গল্প: এক টুকরো ভারতবর্ষ

বেশ কয়েকবছর আগের কথা, পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালে বাচ্চাদের ওয়ার্ডে ডিউটি করছি, খুব ব্যস্ত। পরপর ভর্তি হচ্ছে রোগী। মাত্র দুজন  সিস্টার। আমি অন্য ওয়ার্ডের স্টাফ। এখানের  স্টাফ আজ অনুপস্থিত থাকায় আমাকে পাঠানো হয়েছে সিডিউল স্টাফ কে সাহায্য করতে। এমারজেন্সি থেকে দেখিয়ে ভর্তি হতে  আসা রোগীর পরিজনদের কাছ থেকে টিকিটের সাথে নাম, ঠিকানা মিলিয়ে বিছানা দেখিয়ে দিচ্ছি। 
একটা টিকিটে রোগীর নাম মেলাতে গিয়ে হোঁচট খেলাম- “স্বাধীনতা মুর্মু”। নয় বছরের একটি ছেলে। বিছানা দেওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দু-বার নামটা জিজ্ঞেস করলাম। এত ভিড়ে পুরো ঠিকানা মেলানোর সময় পেলাম না। তাছাড়া দেখলাম বাচ্চাটার জেনারেল কন্ডিশন খুব খারাপ। বুকের ওঠানামা দেখেই বোঝা যায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব, দ্রুত অক্সিজেনের প্রয়োজন। তাই আগের কাজ আগে করার তাগিদে বেড হেড টিকিট টেবিলে রেখেই এগিয়ে গেলাম। তবে হ্যাঁ নামটা মাথায় থেকে গেল…
প্রসঙ্গত বলি পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা রোগীদের নামগুলো বেশ মজার। মেয়েদের মধ্যে সাতটা বারের আধিক্য দেখা যেত প্রায়শই — যেমন রবিবারে জন্মালে রব্বারি, সোমবারে সোম্বারি, মঙ্গলে মংলি, বুধে বুধি, এইভাবে গুরুবারি, শুকুরমনি ও শনিচেরি। বাড়ির গৃহপালিত পোষ্য যেমন গরু, ছাগলদের ও কন্যাসন্তানের নাম প্রায় একই হত বেশিরভাগ সময়ে। 
মেয়ে যখন তার নামের জন্য সময় বা বুদ্ধির অপচয় করার দরকার কি? সাধারণ মানুষের ভাবনায় এই ছিল মূল বক্তব্য! ‘সেইতো বিহা হবেক, পরের ঘরে যাবেক’। নামকরণ তো একটা সম্পদ, পরের ঘরে যাবে যে মেয়ে, তার জন্য অর্থ অপচয় তো আছেই,  আবার বুদ্ধি বা ভাবনার জন্য সময়ের অপচয় করে কি হবে, যত টুকু জানতে পারতাম তাই শুনে এমনটাই মনে হত আমার।
একবার এক মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হ্যাঁগো, তোমার নাম তো শুকুরমনি, নিশ্চয়ই শুক্রবারে জন্মেছিলে।”
“হ দিদিমনি।”
“তা তোমার মেয়েও যদি শুক্রবারে হয়, তার নামও কি তবে…”
“ক্যানে দিদিমণি, দ্যাশে কি আর নাম লাই? গুলাচি, এলাচি, লবঙ্গ, হরিতকী, বিজলি, হলদি, দুঃখী কুকড়ি, মাকড়ি  কত নাম লিবিক বল্ ক্যানে?” হেসে বলেছিল মা
“দুখী? কুকড়ি?” বিস্ময়াভুত আমাকে শুনতে হয়েছিল, “মেয়েমানুষ বটে, দুখ লয় তো সুখ কুথাকে পাবে দিদিমনি? লাম লিয়ে অত ভাবলে চলবে কেনে? মুদের ঘরে মেয়েমানুষগুলান কি দ্যাশোদ্ধার করবেক?”
বটেই তো, অবাক হতে হতেও থমকে গেছিলাম। এ তো গেল ফেলনা মেয়ে সন্তানের  নাম গল্পগাঁথা। কিন্তু পুত্র সন্তান? তাদের নাম তো যা খুশি হলে চলে না। ব্যাটাছেলে বলে কথা।

“উখানে দিন আনা দিন খাওয়া হোক বা দু বিঘা জমির জমিনদারই হোক, বংশ মর্যাদাটুকু হেলাফেলা করলে চলবেক কেনে? বড় হলে ছেলেটা দুষবেক নাই? বলবেক নাই, মা, বাপ তুরা এমন একখান নাম দিলি দ্যাশের লোক ছেদ্দা ভক্তি করছে লাই। হাজার হক মরদ বুলে কথা। উদের একটা সম্মান অসম্মান লাই?” 

