ষষ্ঠ অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

#ষষ্ঠ_অধ্যায়

বৈদিক যুগে অমান্ত বা পূর্ণিমান্ত মাসগুলি ৩০ দিবস নিয়ে গঠিত হতো । অর্থাৎ ৩০ দিন X বারো মাস = ৩৬০ দিন।  তখন ৩৬০ দিনে বছর গণনা হতো।  যেহেতু সৌরবর্ষের তুলনায় চান্দ্রবর্ষ কম , তাই তারা আড়াই চান্দ্রবর্ষে একটি অধিক মাসের গণনা করতেন। এই মাসটিকেই বলা হয় #মলমাস বা অধিমাস। বেদাঙ্গ জ্যোতিষ গ্রন্থে আমরা প্রথম পাই ৩৬৬ দিনে বছরের হিসাব। শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে এই বছর গুলিকে পাঁচটি নামে পরিচিতি দেয়া হয় এবং একটি যুগের কল্পনা করা হয়। অর্থাৎ , পাঁচ বছর নিয়ে গঠিত হয়েছে এক যুগ । পাঁচ বছরের নাম পূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি ।সেগুলো আমি আবারও বলছি : সংবৎসর , পরিবৎসর, ইদাবৎসর , ইৎবৎসর এবং অনুবৎসর। 


উক্ত নামগুলি থেকেই পরবর্তীকালে সংবৎ, বৎসর ,বর্ষ ইত্যাদি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীকালে অব্দ শব্দটিকেও বৎসর অর্থে ব্যবহার করা হতে দেখা যায়। যদিও তার প্রকৃত অর্থ একটু দূরে অবস্থিত :  কালের নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাল ও মহামায়া। তাঁরাই ত্রিকাল রূপে অর্থাৎ বৎসর, মাস এবং ঋতু রূপে অবস্থান করেন। যজুর্বেদে তাই যজমানের মঙ্গলের জন্য  মাস ঋতু ও বছরের আহ্বান জানানো হতো। মরু বৈদেশিক আক্রমণ এরপর সংবৎসর বা সংবৎ  আরবি ভাষায় #সন হিসেবে চিহ্নিত  হয়।  সেইসঙ্গে গৃহীত হয় সাল শব্দটি। যদিও সাল শব্দ একটি ফারসি শব্দ।

ব্রিটিশ শাসন চলিত হওয়ার পূর্বে কমবেশি ৩৩ টি সংবৎ প্রচলিত ছিল ভারতবর্ষে । আলবেরুনীর ন্যায়  এসব নানা সংবতের চলন দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাও। সেই সমস্ত সংবাৎগুলো যথাক্রমে : সপ্তর্ষি সংবৎ , কলিযুগ সংবৎ , বীর নির্বাণ সংবৎ, বুদ্ধ নির্বাণ সংবৎ, মৌর্য সংবৎ,  সেলিউকিরি সংবৎ, বিক্রম বা মালব সংবৎ , শক সংবৎ , কলচুরি সংবৎ, গুপ্ত সংবৎ, হর্ষ সংবৎ, গাঙ্গেয় সংবৎ, ভাটিক সংবৎ, কোল্লম সংবৎ, নেওয়ারি সংবৎ, চালুক্য – বিক্রম সংবৎ, সিংহ সংবৎ, লক্ষণ সেন সংবৎ, পুড়ু বৈপ্পু সংবৎ,  রাজ্যাভিষেক সংবৎ, বার্হস্পত্য সংবৎ ( ১২ বছর আবর্তন) , বার্হস্পত্য সংবৎ  ( ৬০ বছর আবর্তন) , গ্রহপরিবৃত্তি সংবৎ ,  সৌর বর্ষ , চান্দ্র বর্ষ,  হিজরী সন ,ফসলী সন ( উত্তর দক্ষিণ) ,  বিলায়তি সন , আমলি সন , বাংলা সন,  মগি সন , এলাহি সন ।

