এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের (Corona virus) প্রাদুর্ভাব দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ১৫৩৭৪৯৩ জনের বেশি এতে আক্রান্ত হওয়ার ও ৪৯‚৯৫৪ (এই প্রবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত) জন মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রবিন্দু চীন (China) ছাড়াও এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলি হ’ল ইতালি, ইরান ও আমেরিকা।

যে উপন্যাস করোনা ভাইরাসের (Corona virus) পূর্বাভাস দিয়েছিলো:

ভাইরাসের স্বরূপ জানতে পারার সঙ্গেই সঙ্গেই ১৯৮১ সালে ডিন কুন্টজের লেখা একটি উপন্যাস ‘দ্য আইস অফ ডার্কনেস‘ থেকে একটি অনুচ্ছেদ পাঠকদের নজরে আসে। অনুচ্ছেদটির ফটোকপি নিমেষে ভাইরাল হয়ে যায়। নেটিজেনরা দাবি করতে থাকে সেই অনুচ্ছেদে করোনা ভাইরাসের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির আশ্চর্যজনক মিল আছে যাকে নস্যাৎ করা কঠিন। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই প্লটে একজন মায়ের কথা বলা হয়েছে যে একটি ক্যাম্পেইন ট্রিপ থেকে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যাওয়ার পর তার ছেলের সঙ্গে কী হয়েছে তা জানার চেষ্টা করে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে তার ছেলে চীনে আছে‚ আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে উহান প্রদেশে আছে‚ যেখানে একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে

ডোম্বে নামে একটি চরিত্র ‘উহান-৪০০‘ নামে একটি ভাইরাসের বিবরণ দেয় যেটা কিনা উহান শহরের বাইরে আরডিএনএ (রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ) ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছিল। এটি ছিলো একটি মনুষ্যনির্মিত অণুজীবের চারশতম কার্যকর স্ট্রেন। পরিচ্ছেদটি তারপরে ভাইরাসটি কীভাবে মানবদেহকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দেয়। এই ১৯৮১ সালে প্রকাশিত বইটির ‘উহান-৪০০’ ভাইরাস ও করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও চরিত্রের মধ্যে এই মিল সত্যিই অদ্ভুত। কিন্তু ১৩ই মার্চ‚ ২০২০-তে হরমিত কৌর সিএনএনে লেখেন যে “যাই হোক‚ একটা উপন্যাস হলো একটি কল্পনা……তাই আসুন এই গুজব বন্ধ করি।”

চীনের ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা:

যখন থেকে বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন থেকেই চীনের কমিউনিস্ট (Communist) সরকার এই প্রাদুর্ভাব ও সরকারী পরিসংখ্যানগুলি আড়াল করার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

সাউথ চায়না মর্নিং নিশ্চিতভাবে জানিয়েছে যে ডা. মেই ঝোংমিংয় ও উহান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের আরও আটজন ডাক্তার এই মহামারী সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে গেলে চীন সরকার তাঁদের থামিয়ে দেয়। “গুজব ছড়ানোর” অপরাধে তাদের শাস্তিও দেওয়া হয়। যদিও এই ঘটনা প্রমাণ করা যায়নি‚ আর তা সম্ভবও না। কিন্তু ঐযে একটা কথা আছে না‚ ধোঁয়া থাকলে সেখানে আগুন থাকবেই…………

এর উৎস কি সমুদ্রজাত খাবারের বাজার?

