আজ ৬ এপ্রিল এরাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে যে বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছে তাতে অদ্ভুতভাবে একটি পরিসংখ্যান নেই। এই পশ্চিমবঙ্গে কতজন মানুষ আজ পর্যন্ত করোনা (Corona) আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তখনো পর্যন্ত ১২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪৮০টি হিট হয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের https://www.wbhealth.gov.in ওয়েবসাইট। এটি দরকারি তথ্য কিন্তু রাজ্যে কতজন মানুষকে আমরা কোভিড-১৯ এর প্রকোপে হারালাম সেটা রাজ্যবাসী জানবে না? যাদের শরীরে করোনা সংক্রান্ত রোগ ছাড়াও অন্য কোনো রোগের সন্ধান পাওয়া যাবে, তিনি কোভিড-১৯ এর শিকার হয়েছেন বলে ধরা যাবে না, এটাও এক অদ্ভুত উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত। মানে যার অন্য কোনো রোগ যেমন হাইপার টেনশন, রেনাল সিস্টেমে সমস্যা নেই এমন সুস্থ সবল মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তবেই তার মৃত্যুকে রাজ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের শিকার বলে ধরা হবে।
এটি সাঙ্ঘাতিক উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত। কারণ এক্ষেত্রে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে করোনা যুদ্ধের সামনের সারির যোদ্ধারা। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাফাই কর্মচারীরা। এমনিতেই রাজনৈতিক কারণে এরাজ্যে এই মানুষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য আমাদের রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের “আয়ুষ্মান ভারত” প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আজ কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পভুক্তদের ক্ষেত্রে, যাঁরা করোনা মোকাবিলাতে একেবারে প্ৰত্যক্ষভাবে কাজ করছেন তাদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা বীমার কথা ঘোষণা করেছেন। রাজ্য সরকার দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে তাকে ১০ লক্ষ টাকা করেছেন। তার মানে এরাজ্যে হতভাগ্য চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্যরা সরাসরি ৪০ লক্ষ টাকা কম পাবেন।
এর সঙ্গে যদি সেই ডাক্তারবাবুর হাইপারটেনশন বা ৪০ বছরের উপরে গড় বাঙালী যেসব রোগ থাকে তার কোনো একটা থাকে তবে তাঁর ” কজ অফ ডেথ” কোভিড-১৯ দেখানো যাবে না। মানে তার পরিবার ওই সামান্য ১০ লক্ষ টাকাও পাবে না।
এরাজ্যে এই সংক্রান্ত সব বিষয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড়। হাসপাতালে ডাক্তারবাবু বা নার্সদের জন্য আনা পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট ব্যবহারের অযোগ্য ছিল। সেই সত্য কথাটা জানিয়ে সঙ্গত উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন হেল্থ সার্ভিসের ডাক্তারবাবু ইন্দ্রনীল খাঁ (Indranil Khan)। সেই অপরাধে মহেশতলা থানা তাঁকে ডেকে পাঠায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারাতে মামলা করা হয়। গত ১ এপ্রিল এই মামলার রায় দিতে গিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের মহাগন্য বিচারপতি আই. পি. মুখার্জী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৯-এর প্রতি রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধ থাকা উচিত। রাজ্যের সরকারের মুখ নষ্ট হচ্ছে বলে মত প্রকাশের অধিকারকে খর্ব করা যাবে না। এই অপরাধে ডাক্তারবাবুকে থানায় ডাকা, তাঁর মোবাইল, সিম ইত্যাদি অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটক রাখা অন্যায়।
কিন্তু রাজ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অন্যায়ই হচ্ছে। দিল্লী নিজামুদ্দিন থেকে এরাজ্যে কতজন এসেছেন? তাঁদের মধ্যে কতজনের কোভিড-১৯ পজেটিভ তার সঠিক হিসেব মিলছে না।