জ্যোতিষ পন্ডিত গনের প্রচারিত কয়েকটি সংবৎসর ব্যতীত বাদবাকী সবগুলোই বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বা মার্গ সম্প্রদায়ের কোনো প্রবক্তার জন্ম অথবা মৃত্যু কিংবা রাজা মহারাজা অথবা নবাব ঘোষিত সংবৎ । 
একটি যুদ্ধ জয় , সিংহাসন আরোহণ বহু সংবৎ সূচনার কারণ । রাজা বাদশাদের দ্বারা ঘোষিত সংবৎ পূর্ব প্রচলিত সব কিছুর সঙ্গে সংবৎকেও অবলুপ্ত করত।নতুন সংবৎ , নতুন সম্রাট, নতুন বছরের সূচনা ঘটতো। 

বিক্রম সংবৎ এবং শক সংবৎ সম্পর্কে এক্ষেত্রে আলোচনা অতীব জরুরি।  ভারতবর্ষের দুটি সংবৎ আজও প্রচলিত । এবার বলি বিক্রম সংবৎ কি ?

বিক্রম সংবৎ ভারতীয় নৃপতি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য কর্তৃক প্রবর্তিত একটি অব্দবিশেষ। এটি ভারতের একটি বহুল প্রচলিত অব্দ এবং নেপালের জাতীয় অব্দ। বিক্রম সংবৎ জাতীয় অব্দ হিসেবে স্বীকৃত হলেও এর পাশাপাশি গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি এবং নেপাল সংবতের প্রচলনও নেপালে ব্যাপকভাবে রয়েছে।

উজ্জয়িনী নগরীর চন্দ্রবংশীয় রাজা বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করে তার বিজয়োপলক্ষে ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রবর্তন করেন চান্দ্র অব্দ বিক্রম সংবৎ। বিক্রম সংবৎ গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি থেকে ৫৬.৭ বছর এগিয়ে রয়েছে। এটি একটি চান্দ্রাব্দ এবং প্রাচীন সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে তিথি মতে গণিত হয় এই অব্দের মাস এবং দিনাঙ্ক। উত্তর ভারত এবং নেপালে এই অব্দে নববর্ষারম্ভ হয় চান্দ্র চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে। কিন্তু পশ্চিম ভারতে এই একই অব্দ আরম্ভ হয় চান্দ্র কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে।অনেক গবেষক মনে করেন বিক্রম সংবৎ প্রকৃত পক্ষে মালব সংবৎ। মহারাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছিল বিক্রম সংবৎ। তবে বিক্রমাদিত্য একটি উপাধি । 
রাজা হাল সংকলিত প্রাকৃত ভাষায় লেখা , #গাহা_সত্তসঈ বা গাঁথা সপ্তসতী থেকে জানতে পারা যায়, সেই গ্রন্থ সংকলন পূর্বে বিক্রম নামের প্রসিদ্ধ এক রাজা ছিলেন। রাজা হাল , যিনি সংকলনটি প্রস্তুত প্রস্তুত করেছেন , তিনি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের পরে কোনমতেই নন। তাই কয়েকজন ঐতিহাসিক মনে করেন  বিক্রমাদিত্য মালব জাতির কোনো এক আদি এবং প্রধান রাজা ছিলেন  বিক্রমাদিত্যকে নিয়ে বহু বহু কিংবদন্তি গল্প গাথা আছে । যেমন  – সিংহাসন বত্রিশ , বেতাল পঞ্চবিংশতি। 
 আলবেরুনী এ সম্পর্কে জানান  , অত্যাচারী এক শক রাজাকে হত্যা করার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা বিজেতা কে সম্মান জানাতে বিক্রমাব্দ ঘোষণা করেন ।


এবার আসি শকাব্দে। 
শকাব্দ (অথবা শালীবাহনাব্দ) হল ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর অব্দ। ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রচলিত হয়। শকাব্দের উৎস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে প্রাচীন ভারতীয় নৃপতি শালীবাহনের প্রয়াণ দিবস থেকেই শকাব্দের সূচনা। রাজা শালীবাহনের রাজত্বকালে একবার বহিরাগত শক জাতি তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে। তখন শালীবাহন শকদের পরাজিত করেন এবং ‘শকারি’ উপাধি গ্রহণ করেন। সেখান থেকেই এই অব্দের নাম হয় শকাব্দ। শকাব্দ একটি সৌর অব্দ এবং পূর্বে এর মাস এবং দিনাঙ্ক গণিত হত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে উদ্ভূত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিষয়ক গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্তের’ সৌরবর্ষ গণনার বিধি মান্য করে অর্থাৎ রবিসংক্রান্তি অনুসারে।