আর সত্যিই যে তথাকথিত শিক্ষা নাই বলে কি এই মানুষগুলো  জানে না সমাজের উচ্চ স্থানাধিকারী কারা? কিম্বা উচ্চ পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষের ব্যক্তিত্বময় সামাজিক সম্মানকে?  যাদের ছেদ্ধাভক্তি করেই, যাদের কাছে হাত কচলেই দিন গুজরান হয় এই প্রান্তিক মানুষদের। আর তাই  পুরুষ সন্তানদের নাম হবে, ডাক্তার মুর্মু, উকিল বেশরা, মোক্তার মান্ডি, ব্যারিস্টার মাহাতো! পদবী এদিক ওদিক হতেই পারে, কিছু যোগও হতে পারে, কিন্তু এই নামগুলো ছিল বেশ চমকপ্রদ। অবাক হবেন না– আমি হাসপাতাল মান্ডি নামেও রোগী পেয়েছি। ছিল মোড়ল, মনিব, মুরুব্বি, ভিখারি, সরকার, গভরমেন্ট বা চাকরিও বাদ ছিল না। বুঝতে ভুল করবেন না এগুলি নাম অবশ্যই। 

একবার ভাবুন সিস্টার হাসপাতালের মধ্যে চিৎকার করছে, ‘গভরমেন্টের বাড়ির লোক দেখা করুন’… ‘আগামীকাল সরকারের অপারেশন’…‘আজ দশ নং হাসপাতালের রক্ত পরীক্ষা’… ‘চাকরির অবস্থা আশংকাজনক’… ‘দুই নং বেডের  ডাক্তার নিজের থালা বাটি নিয়ে সকালের খাওয়ার নিয়ে যান’… অথবা ‘ব্যারিস্টারকে ধোঁয়া (নেবুলাইজেসন) দেওয়ার সময় হয়ে গেছে’… ‘উকিল মোক্তারের ছুটি (ডিসচার্জ), বারটা বাজলেই বাড়ি যান’ (তখন আমরা সকাল ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ছুটি দিয়ে বিছানা খালি করতাম পরবর্তী ভর্তির জন্য)… ‘আজ মোড়ল ও মুরুব্বিকে আইশোলেশনে রাখা হবে’… ‘আগামীকাল সকালে পেটের ছবির (আল্ট্রাসোনোগ্রাফি) জন্য মনিব আর ভিখারি না খেয়ে থাকবে’…..ইত্যাদি ইত্যাদি!

এসব শুনে  আপনার কী মনে হবে? হাসবেন না, আমরা হাসতাম বটে তবে বিষয়টা সবসময় হাসির নয়।  হয়ত এইসব পেশাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর মহান পন্থাও এই নামকরণের উদ্যেশ্য হতে পারে বলে মনে হয়েছে আমার। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে এইসব চিৎকারে আমরা একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। প্রথম প্রথম কানে লাগলেও পরে গা সওয়া হয়ে যায় সকলেরই। অন্য নামও তো ছিল বিস্তর। যাইহোক…

এরকম নামকরণের মহিমা দেখে,  প্রথমদিকে বেশ মজা পেলেও  পরে মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করেছি —

 হতদরিদ্র ভূমিহীন মানুষগুলোর পুরুষ সন্তান ঘিরে লুকোনো স্বপ্নের এমন একটুকরো আকাশ দেখে, কিংবা  কন্যা সন্তান নিয়ে অবজ্ঞা, অসহায়তা আমাকে এক অন্য ভারত চেনাত। একটা অন্য পৃথিবী।   তাই কন্যাসন্তান নিয়ে এই ভাবনাগুলো আমাকে কষ্ট দিলেও পুরুষ শিশুদের মধ্যে এমন পেশামুলক নামের সন্ধান পেলে, মনে মনে বলতাম, আহা নামটা যেন সার্থক হয়। যদি তাতে  দারিদ্র আর অশিক্ষা ঘোঁচে এ পৃথিবীতে…। এ দেশটা তো আমার, এই মানুষগুলো তো আমার পরিবার– এই টুকু প্রার্থনা তো করতেই হবে। 

যদিও খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি নার্স নামে  আমি কোনো কন্যা সন্তানের নাম পাইনি। এ  নিয়ে আমার ব্যথার অন্ত নেই। আড়ালে আমাদের ওরা লাশ-বিটিছ্যালা বলে গালাগাল করলেও সামনে ভালোবাসার ডাক দিদিমনি শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। তবে দিদিমণি নামেও –হয়ত ছিল; নাহ! আমি কিন্তু পাইনি। 