মার্চ মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত দিল্লীর নিজামুদ্দিনের (Nizamuddin) বাংলেওয়ালি মসজিদে তবলিসি জামাতের মারকম বসেছিল। দেশবিদেশের প্রতিনিধি ডরমেটরী ঘরে একসঙ্গে ছিলেন। এই অনুষ্ঠান পরিকল্পনামাফিক কিনা সেটাও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। কারণ নিজামুদ্দিনের ঘটনা করোনা বম্বের মতো কাজ করেছে।
মার্চের ২৮ তারিখে নিজামুদ্দিনের এই ভয়াবহতা নজরে আসে। তারপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে করোনার পরিসংখ্যান। ২৮ মার্চ সারা ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০২৯, মৃত্যু ২০ জন। ২৯ তারিখে আক্রান্ত ১১৩৯, মৃত্যু ২৭; ৩০ তারিখে আক্রান্ত ১৩৪৭ জন মৃত ৩২ জন, ৩১ তারিখে সংখ্যাটা ১৬৩৫ ও ৩৫-এ দাঁড়ায় আর ১ এপ্রিল মোট আক্রান্ত ২০৫৯ জন আর মৃত্যু বেড়ে হয় ৪১ জন মানে নিজামুদ্দিনের জামাত দেশে ৪ দিনে করোনার ভয়াবহতা দ্বিগুণ করে দিয়েছে। বিগত কয়েকমাস দিল্লীর দাঙ্গা ও অন্যান্য উগ্র প্রদর্শনে দেশের অতিবিপ্লবী গোষ্ঠী এবং বিদেশী সহায়তার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সক্রিয়তায় উঠে এসেছে দেশের মধ্যেকার ভয়ানক ছবি। যা যেকোনো সুস্থ ভারতবাসীর গায়ের লোম খাড়া করে দেবে।
জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৮৫৫ জন ওই ট্রেনিং করতে গিয়েছিলেন তার মধ্যে আক্রান্ত ১৯ জন এবং ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। হরিয়ানা থেকে যে ২২ জন গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৩ জনের শরীরে কোভিড-১৯ পাওয়া গেছে। মহারাষ্ট্রে ১০৯ জনের মধ্যে ৬ জন পজেটিভ এবং ১জনের মৃত্যু হয়েছে। কর্ণাটকে ৩৪২ জনের মধ্যে ১৩ জনের শরীরে করোনা সংক্রামিত হয়েছে মারাও গেছেন ১টি মানুষ। তামিলনাড়ু থেকে ১৪০০ চিহ্নিত হয়েছেন তার মধ্যে ২৬৪ জনের শরীর সংক্রামিত এবং ১ জন মানুষ মারা গেছেন। সুদূর আন্দামান থেকে ২১ জন এসেছিলেন তার মধ্যে ১০ জনই রোগ নিয়ে ফিরেছেন। ৭১১ জন মানুষ যারা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৭০ জনই সংক্রামিত হয়েছেন। ১২০০ জন তেলেঙ্গানাতে চিহ্নিত হয়েছেন যাদের মধ্যে ৫১ জনের শরীরে কোভিড-১৯ পাওয়া গেছে, আর ৬ জন আক্রান্তের মৃত্যও হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাটাই সবথেকে গোলমেলে। ২ এপ্রিল রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল ৭১ জন মানুষই দিল্লীর ওই তবলিসি জামাতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ৫৪ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এনাদের মধ্যে ৪০ জনই বিদেশী। তাঁরা মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হল ঠিক পরের দিন ৩ এপ্রিল পুরুলিয়া জেলার পুলিশ সুপার এস সেলভা মুরুগান সাংবাদিক বৈঠক করে জানান যে তার জেলা থেকে ৫৪ জন দিল্লীর তবলিসি জামাতে গিয়েছিলেন। তাহলে হিসাব মতো অন্য সব জেলা থেকে মোট ১৭ জন গিয়েছিলেন। মানে মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুর সহ বাকি পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ১৭ জন দিল্লীতে গিয়েছিলেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ২ এপ্রিল বলেছেন যে এঁরা সকলেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। এটা অত্যন্ত কাম্য। তার মানে সঠিক আক্রান্তের সংখ্যাটাও রাজ্য সরকার খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবেন। সেই সংখ্যাটা কত? কোনো উত্তর নেই।
আজ পর্যন্ত পাওয়া একটি মাত্র সূত্র হল কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের জনসম্পর্ক আধিকারিক সঞ্জয় কুমার মুখার্জীর (Sanjay Kumar Mukherjee) ৪ এপ্রিল তারিখের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি। হলদিয়া ডকের তাদের এক ঠিকাদারের অধীনস্থ কর্মচারী বিলাল খান দিল্লীর তবলিসি জামাতে গিয়েছিলেন এবং তিনি আক্রান্ত হয়ে ফিরেছেন। পোর্ট জানিয়েছে যে কীভাবে তারা সম্ভাব্য সকলকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছেন, আর ডকের সংশ্লিষ্ট অংশ কীভাবে তারা “ম্যাসিভ স্যানিটেশন” ড্রাইভ নিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই করা উচিত।