একটি রাশি থেকে অপর একটি রাশিতেসূর্যের আপাতগমনের(প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ফলে মাস পরিবর্তিত হত।পূর্ব ভারতে প্রচলিত বঙ্গাব্দে এবং ভাস্করাব্দে বর্ষগণনার ক্ষেত্রে এখনও এই প্রাচীন পদ্ধতিটিই অনুসৃত হয়ে থাকে। শকাব্দে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সময়ে বর্ষারম্ভ হত। যেমন উত্তর ভারতে বছর শুরু হত চৈত্র মাসে কিন্তু পূর্ব ভারতেনববর্ষ অনুষ্ঠিত হত বৈশাখ মাসে। ভারতীয় ইতিহাসের আধুনিক যুগেও অন্যান্য অব্দের পাশাপাশি শকাব্দের ব্যবহার বহুলভাবে লক্ষিত হয়। আসামে “ভাস্করাব্দ” নামক একটি অব্দ প্রচলিত থাকলেও শকাব্দের ব্যবহারই বহুল প্রচলিত। সূর্যসিদ্ধান্তের প্রাচীন নিয়ম মেনেই অসমে  বহাগ (বৈশাখ) পালিত নববর্ষ উৎসব “বহাগ বিহু” থেকে শকাব্দ গণনা করা হয়।ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক এবং সাময়িক পত্রে শকাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”।
অনেকে আবার মনে করেন কনিষ্ক , অনেকে মনে করেন ক্ষত্রিয় নহপান অথবা শকরাজা অজ এই অব্দের প্রবর্তক। 


এই প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র সরকার  বলেছিলেন :
প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে কোনোও অব্দ বা সালের ব্যবহার সুপ্রচলিত ছিল না। তখন রাজগণের রাজ্য সংবৎসরই দলিলপত্রের তারিখ হিসাবে ব্যবহৃত হত।শক, পহলব ও কুষান বংশীয় রাজগনের লেখ মালায় সর্ব প্রথম সালের ব্যবহার দেখা যায়। বুদ্ধ পরিনির্বানাব্দের ব্যবহার কেবল মাত্র বৌদ্ধ বিহারের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। 

রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে কলহন সপ্তর্ষি সংবৎকে লৌকিকাব্দ অর্থাৎ কাশ্মীর অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ভাবে এই বর্ষাঙ্ক প্রচলিত থাকায় একে যেমন লৌকিকঅব্দ অথবা কাল বলে মনে করেন , তেমনি এর বিপরীতে অবস্থান করে কল্যব্দ বা কলিযুগ সংবৎ। 
জ্যোতিষীদের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল কলিযুগ সংবৎ।  সত্য , ত্রেতা, দ্বাপর যুগের সূচিত হয় কলিযুগ সংবৎ। অনেক বিতর্ক থাকলেও  শকাব্দের ৩১৭৯ বৎসর পূর্বে বর্তমান কলিযুগের সূচনা হয়।  ৭৮ খ্রিস্টাব্দে শকাব্দের সূচনা হয়। 


সূর্যসিদ্ধান্ত মতে , ৩১০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলি যুগের সূচনা হয়। গ্রহপরিবৃত্তি সংবৎ জ্যোতিষগণের দ্বারা প্রচলিত।  এই সংবৎ তামিলনাড়ুর জনসাধারনের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল ঠিক যেমন কাশ্মীরের সপ্তর্ষি সংবতের মতো। এটি ছিল ৯০ বৎসরের একটি চক্র। ৯০ বৎসর পূর্ণ হলে পুনরায় ১ সংখ্যা থেকে বৎসর গণনা শুরু হতো। 


#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ     

     ২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ           

৩. ঋগ্বেদ সংহিতা           

৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা         

  ৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.