প্রথমদিকে, এমন কিছু জল্পনা ছিল যে উহান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের খুব কাছেই হুনানে সমুদ্রজাত খাবারের পাইকারি বাজার থেকেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটেছে। আবার চীনা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিবেদনের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বন্ধ হওয়া এই সমুদ্রজাত খাবারের বাজারের সঙ্গে সংযোগ ছিলো।

অনলাইন ফোরামে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করে যে এই ভাইরাসের সৃষ্টি উহান প্রদেশে চীনের (China) একমাত্র চতুর্থ স্তরের জৈব ল্যাবরেটরি (সবথেকে ভয়ঙ্কর ভাইরাস নিয়ে অধ্যয়নকারী সর্বোচ্চ স্তরের ল্যাব) ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজিতে হয়েছে। সবার সামনে এই তত্ত্বকে সমর্থনকারী প্রথম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলেন মার্কিন সেনেটর টম কটন। তিনি ফক্স নিউজে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে এই ভাইরাসটি প্রকৃতপক্ষে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি হতে পারে। বেশ কিছু নেটিজনের মতে এটি হলো চীনের (China) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। যাইহোক এই দাবিও স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ করা যায়নি।

ফাইভজি সংযোগ?

ভাইরাস সম্পর্কিত নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলি ইন্টারনেটে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তারমধ্যে অন্যতম ছিলো ফাইভজি সংযোগ তত্ত্ব। ধারণা করা হয় যে নভেম্বর মাসে চীনের উহান শহরের একটি বাজার থেকে কোভিড-১৯ (Covid-19) -এর উদ্ভব হয়েছিল। আর কাকতালীয়ভাবে চীন নভেম্বর মাসেই তার কিছু ফাইভজি নেটওয়ার্ক চালু করে। এখন‚ আমেরিকা চায় না যে চীন ফাইভজি মোবাইল নেটওয়ার্কে আধিপত্য বিস্তার করুক। তাই অনেকের ধারণা এটা ছিলো চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার একটা অস্ত্র।

চীনের বড় টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার জন্য আমেরিকার একটি নতুন পথের প্রয়োজন। এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ফলে অবশ্যই ইউরোপ (Europe) ও আমেরিকায় (America) ফাইভজি নেটওয়ার্ক চালু হতে দেরী হবে। এই সঙ্কটের আগে ইউরোপের ফাইভ জি নেটওয়ার্কে হুয়েইর ভূমিকা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিল।

যুক্তরাজ্য চাইনিজ সংস্থাটিকে সীমিত ভূমিকাতে কাজ করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্রান্স ও জার্মানিও একই পথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছি‚ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States) এবং যুক্তরাজ্যের কিছু রাজনীতিবিদ এই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছিলো বলে জানা গেছে। এখন, হুয়েই ফাইভজি নেটওয়ার্ক বিস্তৃতকরণের ক্ষেত্রে কিছুটা দেরী হবে বলে মেনে নেওয়ার সময় তারা জোর দিয়ে বলেছিলো যে ন্যূনতম সময়ের মধ্যেই এটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ফলে আসলে তেমন কিছুই সমস্যা হয়নি বলেই ধারণা করা যায়।

এখন এটা হয়তো সংস্থাটি কর্মী ও লগ্নিকারীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য বলেছে। অথবা হুয়েইয়ের সরঞ্জামগুলিতে প্রযুক্তিগত এবং সুরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে আসলেই কোনো সমস্যা হয়নি, কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংস্থাটির অনুকূলে নেই। আবার চীনে (China) ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সরঞ্জাম সরবরাহে সমস্যা হতে পারে ভেবে সংস্থাটি যুক্তরাজ্যের তিনটি গুদামে অনেকগুলো অতিরিক্ত খুচরো যন্ত্রাংশ এনে জড়ো করে রেখেছিল

একজন প্রবীণ চীনা নির্বাহী এরিক জু বলেছিলেন যে কোভিড-১৯ (Covid-19) -এর প্রাদুর্ভাব কমে আসার পরে চীন তার নিজস্ব ফাইভজি নেটওয়ার্কের কাজ ত্বরান্বিত করেছে, তবে অন্যান্য দেশগুলিতে এর অগ্রগতি “বেশ কয়েকটি কারণের উপর” নির্ভর করবে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নষ্ট হওয়া সময় মেরামতির জন্য টেলিকম সংস্থাগুলির বাজেট এবং রসদ।

