পঞ্চম অধ্যায় – তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে নববর্ষ

#পঞ্চম_অধ্যায়

 ভারতবর্ষে রাশির উপর প্রথম গুরুত্ব দেন #কুসুমপুরনিবাসী এক পন্ডিত। তাঁর নাম আর্যভট্ট । তাঁকে বলা হত #কুসুমপুরের_মহাজ্যোতিষী।  তাঁর মৌলিক সিদ্ধান্তমূলক #আর্যভট্টীয় গ্রন্থটির চারটি অধ্যায় যথা –  দশগীতিকা , গণিতপাদ, কালক্রিয়া ও গোলোক। তিথি বা নক্ষত্র নয় ,  দশগীতিকার প্রারম্ভে যুগের সূচনা ঘোষণা করেছেন রাশির মাধ্যমে। সেখানে মেষ রাশিকে সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। 
Starting at the beginning of Mesa at sunrise on Wednesday at Lanka.


 কিন্তু কেন মেষ রাশিকে সূচক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে ? তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি গোলক অধ্যায়ের  ২৫ সংখ্যক সিদ্ধান্তে। 
Multiply the day – radius of the circle of greatest declination ( 24 degrees) by the sine of the desired sign of the zodiac and divide by the radius of the day – circle of the desired sign of the zodiac . The result will be the equivalent in right ascension of the zodiac. The result will be the Equivalent in right ascension of the desired sign beginning with Mesa.


” আর্যভট্টীয় অব  আর্যভট্ট ” গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত শ্লোকের বিস্তৃত বিশ্লেষণ রেখেছেন কৃপাশঙ্কর শুক্লা।  অতিরিক্ত হবে ভেবেও, আযভট্ট গ্রহণ করেন দ্বিগুন কোণের অর্ধ জ্যা। সেখানে গ্রিসীয় পন্ডিতগণ সাইনের মান হিসেবে কেবল কোণের জ্যা বুঝতেন। আর্যভট্টের অর্ধ জ্যা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে জ্যা রূপে গৃহীত হয় ।
এছাড়াও তিনি গোলক অধ্যায়ের ১  সংখ্যক সিদ্ধান্ত শ্লোকে  বৈশম্পায়ন পথ বা রবি মার্গকে অবলম্বন করে উল্লেখ করেন দ্বাদশ রাশির অবস্থান । মেষ থেকে শুরু করে কন্যা রাশি পর্যন্ত রবিমার্গের উত্তরদিক আর সপ্তম রাশি তুলা থেকে শুরু করে মীন পর্যন্ত রবিপথের দক্ষিণ দিক অর্থাৎ অপরার্ধ।

Solar system illustration of the planets in orbit around the sun with labels

মেষ রাশিতে সূর্যের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যুগের সূচনা –  একথা পরবর্তীকালে বরাহমিহির স্বীকার করেছেন  তাঁর #পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে। কিন্তু  #চলা_পৃথ্বী_স্থিরাভিমি  অর্থাৎ সূর্যস্থির , পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে কিংবা চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমন করছে , সূর্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত ইত্যাদি মতবাদ সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে নানা বিজ্ঞানী যেমন  লল্ল , ব্রহ্মগুপ্ত  , ভাস্করাচার্য কেউই সমর্থন করেনি। 
 সেই সময়ের  ট্র্যাজিক হিরো কুসুমপুরের আর্যভট্ট  গ্রীক  পণ্ডিতগণের অনুশীলনে আবার তিনি আবিষ্কৃত হলেন কয়েক শতক পেরিয়ে ।

আযভট্টের সামান্য পরেই বরাহমিহির। সেই সময় ভারতবর্ষের প্রচলিত জ্যোতিষ বিষয়ক মতবাদ হল পাঁচটি  – সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত ,  পৈতামহসিদ্ধান্ত , বশিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেন বরাহমিহির তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে। এই গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত কে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান প্রদান করেন । রাশি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা ত্রয়োদশ অধ্যায় নবম সিদ্ধান্ত শ্লোকে জানান –

For the gods the rising sun , when at the first point of Aries, revolvs to the right , moving in the horizon ; at Lanka he then revolvs right overhead; and in an opposite direction for the Asura.


ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেষ রাশির ” প্রথম সূচনা বিন্দু”  সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই । অরূপরতন ভট্টাচার্য মনে করেন” মেষের আদি বিন্দু ”  বোঝাতে বাসন্ত বিষুববন কে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে একথা ঠিক যে,  বরাহমিহির আর্যভট্ট কে অনুসরণ করেই মেষ রাশি নক্ষত্র চক্রের প্রারম্ভ নির্দিষ্ট করেন। 

