গল্প: স্বপ্নের ভারত

সত্যচরণ হাজরা, ভরতপুর কৃষ্ণভামিনী স্কুলের দাপুটে হেডমাস্টার। উনি ছাত্রদরদী এবং বেশ কড়া হাতে স্কুলের প্রশাসন সামলান। কোনও শিক্ষক বা ছাত্রছাত্রী দেরি করে এলে বা বেশ কদিন না জানিয়ে কামাই করলে প্রশ্নের জালে তিনি তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। এনাদের পূর্বপূরুষ এই স্কুলটি বহুদিন আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কাজেই এটার উপর ওনার প্রাণের একটা টান আছে। তল্লাটের সবাই হেডমাস্টারমশাইকে সমীহ করে চলে। প্রধানত ওনার কড়া নজরের জন্যই এই ইস্কুলের পড়াশোনার মান বেশ ভালো। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রতিবছর এই স্কুলের ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো ফল করে থাকে; দু’চারজন তো রাজ্যে  স্ট্যান্ড অবধি করেছে। এছাড়াও খেলাধূলা, কুইজ, ছবি আঁকা ইত্যাদিতেও এই স্কুলের খ্যাতি আছে। কীভাবে এই স্কুলের আরও উন্নতি করা যায়, প্রধান শিক্ষকের মনে সেই চিন্তাই ঘুরপাক খায়। ওনার স্ত্রী তো মজা করে ইস্কুলটাকে নিজের সতীন বলে ডাকেন। 

একদিন সকালে পেপার পড়তে গিয়ে একটা পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের উপর সত্যবাবুর চোখ পড়ল। ওতে লেখা ‘স্বপ্নের ভারত প্রকল্প’ বলে একটা প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে সারা ভারতের যে কোনো স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীতে  বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠরত  ছাত্রছাত্রী অংশ নিতে পারবে। কোনও স্কুল থেকে সর্বাধিক দুজন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। পরীক্ষায় সফল ছাত্রছাত্রীদের আমেরিকা এবং ইংলন্ডের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য খরচ বহন করা হবে। এই প্রকল্পটির পিছনে আছেন ডাঃ সুব্রত বক্সী বলে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীর প্রয়াস। বিশদ জানার জন্য একটি ওয়েবসাইট দেখতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞাপন পড়ে হেডমাস্টারমশায় মনে মনে  খুব উৎসাহী  হয়ে পড়লেন। স্কুলে তো মেধাবী ছাত্র রয়েছে, এবার তারা নিজেদের প্রতিভা দেখাবার সুযোগ সারা দেশের সামনে পাবে। উনি পেপারটা মুড়ে নিজের স্কুলের ব্যাগে রেখে দিলেন।

স্কুলে গিয়ে টফিনের বিরতিতে উনি টিচার্সরুমে গেলেন, তাঁকে দেখে অন্য শিক্ষকরা তটস্থ হয়ে গেলেন। উনি নিজের পকেট থেকে কাগজটা বার করে সহকর্মীদের দেখালেন। আজকাল দামী মোবাইল ফোন জলভাত হয়ে গেছে, ওনার সহকর্মীরা প্রায় সকলেই ওসব ব্যবহার করেন। ব্যাপারটা ওনার পছন্দ না হলেও আজ খুব কাজে দিল। 

কয়েক মিনিটের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের  শিক্ষক পুরো ব্যাপারটা ওয়েবসাইট ঘেঁটে হেডস্যারকে জানিয়ে দিলেন। ডাঃ সুব্রত বক্সী উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামের সন্তান, চরম দরিদ্রতার মধ্য থেকে উনি পড়াশোনা করেছেন, প্রথমে অঙ্ক এবং পরে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন। ওনার আবিষ্কৃত বক্সী ডিকোডিং আজ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে  গবেষকদের অবশ্যপাঠ্য। এখন উনি আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের  ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। নিজের কষ্টকর অতীত উনি ভোলেননি এবং তাই উনি প্রচুর অর্থ দিয়ে এই দেশে একটি ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন। উনি চান প্রতিবছর অন্তত পাঁচজন ছাত্রছাত্রীকে বিদেশের প্রখ্যাত শিক্ষায়তনে  পড়াবার সুযোগ করে দেওয়া হোক। সেজন্য যা খরচ তা ওই ট্রাস্ট অর্থাৎ ‘স্বপ্নের ভারত’ ট্রাস্ট বহন করবে। এভাবে উনি মাতৃভূমির কিছু ঋণ পরিশোধ করতে চান। 