গুজব আরও ছড়িয়ে পড়ে যখন গতসপ্তাহে জনপ্রিয় আমেরিকান গায়ক কেরি হিলসন টুইটারে ৪.২ মিলিয়ন অনুগামীদের উদ্দেশ্যে ফাইভজি ও কোভিড-১৯ (Covid-19)-এর মধ্যে তথাকথিত সংযোগ সম্পর্কে টুইট করেন। তিনি লেখেন‚ “মানুষ আমাদের বহু বছর ধরে ফাইভজি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সচেতন করে আসছে। পিটিশন‚ অর্গানাইজেশন‚ স্টাডিজ। যা ঘটছে তা হচ্ছে রেডিয়েশনের প্রভাবে। চীনে ফাইভ জি চালু হয়েছে ১ লা নভেম্বর‚ ২০১৯। তারপরই মানুষ মারা গেলো।”

বেশ কয়েকজন আরও অভিযোগ জানায় যে চীন থেকে সম্প্রতি যে ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়েছে‚ যাতে লোকেরা ‘মাটি ছুঁচ্ছে এবং অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে‘ তা কিনা আসলে ফাইভজি রেডিও তরঙ্গের ফলেই ঘটছে। এই তরঙ্গ সাধারণ মানুষের শরীরে রক্তে অক্সিজেন লেভেলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটা ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট, “ফুল ফ্যাক্ট” এইসব দাবি বাতিল করে দেয়। তারা জানায় যে ফাইভজি তরঙ্গ যে মানুষের জন্য ক্ষতিকর তার কোনো প্রমাণ নেই।

কোভিড-১৯ কি একটি জৈব অস্ত্র?

ইন্টারনেটে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছাড়াও আরও যে মতামতটি সবথেকে বেশি পরিমাণে উঠে আসছিলো তা হলো এটা একটা জৈব অস্ত্র হলেও হতে পারে। ইটি প্রাইমের একটি রিপোর্ট অনুসারে “কানাডার একদল চীনা বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে কানাডার জাতীয় মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব (এনএমএল)-এ গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগ এনে সেখানে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ল্যাবরেটরিটি কিছু বিপজ্জনক রোগজীবাণু নিয়ে কাজ করে বলে জানা গেছে।”

এই তথাকথিত ‘নীতি লঙ্ঘন’, চীন সহ অন্যান্য দেশের জৈব অস্ত্র কর্মসূচিকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। জৈব অস্ত্র আইনের স্রষ্টা ড. ফ্রান্সিস বয়েলও দাবি করেছেন যে ‘কোভিড -১৯ বা করোনা ভাইরাস (Corona virus) হলো ডিএনএ-জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সহ আক্রমণাত্মক জৈব যুদ্ধের অস্ত্র’। কিন্তু আবারও এই জৈব অস্ত্রের দাবি অপ্রমাণিতই থেকে গেছে।

সবমিলিয়ে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস (Corona virus) নিয়ে অসংখ্য গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টারনেট খুললেই এমন কতগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভেসে উঠছিলো। প্রসঙ্গত‚ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জৈব অস্ত্র প্রোগ্রাম ১৯৪৩ সালে শুরু হয়েছিল। পরে এর জায়গায় শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জৈব প্রতিরক্ষা প্রোগ্রাম।

আরেকটি ঠান্ডা যুদ্ধের দিকে যাত্রা করছি আমরা?

এলি স্টোকলসের মতে, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বর্ণিত হয়েছে এই বিষয়টা। যাতে বলা হয়েছিল বেইজিং তার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়া এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মাধ্যমে আমেরিকার “দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অযোগ্য” রাজনৈতিক অভিজাতদের “বর্ণবাদী এবং বিদেশীভীতিজনিত” বক্তব্য ও কাজকর্মের নিন্দা করেছে। মার্কিন সেনাবাহিনী করোনা ভাইরাস মহামারী ছড়িয়েছে বলেও তারা অভিযোগ জানায়। আর এর মধ্যেই ট্রাম্প চীনের থেকে আমদানি করা কোটি কোটি ডলারের পণ্যে শুল্ক আরোপ করে বসে – চীনও এর পালটা শুল্ক আরোপ করে। এইসব ঘটনা বানিজ্যের খরচ আরও বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেককেই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