তথ্য যত লুকানো হচ্ছে তত বিপদ বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গের। সাধারণ মানুষ বাড়তে চায়। সত্যি কথা বললে, সচেতনতা বাড়ালে মানুষই তাদের গ্রামের নিজেদের মহল্লার তবলিসি জামাতে যাওয়া লোকেদের চিহ্নিত করে দেবেন। সেটাই সুস্থ প্রশাসনিক কাজ। হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সতেরোটি এফআইআর হয়েছে হিমাচল পুলিশের পক্ষ থেকে ৮৪ জন জামাতের সদস্যের বিরুদ্ধে কেবল তথ্য গোপন করার জন্য। সেখানকার ডি.জি.পি সীতারাম (DGP Sitaram) মারভি সাংবাদিক বৈঠক করে জামাতের জেলা প্রধান বা অমীরদের ৫ এপ্রিল বিকেল ৫টার মধ্যে সম্পূর্ণ তালিকা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশ অমান্য করলে হত্যার চেষ্টার আইপিসি ৩০৭ এবং কোন হিমাচলবাসীর মৃত্যু হলে মানুষ হত্যার অপরাধে ধারা ৩০২ মাফিক মামলা করা হবে। পশ্চিমবঙ্গের মত ঘন বসতি যুক্ত প্রদেশে কি এরকম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল না? তথ্য গোপনের প্রবণতা রাজ্যকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে তা ভবিষ্যৎকালই বলবে।
এই লুকোছাপা আর খামখেয়ালিপনার সবথেকে বেশী শিকার হচ্ছেন চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এখানের সরকারী বিজ্ঞাপনে মাস্ক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে হাতের কনুই ভাঁজ করে হাঁচি কাশির কথা বলা হয়। এই নির্দেশ হু (WHO) দিয়েছে না আই সি এম আর (ICMR)? তাই রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে, কোথায় পাঠানো হবে ইত্যাদি চলে কেবল রাজনৈতিক খবর দালালিতে। ডাক্তারদের মতামতের গুরুত্ব নেই। এনআরএস হাসপাতাল রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্যতম স্তম্ভ। সেই হাসপাতালের ৩৯ জন জুনিয়র ডাক্তার সহ ৫৫ জন স্বাস্থ্য কর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হল। এত বড় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে?
এই সব প্রশ্ন তুলবে না সংবাদমাধ্যম? তাহলে সারাদিন রাত কী চালাবে বৈদ্যুতিন মাধ্যম? একজন ব্যক্তির ভাষণের রেকর্ডিং? যার ডাক্তারিতে, ইংরেজী, বাংলা ভাষা জ্ঞানে বাঙালী গর্বিত হয়ে ওঠে? মানুষকে সঠিক তথ্য জানানো, সত্যি কথা বলা, সচেতন করা মানে ভয় দেখানো নয়। সত্যি বললেই মানুষ ঘরে থাকবে, রোগ ছড়াবে না।
স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা ঠিক নয়।’ মহামান্য আদালত বলছেন, মানুষকে সত্য কথা বলতে দিন।’ কিন্তু এরাজ্যে গণতন্ত্রের চতুর্থস্তম্ভ সংবাদমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরাজ্যে এগিয়ে থাকা সংবাদমাধ্যমের একাংশে একান্ত কর্তাভজা হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত খবর বলতে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা তাঁর বিশেষ পছন্দের কয়েকজন আমলার মুখ নিঃসৃত বাণীই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে। এঁরা সুযোগ সুবিধা মত বিশুদ্ধ রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নামে বিষোদ্গার করছেন। এই যে এঁরা বলছেন কেন্দ্র এটা দেয়নি, ওটা দেয়নি। আর হীরক রাজার রাজসভার মত পাশ থেকে কেউ ঠিক ঠিক বললেন, এতে মানুষের মধ্যে আশঙ্কা ছড়াচ্ছে না?
আসলে এইসব কিছু সংবাদমাধ্যমের জন্য দেশের মধ্যে বাংলার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এই মহাবিপদের মধ্যেও এরা কেবল নিজেদের অর্থনৈতিক মুনাফার কথাটাই ভাবছেন। কিন্তু “কমিউনিটি ট্রান্সমিশন” না এড়ানো গেলে যে এই লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নেবে সেটা এনারা বুঝতে পারছেন না। এই শ্রেণীর প্রচার মাধ্যম যথারীতি ঘণ্টাখানেক নাটক করছেন। কখনো মহামহিম রাজ্যপালকে কারোকে দিয়ে অপমান করাচ্ছেন। কখনো প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। আর দিনের শেষে নিজেরা অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকছেন, আর ক্ষমতাশালীকে রাজনৈতিক ভাবে এগিয়ে রাখছেন।
সত্যান্বেষী