বহুবছর এই জেলায় কাজ করার সুবাদে এই মালভূমি অঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে আমরা এরকম অনেক কিছুই জেনেছি। তবে যে সময়টার কথা বলছি তখন অবশ্য আমার ওখানে বেশিদিন হয়নি। নামকরণ সম্পর্কিত এই ধারণা গুলি সম্পর্কে ধীরে ধীরে ধাতস্থ হচ্ছি।

যাইহোক এবারের নামটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটু অবাক হয়েছি। বরাবরই আমি খুব কৌতুহলী। পুরুলিয়ার শুখা মাটির দুখা জীবনের আনাচে-কানাচে অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। ভাবলাম এমন নামের কোন ইতিহাস আছে কিনা জানতে হবে।  

হাতের কাজ একটু সামলে উঠে  ঘন্টাখানেক পরে স্বাধীনতার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একা শুয়ে আছে ছেলেটি। ফ্যাকাশে রুগ্ন মুখ। তেলহীন খড়িওঠা গা। বুক পর্যন্ত ফুলে ওঠা পেট। শরীরের উর্ধাঙ্গ নগ্ন। নিন্মাঙ্গে একটি ধুসর নীল রং এর তেলচিটে  হাফপ্যান্ট। মুখটা সামান্য হাঁ করে আছে। বুকের ওঠানামা দ্রুত, শব্দ হচ্ছে কষ্টের। অক্সিজেন চেক করে বাড়িয়ে দিলাম। বুকের ওঠানামা একটু কমলো। সন্ধ্যে নামছে, জানালা দিয়ে হালকা ঠান্ডা বাতাস। পায়ের কাছে হাসপাতালে কম্বল টেনে ঢাকা দিয়ে ডান হাতে পালস চেক করে এদিক ওদিক তাকাতেই পাশের বিছানার রোগীর পরিবার বলল, “উর মা তো খুন আনতে গেল দিদিমণি।”

হ্যাঁ রক্তকে খুন বলে পুরুলিয়ার মানুষ। বললাম, “যতক্ষণ না ফিরে আসে দেখো একটু…”

অনডিউটি ডক্টরকে এসে বললাম, “৪৭ নম্বর বেডের রোগীকে একবার দেখে আসুন।”

“থ্যালাসিমিয়া স্বাধীনতা?” মজা করে বললেন ডক্টর সুদীপ্ত ব্যানার্জি.

“হ্যাঁ।” মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কন্ডিশন ভালো নয়।”

“জানি তো। একমাস আগে আসতে বলেছিলাম। তখন প্রতি সপ্তাহে রক্ত লাগছিল। এক্কেবারে মেরে এনেছে। যা অবস্থা ব্লাড চালাবো কি করে? চ্যানেলই তো করতে পারছি না। ভেন পেলাম না কোথাও। এই অবস্থায় ছেলেটা আবার বাবার সঙ্গে খাটতে যায়, খেতে পায়না… ভাবতে পারেন? কি যে বলব এদের?”

এক সিনিয়র দিদি বললেন, “কে? ৪৭ নম্বর? আরে ও তো সিধুল। সেই কবে থেকে আসছে বাচ্চাটা। যখন আসে এরকমই আসে প্রতিবার… দু এক বোতল রক্ত পেলেই ঠিক হয়ে যায়। খুব কথা বলতে পারে। একটু স্টেবল হোক, দেখবি কেমন বকবক করে।”

আমি ওয়ার্ডে নতুন। তাই স্বাধীনতা মানে ওই সিধু সম্পর্কে আমার এসব জানা ছিল না। মুখ তুলে বললাম, “এবারের কন্ডিশন খুব খারাপ দিদি…”

ওর মা ফিরল কিছুক্ষণ পর। জানতে এল, সিধু কে কিছু খেতে দেবে কিনা। পুরুলিয়ার এই আর এক সমস্যা মরনাপন্ন অজ্ঞান রোগীকেও ওরা আঙ্গুর আর চা খাইয়ে সেবা যত্ন করে।

“না”, বলে মাথা নেড়ে সিধুর মাকে অসম্মতি জানালাম। চলে যাচ্ছিল। বললাম, “কোথায় ছিলে? রোগীর কাছে থাকো না কেন?”