এইসব শাস্তিমূলক শুল্ক প্রতিরক্ষামূলক চিকিৎসা সরঞ্জাম‚ যেমন ফেস মাস্ক, গ্লাভস এবং গগলসের উপরেও আরোপিত হয়েছে যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো চীনে (China) তৈরী।

ইউসি সান দিয়েগোতে একবিংশ শতাব্দীর চীন কেন্দ্রের অধ্যাপক সুশান শির্ক বলেন, “ইউএস-চীন সম্পর্ক কতটা খারাপ হয়ে গেছে এতে সেটাই প্রকাশ পেয়েছে। যে তারা কিছুসময় অপেক্ষা করতে ও নিজেদের প্রচেষ্টাকে খুব ভালভাবে সমন্বয় করার জন্য একে অপরের কাছে পৌঁছাতে পারেনি,” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক চীনা বিশেষজ্ঞই সম্পর্ক ত্যাগ করার পক্ষে ছিলো না। শী এবং অন্যান্য প্রায় কয়েক ডজন চীনা বিশেষজ্ঞ এবং প্রাক্তন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কূটনীতিকরা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে নতুনভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করার আহ্বান জানান। দেশ-বিদেশে ভাইরাস সংক্রমণ রোধ এবং তাকে পরাজিত করার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করে সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তারা ওয়াশিংটনের কাছে অনুরোধও করেন।

তবে উভয় পক্ষই এই সংঘাত থেকে সরে আসতে প্রস্তুত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ট্রাম্প এবং চীনা নেতা শি জিনপিং দু’জনেরই কট্টর রাজনৈতিক খেলা চালিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারতে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র জি রং বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত “চীনা (China) জনগণকে বাঁধাধরা গতে না ফেলে” করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রতি তারা কিভাবে দ্রুত সাড়া দিয়েছিলো সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা। জি আরও বলেন, “যদিও চীনের উহান শহরে প্রথম এই প্রাদুর্ভাবের কথা জানা যায়‚ কিন্তু এমন কোনো তথ্য নেই যাতে প্রমাণিত হয় চীনই এই কোভিড -১৯ ভাইরাসের উৎস। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে করোনা ভাইরাসের উৎস খুঁজে বের করা বিজ্ঞানের বিষয়‚ যার জন্য পেশাদার ও বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন প্রয়োজন। যাইহোক এটা প্রমাণ করে যে এটা একটা মনুষ্যনির্মিত ল্যাবরেটরি ভিত্তিক ভাইরাস।

আমেরিকায় (America) মৃতের সংখ্যা বৃষ্টি ও অর্থনৈতিক সমস্যা ট্রাম্পের উপর চাপ বাড়িয়েছে। আবার ট্রাম্পের চীন (China) বিরোধী বার্তা কর্পোরেট ক্ষেত্রে ও কংগ্রেসে দ্বিদলীয় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে জানা যায়। তারা চীনের সঙ্গে দৃঢ় ও ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের কারণে ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিলো। ট্রাম্প এখন চাইছেন চীনের (China) উপর আক্রমণ তীব্র করতে ও মিডিয়া বা বিরোধী ডেমোক্র্যাটিকদের যেকোনো সমালোচনাকেই চীন-পন্থী বলে দাগিয়ে দিতে।

এছাড়াও এই করোনাভাইরাস (Coronavirus) মহামারী বিভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সামগ্রী ও ওষুধের পাশাপাশি অনেকগুলো শিল্পজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও চীনের উপর আমেরিকার গভীর নির্ভরশীলতা প্রকাশ করে দিয়েছে।

ভারত-মার্কিন বন্ধুত্ব কি স্থিতিশীলতা আনতে পারে?