তিনদিন ধরে পরীক্ষা নেওয়া হবে, পরীক্ষার সময় তিনঘণ্টা। প্রথমদিন নেওয়া হবে পদার্থবিদ্যা এবং অঙ্কের পরীক্ষা, দ্বিতীয়দিন কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজির উপর পরীক্ষা, আর শেষদিনে  সাধারণ জ্ঞান  ও বুদ্ধিমত্তার উপর পরীক্ষা নেওয়া হবে। স্কুলের মাধ্যমে ক্লাস টুয়েলভে পাঠরত সেরা দুজন ছাত্রের ছবি সহ বায়ডাটা পাঠাতে হবে, এবং ওই দুজন ছাত্রের ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ অবধি রেজাল্ট পাঠাতে হবে। অনলাইনে রেজিস্ট্রি করতে হবে এবং ঠিকঠাক তা হলে অ্যাডমিট কার্ড তৈরি হয়ে যাবে। তা ডাউনলোড  করে প্রধানশিক্ষকের শংসাপত্র সমেত হাজার টাকার  ড্রাফট ভরে দিল্লির এক ঠিকানায় পাঠাতে হবে। পরীক্ষা হবে দার্জিলিং শহরে এবং সেখানে আসা যাওয়া আর থাকা খাওয়ার খরচ প্রতিযোগীদেরই বহন করতে হবে। সরকার সরাসরি এই প্রকল্পের সাথে না থাকলেও সরকারি খরচে পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থাটি সম্পন্ন হবে। প্রতিভা অন্বেষণের এই পরীক্ষায় সরকারি সংরক্ষণের নিয়ম মেনে কোটা থাকবে। সফল পরীক্ষার্থীরা যেন আগের থেকে পাসপোর্ট করে রাখে ইত্যাদি।

ব্যপারটা বুঝে হেডস্যারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এবার যে দুজন ক্লাস টুয়েলভের সেরা ছাত্র তাদের নাম শিবরাম মুখোপাধ্যায় আর সাগেন মান্ডি। দুজনাই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। গোপালপুরেই পাশাপাশি দুই পাড়াতে ওরা থাকে, সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ওদের মধ্যে ফার্স্ট হওয়া নিয়ে তুল্যমূল্য প্রতিযোগিতা চলে আসছে, একবার এ ফার্স্ট হয় তো পরের বার ও। এমনিতে দুজনের মধ্যে কিন্তু গলায় গলায় ভাব, বাড়িতেও  হামেশাই আসা যাওয়া আছে। দুজনাই বড় হয়ে বিরাট কিছু হবে এমন আশা এলাকাবাসী পোষণ করে থাকেন। এলাকার কিছু সম্পন্ন ব্যক্তির অর্থ সাহায্যে কোনও মতে এরা দুজনেই পড়াশোনা করে চলছে । 

যাই হোক হেডস্যারের একান্ত উদ্যমে ভরতপুর এবং তার আশেপাশের গ্রামের কিছু মানুষের সহায়তায় ওদের সব খরচাটা জোগাড় করা গেল। দুই পরিবারেই গয়না  বন্ধক রেখে ওদের মায়েরা ছেলেদুটোর  হাতে কিছু টাকা তুলে দিলেন, যাতে থাকা খাওয়া নিয়ে ওদের কষ্ট না হয়। সাথে ওদের চার-পাঁচদিন চলার মতো শুকনো খাবারও থলির মধ্যে দিয়ে দিলেন। ওদের বিদায় জানাবার জন্য ভরতপুর স্টেশনে বহু লোক ভিড় করে এসেছিল। তা দেখে ছাত্র দুজন খুব আপ্লুত হয়ে পড়ল। এত লোক তাদের কল্যাণ কামনা করে?! ট্রেনে চাপার আগে হেডস্যার ওদের ডেকে বললেন, “সফল হয়ে এসো, তোমাদের উপর এই  এলাকাবাসীর অনেক আশা, অনেক বিশ্বাস। তোমরা তার উপযুক্ত মর্যাদা রেখো।” “হ্যাঁ, স্যার, যথাসাধ্য চেষ্টা করব।” ওনাকে প্রণাম করে ছাত্র দুজন বলল। একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিল। উনি হাত নেড়ে তার প্রিয় দুই ছাত্রকে বিদায় জানালেন।