“টুকু উর বাপটার কাছে গেছিলি দিদিমণি।” 

“ওর বাপ কোথায়?” ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন। 

ডাক্তারের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল সিধুর মা, “টুকু চা খেতে গেল বাবু। মুরা সেই ভর থিক্কা বাহার হুইছি ন।”

“খুন আনতে যা  কেনহে,  পরহে চা খাবি!” কথা শেষ করতে না দিয়েই ধমকে উঠলেন ডাক্তার ব্যানার্জি। 

কোমরে গোজা কাপড়ের গিট খুলে ১০ ভাঁজ করে রাখা একখানা পরিচ্ছন্ন কাগজের মোড়ক বার করলো সিধুর মা। ঘন্টাখানেক আগে দেওয়া আমাদের ব্লাড রিকুইজিশন ফর্ম। কাগজটার মোড়ক খুলে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “উ ব্যাংটা (ব্লাড ব্যাংক) বুলল, আজ খুন নাই খে, কালহিকে  যেতে হবেক। উ সকালটু তে দিবেক বটে।”

“এত দেরি টা কেন করলি তুরা? একদম শেষ করে আনলি? শুন সিধুর মা, তর ব্যাটারে আমি ইবারে বাঁচাতে লারব।”

“ওমন বলো না বাপ…” মিনমিন করে বলতে বলতে ঘন ঘন আঁচলের খুটে চোখের জল মুছতে লাগল হতভাগিনী। 

“ইখানে ভেন্টিলেটর নাই, বড়হ জাগা লিয়ে যেতে পারবি?”

“কুথাকে লিয়ে যাব গ? মুরা গরীব বটে, তুমিই টুকু দেখো বাপ…”

“কাকে কী বলছি? নিয়েই বা যাবি কি করে? সে অবস্থাও তো রাখিস নি।” বলে নিজের মনেই বাবু ডঃ ব্যানার্জি  রাগে গজ গজ করতে করতে অসহায়ের মত আরও একবার চ্যানেল করার চেষ্টায় রোগীর কাছে গেলে আমার সহকর্মী দিদি ওনাকে এসিস্ট করতে গেলেন। 

সিধুর মা পেছন ফিরতেই দাঁড় করালাম আমি, “শোনো, তোমার ছেলের নাম কে রেখেছে গো?”

“বড়বাপ বটে দিদিমনি, মুর শ্বশুর বাপ।”

আমাকে আজ বোকামিতে পেয়েছে, আবারও বললাম, “স্বাধীনতার মানে জানো?”

“কেনে জানবোক নাই দিদিমণি? উ জঙ্গুলটায় দিনরাত লড়হাই টা লাগে ন? স্বাধীনতার লগে? মুর ভাসুরপোটারে তো লিয়ে গেল উর তরে…। সিধুর বড় বাপটার টুকু বুদ্ধি ছিল না? গেরামের লোকগুলান মানত খুহব— তো বললো হুই স্বাধীনতা নামটাই রাখ কেনে বৌ, মুর ব্যাটাটার সাথে মিলবেক খুহব।”

কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রশ্ন করলাম, “ভাসুরপো কে কোথায় নিয়ে গেল?”

জঙ্গলের লড়াই এর ব্যাপারে আমি তখনও অজ্ঞ। তাই তখন জানা হলো না সিধুর বাবার সঙ্গে নামের কী মিল দেখে ঠাকুর্দা এমন একটি নাম পছন্দ করলেন নাতির জন্য।

সিধুর মা বলে চলেছে, “আর দিদিমণি, মুরা গরীব আছি বটে, মুখ্যু সুখ্যু লোক, অত কথা কি জানি? তবে যি বারে পাহাড় থিক্কা লোকগুলান আলো (এল), আর মুদের বুলল, তুদের ভাত কাপড়ের অভাব হবেক নাই, কাজ কাম পাওয়া যাবেক, রাস্তা হবেক…”

“রাস্তা হল?” থামিয়ে প্রশ্ন করলাম। 

“কুথাকে দিদিমনি? কুড়ি কিলোমিটার পায়দল  আলি গ।” 

“কি কাজ করো তোমরা?”