ঠিক এই সময়েই ট্রাম্প ভারত থেকে কোভিড-১৯ (Covid-19) ওষুধ কিনতে চায়। এই সংকটের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন। খবরে বলা হয়েছে‚ ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের পাশাপাশি যোগব্যায়াম ও আয়ুর্বেদের সহায়কতা নিয়ে তারা আলোচনা চালান। এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর পরিস্থিতিতে ভারতের সরকার বিরোধী কিছু গোষ্ঠী ট্রাম্প-মোদী সম্পর্ককে বিদ্রুপ করে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চাপ সৃষ্টি করছে। ট্রাম্পের (Trump) বলাretaliation” শব্দটা নিয়ে নোংরা প্রোপাগান্ডা চলছে। কিন্তু আসল ঘটনাটি হলো‚ সেই মূহুর্তে ট্রাম্প একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। সাংবাদিকটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন- “চিকিৎসা সামগ্রী রপ্তানি বন্ধ করার লক্ষ্যে আপনার সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী (Modi) যে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের রফতানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ তা নিয়ে কি আপনি উদ্বিগ্ন?
উত্তরে ট্রাম্প মোদির সাহায্যের সম্পর্কে বহু বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষে বলেন “প্রতিশোধ হতে পারে।”

মোদির সমালোচকরা ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সময়ের পার্থক্যও ভুলে গেছে। ট্রাম্পের (Trump) প্রেস কনফারেন্স হওয়ার অনেক আগেই ভারত রফতানি নিষেধাজ্ঞায় শিথিলকরণ ঘোষণা করে। তারা ভুলে গেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক এখন স্থিতিশীল এবং উজ্জ্বল।

মোদীর সমালোচকরা এটাও ভুলে গিয়েছিল যে ২৮ শে মার্চ, কোভিড-১৯ (Covid-19) বা করোনা ভাইরাসে মোকাবিলায় ভারতের প্রচেষ্টাকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইউ.এস. এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এর মাধ্যমে ২.৯ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। গত কুড়ি বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ও সমস্ত পরিষেবা মিলিয়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের পরিষেবা সরবরাহ করেছে।

তারা এটাও ভুলে যাচ্ছে যে যে কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক জনস্বাস্থ্য সহায়তার ক্ষেত্রে বিশ্বের বৃহত্তম সরবরাহকারী ছিল। আমেরিকান উদার করদাতারা ২০০৯ সাল থেকে পৃথিবী জুড়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা এবং প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। তারা মোদির কাছে দাবি করে ওষুধ রপ্তানি বন্ধ রাখতে‚ কারণ তারা ভুলে গেছে ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য হলো শক্তি ও বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে সহনশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

রেমন্ড ই. ভিকারি জুনিয়র, বলেন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে (United States) যৌথভাবে কোভিড-১৯ (Covid-19) এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে বেশী‚ আরও অনেক বেশী কিছু করা দরকার। কারণ এই দুটি দেশই পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়ায় উভয়েরই এই সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করার বিশেষ বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণতন্ত্র বিপদের মুখে পড়তে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবা যেমন মহামারীর মুখে অক্ষম হয়ে পড়েছে‚ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিরও সেই হাল হওয়ার ভয় আছে। যদি এর ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে জয়ী হতে হয় তবে আমেরিকা ও ভারতের সাধারণ কর্মসূচিকে শুধু একটা ওষুধ দেওয়া নেওয়ার আলোচনার থেকেও আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষত সেই ওষুধ‚ কোভিড-১৯ (Covid-19) এর বিরুদ্ধে যার কার্যকারিতা এখনও প্রমাণিত হয়নি।

ভিকারির কথার প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা উচিত যে রাশিয়া থেকে ফিলিপিন্স পর্যন্ত, সমস্ত স্বৈরাচারী দেশেই শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করতে ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই ভাইরাসকে ব্যবহার করছে। ইতিহাস আমাদের দেখায় যে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীয়করণের ধারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল হয়ে ফ্যাসিবাদ‚ নাজিবাদের ঊত্থান ঘটিয়েছে যা শেষ পর্যন্ত ডেকে এনেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ‚ পরমাণু আক্রমণ ও হলোকাস্ট।

