত শত প্রাণ
নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি
বন্দার এক ছেলে।
কহিল, ‘ ইহারে বধিতে হইবে
নিজহাতে অবহেলে।’
দিল তার কোলে ফেলে
কিশোর কুমার, বাঁধা বাহু তার,
বন্দার এক ছেলে।
অজয়ের মৃত্যু নিয়ে দুরকম কথা প্রচলিত আছে। এক , বান্দা কে ছেলেকে ধর্মান্তর অথবা ছেলের মৃত্যু এই দুই পথ বাছতে বললে বান্দা মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেন। বুকের কাছে ছেলেকে টেনে নিয়ে নবীন রবির মত কচি মুখমন্ডল খানি দর্শন করে তিনি ছেলের দেহে ছুরিকাঘাত করেছিলেন।
তার পরে ধীরে কটিবাস হতে
ছুরিকা খসায়ে আনি
বালকের মুখ চাহি
‘ গুরুজির জয়’ কানে কানে কয়,
‘ রে পুত্র, ভয় নাহি।’
নবীন বদনে অভয় কিরণ
জ্বলি উঠি উৎসাহি –
কিশোর কণ্ঠে কাঁপে সভাতল
বালক উঠিল গাহি
‘ গুরুজির জয়! কিছু নাহি ভয় ‘
বন্দার মুখ চাহি।
অপর , একটি মত আছে যে , বান্দার ছেলেকে হত্যা করে তাই বুক চিরে হৃদপিন্ড বের করে বান্দার মুখে জোর করে পুরে দেওয়া হয়। আর তারপর কি হল?
বান্দাকে জল্লাদ নিয়ে গেল বধ্যভূমি তে… তার দুই চোখ উপরে নিল তপ্ত শালাকার আঘাতে, তারপর একটু একটু করে চামড়া তুলে নিল দেহ থেকে শয়তানের দল। অসীম ক্ষমতা শালী বান্দা সহ্য করলে সব…কেবল চিৎকার করে উঠে বলেছিল বার বার ” জয় গুরুজীর জয়…”
তাঁর অলৌকিক সহ্য শক্তি দেখে সভা হল নিস্তব্ধ…তবু নিজ ধর্ম থেকে তিনি এক পাও নড়লেন না… দগদগে ঘা , দগ্ধ দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তবু মান দিলেন না। এক বন্দির এত অহং কেমনে সয় বিজেতা? শির কেটে নেওয়ার হুকুম হল…বীর বান্দা সিং বাহাদুর ইতিহাসে অমর হয়ে দিলেন বেনীর সঙ্গে মাথা…
এই মহাসংগ্রামে র অধ্যায় আজ হতে প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে সমাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এই অধ্যায় মুঘলদের কবর খোদিত করেছিল।
বাবা বান্দা সিং বাহাদুরের আত্মবলিদান ছিল নজিরবিহীন। একদা বৈরাগী মানুষটি তাঁর গুরুর আদেশের প্রতি এতটাই সমর্পিত ছিলেন যে, তিনি কোনও অত্যাচার বা মৃত্যুকে ভয় পাননি।
বাবা বান্দা সিং বাহাদুরকে স্মরণের মাধ্যমে তাঁর বীরত্বের পাশাপাশি, ত্যাগ ও আত্মবলিদানের পাশাপাশি, একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন সমাজ সংস্কারক হিসাবে তাঁর কর্মপদ্ধতিকেও আমরা মনে রাখবো। সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন।
আমি বান্দা সিং বাহাদুরের অতুলনীয় প্রতিভা, অসীম সাহস এবং আত্মবলিদানকে শত শত প্রণাম জানাই।
শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিবে সংকলিত ভক্ত কবির দাসের ভাষায় বলি –
সুরা সো পেহেচানিয়ে, যো লড়ে দীন কে হেত।
পুর্জা-পুর্জা কর মরে, কবহু না ছোড়ে খেত।।
দুর্গেশনন্দিনী
।।সমাপ্ত।।