বহু খোঁজাখুঁজি করে দার্জিলিং শহরে ওরা মাথা গোঁজার মত একটা ঠাঁই  জোগাড় করে ফেলে। সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার ওরা খায়, পাছে হাতে থাকা সব পয়সা ফুরিয়ে যায়। পরীক্ষাকেন্দ্রটা খুব দূরে নয়, ওরা হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ্য। চারপাশে ওরা  এই পরীক্ষাটার বড়বড়  বিজ্ঞাপন দেখতে পায়, ওরা যে খুবই বড় পরীক্ষা দিতে এসেছে সে ব্যাপারটা ওদের বোধগম্য হয়। ওদের সাথে থাকা কাগজপত্র খুব খুঁটিয়ে চেক করে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়, সেখানে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ওদের আলাদা জায়গায় সিট পড়েছিল। ঠিকঠাক ফর্ম ফিলাপ করার পর ওদের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে  দেওয়া হয়। প্রশ্নগুলো ইংরেজিতে,  কিছু বড় আর কিছু সংক্ষিপ্ত, ওরা সাধ্যমতো উত্তর দেয় ।তিনঘণ্টা পর পরীক্ষা শেষ হয়, অত্যন্ত কড়া গার্ড দেওয়া হয়েছিল, কেউ ঘাড় ঘোরাতেই পায়নি। পরপর দুদিন পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়, আগামীকালের পরীক্ষা শেষ হলেই সন্ধ্যেবেলার ট্রেনে ওরা ফিরে যাবে। তারপর ফলাফল বেরোবার অপেক্ষা। শিবরাম ওরফে শিবু বলে, “চল কালই তো ফিরতে হবে, আজ না হয় শহরটা একটু ঘুরে দেখি।”

সাগেন রাজি হয়। শৈলশহরের নানা জায়গায় ওরা ঘুরতে থাকে। একটু রাত হলে রাতের খাবার খেতে পথের পাশে এক ধাবাতে যায়, চারপাশে খাটিয়ার উপর নানা গাড়ির লোক বসে আছে। প্রায় প্রত্যেকেই স্থানীয় একটা পানীয় খাচ্ছে। শিবু আর সাগেনের চোখ চকচক করে ওঠে, পড়াশোনার সাথে জীবনের আনন্দ ওরা চেখে নিতে চায়। শিবু বলে “চল রুটি তড়কার সাথে ওই মদটা এক গেলাস করে খেয়েই ফেলা যাক। জানিনা এদিকে আর কবে আসব বা এমন সুযোগ পাব।” 

কিন্তু কিন্তু  গলায় সাগেন বলে, “সে তো ভালোই রে শিবু, কিন্তু যদি খাবার পর নেশা হয়ে যায় তবে তো কালকের পরীক্ষাটা ভালো করে দিতেই পারবো না, তখন কী হবে?’ 

মুচকি হেসে শিবু বলে, “তাতে আমার কাঁচকলা। এটা তো আর এইচ এস পরীক্ষা নয় যে ভালো রেজাল্ট না করলে মুস্কিল। কি জানিস ভাই এই দুদিন পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখলাম সারা দেশের বিভিন্ন বোর্ডের সব টপটপ ছেলেমেয়েরা এসেছে। আমি জেনারেল ক্যান্ডিডেট, মাত্র দুটি সিট। আমি কখনোই ওদের টপকে সুযোগ পাবো না।”

হাসতে হাসতে সাগেন বলে, “আমি শিডিউলড  ট্রাইব কোটাতে চান্স পাবোই, বাকি যে তিন চারটে ছেলেমেয়ে এসেছে একেবারে ঢ্যাঁড়শ, কিছু লিখতে পারেনি। আমি শিওর চান্স পাচ্ছি।” 

“সাবাস সাগেন, আয় তবে তোর চান্স পাওয়ার আনন্দ আর আমার না পাওয়ার দুঃখকে মাল খেয়ে সেলিব্রেট করা যাক। যা টাকা আছে কালকে খরচের জন্য কিছু রেখে ভালোই মজা করা যাবে। আয় অর্ডার দিই।”  

খানিকপর দুজনে ওদের পরিবার সমেত সমগ্র ভরতপুর এলাকাবাসীর কষ্ট করে দেওয়া টাকায় মদ খেয়ে ধাবার খাটিয়াতে বেহুঁশ হয়ে শুয়ে পড়ে, স্বপ্নের ভারত প্রকল্পের হোর্ডিং ওদের পায়ের কাছে লুটোতে থাকে। 

অনিন্দ্য সুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.