কোভিড-১৯ (Covid-19) -কে পরাজিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ডাক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (Narendra Modi) জি-২০ এবং সার্কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এতে বোঝা যায় যে আসিয়ান ও বিমস্টেকের ক্ষেত্রেও নরেন্দ্র মোদিকেই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ‘-এ ভারত অংশ নেয়নি। ফলে ভারতের জন্যে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কারণে চীনকে আঞ্চলিক জোট গঠন থেকে দূরে রাখতে ভারতের নিয়মিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভারত গত বছর রিজিয়নাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশীপের থেকে বেরিয়ে গেছে), চীন আসিয়ান ও বিমস্টেক দেশগুলি সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের অর্থনীতিতে নিজেকে সংযুক্ত করে ফেলেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে নীচের সারণিতে বিমসটেক দেশগুলির সঙ্গে চীনের আন্তর্সম্পর্ক দেওয়া হলো। চীন যেহেতু এই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মূল দেশ, তাই এই আন্তর্সম্পর্কগুলোর মূল্যায়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষত বিজ্ঞানীরা যেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে ভবিষ্যতে পৃথিবী জুড়ে কোভিড-১৯ (Covid-19) -এর আরও প্রাদুর্ভাব হতে পারে বলে।

চীনের সঙ্গে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা।

সূত্র: সৌম্য ভৌমিক, কোভিড-১৯ এর বিপর্যয়ের মাঝে বিমসটেকের অবস্থা। ওআরএফ (ORF) প্রকাশনা,চাইনীজ স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুক ২০১৮‚ ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অফ চায়না থেকে সৌম্য ভৌমিকের নেওয়া তথ্য।

সৌম্য ভৌমিকের পর্যবেক্ষণকে সমর্থন করে এটা বলা যায় যে এই মহামারীর পরে ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার এবং বিশ্বায়নের ধরণ’ সংশোধিত হবে। মানুষের মনে চীনা তথ্যের প্রতি অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। তা সে অর্থনৈতিক বিকাশের তথ্য হোক বা করোনা ভাইরাসের আপডেট। এটা সত্যি যে সংক্রামিত হাজার হাজার চীনা নাগরিকের থেকে আবার করোনা ভাইরাস জরুরী-পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে ( ঠিক যেমন এই মুহূর্তে পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ)

বিমসটেকে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর উপর নির্ভর করছে এই অঞ্চলে চীনের (China) চীনের (China) আধিপত্যর ভবিষ্যৎ! এখনই সময় এসেছে যখন দেশগুলো চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সংযোগজনিত বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবে।

আর এই পরিস্থিতিতে তাদের বিকল্প পছন্দ খুব সম্ভবত ভারত (India)। ভারতেরও বিমসটেক বা আসিয়ান দেশগুলিকে বন্ধু হিসাবে পাওয়া প্রয়োজন। আর স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব এখানে পরোক্ষ ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবে।

ট্রাম্প যদি মোদীর উদাহরণ অনুসরণ করেন তবে অবশ্যই ভালো করবেন। ভবিষ্যতে অনেক অর্থবহ সহযোগিতার জন্য আমেরিকা-ভারত সহযোগিতার ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই তৈরী হয়ে আছে। আমরা পৃথিবীকে শান্ত এবং সংঘর্ষবিহীন দেখতে চাই। কোভিড-১৯ (Covid-19) ভাইরাস পৃথিবী জুড়ে সংঘর্ষের পরিমাণ অনেক কমিয়ে এনেছে। এখনই ভারতের জন্য সঠিক সময় যাতে সে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্বাবনা এড়িয়ে যেতে পারে। এই সংকটের মাঝে সহনশীলতা, নমনীয়তা ও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়ে ভারতের উচিত তার চিরকালীন মহৎ ভাবমূর্তি বজায় রাখা। যুগে যুগে ভারতীয় দর্শন মানবজাতিরকে পথ দেখিয়ে এসেছে আর এবারও ভারতই বিশ্বকে সঠিক পথে নেতৃত্ব দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.