“জঙ্গল থিক্কা কাঠ পাতা কুড়হাই, বাবু দড়ি পাকহাই,  হাটে বেচি।” 

থামাতেই হল। টেবিলে ব্যাস্ততা, বললাম, “সিধু (বলেও কেন জানিনা বদলে ফেললাম কথা) স্বাধীনতার কাছে যাও।” 

ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত বার করে মৃয়মাণ এক হাসি উপহার দিল সিধুর মা, “অরে সবাই সিধুই বলে গ। উতো বড়হ লাম টা আমি বলতে লারি দিদিমনি।” চোখ আর একবার কাপড়ে মুছে পেছন ফিরল। 

মিনিট কুড়ি, তিরিশ পরেই মা টা আবার ছুটতে ছুটতে এল। যুদ্ধের পরিস্থিতি কাটিয়ে বুঝলাম হাই রিস্ক কনসেন্ট নিতে হবে। রোগীর অবস্থা নিম্নগামী। 

এবারে ডাক্তার ব্যানার্জি মা কে ডেকে শান্ত মাথায় বোঝালেন। বললেন, “সই করো।”   

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আবারও ফুঁপিয়ে উঠল সিধুর মা। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “উর বাপটারে টুকু ডাকহি ডাক্তারবাবু…” 

রোগা কাঁঠির মত দুঃস্থ চেহারা, বসা চোখ, উঁচু চোয়াল, কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কনুই ও কাঁধের কাছে ছেঁড়া শার্টের  একদিকে শার্টের হাতা ঝুলে আছে। গোড়ালি অব্দি ময়লা ধুতিতে অকালে বুড়ো হয়ে যাওয়া স্বাধীনতার বাবা এসে অনেক ধরে ধরে, অনেক সময় নিয়ে যখন নিজের সইটা শেষ করলেন, তখন সই দেখে চমকে উঠলাম আমি, সাতচল্লিশ নং বিছানার রোগী স্বাধীনতার বাবার নাম নেতাজী!! সই শেষ করে বড্ড করুন সুরে বললেন, “দিদিমনি মোর ব্যাটাটা বাঁচবেক লাই?”

নামের মিলটা পেলাম বটে, কিন্তু কী উত্তর দেব? অন্যমনস্কের মত সিধুর মা কে বললাম, “এখানে টিপ দাও।”

কাঁদতে কাঁদতে দিল। মাথা নীচু করে টিপের চারপাশে গোল করে লিখলাম – LTI of Bharati Murmu. লাইভ সেভিং এর যথাসাধ্য চিকিৎসার ব্যাবস্থা দিয়ে ডিউটির শেষ করতে রাত হল একটু। রথ নিয়ে হাজির আমার গৃহকর্তা,  উঠে বসলাম, পথে কোন আলো নেই।  জানলাম শহরের বুকে কোথায় যেন ফল্ট হয়েছে, ইলেকট্রিক টান্সমিটার সারানো চলছে, তাই এত ঘুটঘুট্টি। ফেরার পথে দু’চাকার পেছনে বসে রাতের আকাশ দেখা আমার বরাবরের অভ্যেস। মনখারাপ নিয়ে উপরের দিকে মুখ তুললাম কিন্তু যতদুর চোখ যায় শূণ্যতার ভেতর কিছুই খুঁজে পেলাম না। শুধু পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত আমার ভারতবর্ষের  আকাশে রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার মেখে বাড়ি ফিরলাম।

পরের দিন মর্নিং ডিউটি। হ্যান্ড ওভার শেষ করে ৪৭নং বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালাম। জেনে গেছি ভোর ৫টায় মারা গেছে স্বাধীনতা। সকলের সিধু, বকবক করা সিধু, অসুস্থ অশক্ত শরীরে বাবাকে কাজে সাহায্য করা সিধু। নেতাজী একটা হাত মাথায় আর একটা হাতে সন্তানের শরীর আগলে বসে আছেন। খাটের পাশে শব্দ করে কেঁদে চলেছে ভারতী। স্বাধীনতার চোখ দুটো সামান্য খোলা, মুখটা আগের দিনের মতই ঈষৎ হাঁ। চোখের পাতায় হাত রাখলাম আমি। 

“অ দিদিমণি রে– মুর সিধুটারে ফিরাইন দে রে-!” 

আছড়ে পড়ল ভারতী। পা সরিয়ে ওকে তুলে সিধুর বিছানার একপাশে বসালাম। 

বলা হল না চার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। স্বাধীনতার নিষ্প্রাণ দেহটা সরানোর সময় উপস্থিত। বলতে পারলাম না, “আমরা তোমাকে শুধু রক্ত কেন, বাঁচিয়ে রাখার, বেঁচে থাকার মত নুন্যতম অধিকারের কিছুই দিতে পারিনি নেতাজী! তুমি কি করে স্বাধীনতা রক্ষা করবে বলো তো?” 

ভারতীর মুখে স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে দেওয়ার তীব্র হাহাকার শরীরে জড়িয়ে এক  টুকরো হতদরিদ্র শোকগ্রস্ত ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে বাঁচতে আমি নিজের টেবিলে ফিরে এলাম।

শ্রাবণী পাত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.