 এখানে একটু বিশদ হওয়া প্রয়োজন আছে।  পূর্বেই আমরা দেখেছি ২৭ নক্ষত্র কে নিয়ে মাসগুলি গড়ে উঠেছে।  কিন্তু চান্দ্রবর্ষের সঙ্গে সৌরবর্ষের কোন মিল নেই । উভয়ের পার্থক্য প্রায় ১১ দিনের মতো । অথচ সূর্যই ঋতুগুলির  নিয়ন্ত্রক। তাই কৃষির কারণে জনসাধারণের অধিক প্রয়োজন ছিল সৌরকেন্দ্রিক মাস এবং  বর্ষগণনা ।


এক একটি রাশি পেরিয়ে যেতে সূর্যের যে সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠার সৌর মাস। এই সৌরমাসগুলির অন্যতম হল মধু মাস অর্থাৎ চৈত্র মাস। চৈত্রমাসেই বৎসরের প্রারম্ভ হত একসময়। তারও পূর্বে ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মাস। তখন মৃগশিরা নক্ষত্র ছিল নক্ষত্রচক্রের প্রথম নক্ষত্র।


সম্ভবত অয়নের কারণে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ রচনা কালে ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের অমাবস্যা থেকে বর্ষ সূচিত হয়েছিল। সূর্যসিদ্ধান্তও এই মত সমর্থন করে। ঋতুগুলি সেখানে এভাবে আসে –  শিশির বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত। ধনিষ্ঠা অমাবস্যায় বছরের প্রারম্ভ ঘটলে কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্ত বিষুবন ঘটবে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় এইজন্যই কৃত্তিকা নক্ষত্রকে আদি নক্ষত্ররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।


এই বৈদিক নক্ষত্র চক্রের পরিবর্তন করেন বরাহমিহির। তিনি আদি নক্ষত্র রূপে চিহ্নিত করেন অশ্বিনী এবং শেষতম নক্ষত্র রেবতী । রাশিচক্রে মেষ এবং অশ্বিনী একই বিন্দুতে অবস্থানকারী । আর্যভট্ট এই মেষরাশি থেকে থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন । বরাহমিহির তাকে আরও বিস্তৃত করলেন। কেননা অয়ন চলন এর কারণে নৈসর্গিক পরিবর্তন পৃথিবীতে তখন দৃশ্যমান । বলাবাহুল্য , বরাহমিহিরের কথা বা ঘোষণা সবাই মেনে নিয়েছিলেন। কারণ , তিনি ভারতবর্ষের কোন গ্রাম কুসুমপুরের নয় রাজধানী অবন্তি অর্থাৎ উজ্জয়নী নগরের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি রাজধানী থেকে বলেছিলেন । তিনি সম্রাটের একান্ত নিজস্ব লোক ছিলেন এবং অবশ্যই তিনি বলার পর নতুন করে গণনা শুরু হলো। যেহেতু অয়নের জন্য ঋতু পরিবর্তন ঘটে গেছে – তাই মধু বা চৈত্র নয় , মাধব অর্থাৎ মেষ রাশির বৈশাখ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু হলো।  ভারতবর্ষে প্রামাণ্য হিসেবে বরাহমিহিরের কল্যাণে ঘটল প্রথম পঞ্জিকা সংশোধন ।


মধু ও মাধব অর্থাৎ চৈত্র ও বৈশাখ মাসে বৈদিক মানুষেরা অনুভব করেছিলেন না শীত না উষ্ণ আবহাওয়,  কুসুমাকর প্রকৃতি । কিন্তু বরাহমিহিরের কালে মাধব অর্থাৎ বৈশাখ মাসে ছিলনা বসন্ত সমীরণ ।ছিল চারিপাশের দারুন অগ্নি বাণ। তার অনেক পরে বর্ষা  আসত আষাঢ়ে। 
সেই যে কালীদাসের মেঘদূত কবিতায় বলা হয়েছে – আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং ….


প্রাচীন নিয়ম অনুসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের  ১২ তারিখ থেকে ধানের জমিতে বীজ বপন করা হয় । প্রবাদ আছে : ” জ্যৈষ্ঠের বার যত গুনতে পার।” বীজ বপনের পূর্বে দুবার কেদার বা জমি কর্ষণ করা ছিল বাধ্যতামূলক । তা ঘটত বৈশাখে।  চড়া রৌদ্র না পেলে জমির আগাছা নষ্ট হবেনা। জমির মাটি ঝুরঝুরে হবেনা।
 ঝুরঝুরে মাটিতে বীজ বোনা হবে।  মাটির ভিতরে গরমে থাকা বীজ গুলি  দু-এক সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে উঠে বিক্ষিপ্ত হালকা বৃষ্টিতে । হয়তো এই কৃষি সূচনার কথা চিন্তা করে পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন বরাহমিহির ।  


বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় কৃষি এবং আবহাওয়া সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। চাষের জন্য দুটি ঋতুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাহলো , গ্রীষ্ম ও শরৎ। বসন্তেও  ছোট খাটো চাষ কোথাও কোথাও হত।  তিনি নানা ধরনের ধান ও শস্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।  এক্ষেত্রে তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১ . লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ 

         ২. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ     

     ৩. ঋগ্বেদ সংহিতা         

  ৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা       

    ৫. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.