#জয়_হনুমান

মহাবীর হনুমান চারিদিকে চায়।

লঙ্কাপুরী পোড়াইতে চিন্তিল উপায়।।

সব ঘর জ্বলে যেন রবির কিরণ।

হেন ঘরে অগ্নি বীর করে সমর্পণ।।

মেঘেতে বিদ্যুৎ যেন লেজে অগ্নি জ্বলে।

লাফ দিয়া পড়ে বীর বড় ঘরের চালে।।

পুত্রের সাহায্য হেতু বায়ু আসি মিলে।

পবনের সাহায্যে দ্বিগুণ অগ্নি জ্বলে।।

ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু হয় অধিষ্ঠান।

ঘরে ঘরে লাফ দিয়া ভ্রমে হনুমান।।
এক ঘরে অগ্নি দিতে আর ঘর জ্বলে।

কে করে নির্ব্বাণ তার কেবা কারে বলে।।


তিনিই হনুমান , পবন পুত্র। তিনিই সাধক দেহে প্রাণবায়ু। তিনিই সীতাকে বা কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে পরমাত্মার স্বরূপ রামের নিকট নিয়ে যেতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনিই লঙ্কা দহন করেন। লঙ্কা অর্থাৎ সাধক মতে মুলাধারের লং বীজ। প্রথম পর্বে সে কথা আমি উল্লেখ করেছি।এমন দর্শনের কি বা ব্যাখ্যা?  মানবদেহে বা আমাদের শরীরের গুহ্যদেশে থেকে দুই আঙ্গুল উপরে ও লিঙ্গমূল থেকে দুই আঙ্গুল নিম্নে চার আঙ্গুল বিস্তৃত যে যোনীমন্ডল , তার উপরেই বলা হচ্ছে মূলাধার অবস্থিত। বলা হয় মুলাধার চতুর্দ্দল বিশিষ্ট। এখানে ব,  শ, ষ, স এই চার বর্ণের অবস্থানের কথাও উল্লেখ আছে। এই পদ্মের কর্নিকার মধ্যে পৃথ্বীমন্ডল তার একপাশে পৃথ্বী বীজ লং আছে বলা হয়।

যোগে বসলে সাধক মূলাধারচক্রের শক্তির একটিঊর্ধ্ব গতি অনুভব করেন। তবে এতে যে মূলাধার চক্রের মুখ খুলে যায় এমন মনে করার কারণ নেই। মুলাধারের শক্তি জাগ্রত হলে বলা হয় পঞ্চভূতের পৃথ্বী বা ক্ষিতিতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হয়। এই ক্ষিতিতত্ত্ব পরিত্যাগ হলেই তাঁকে সাধক বলা হয়। তাঁর তখন পার্থিব সঞ্চারী বৃত্তি থেকে মুক্তি ঘটে। অর্থাৎ শরীরের স্থূলতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন সূক্ষ্ম শরীরের ধারণ ক্ষমতা আসে।


 রামের লঙ্কা অভিযানের সময়, রাবনের মানসপুত্র অহিরাবনছিলো পাতাল পতি এবং অহিরাবনের পুত্রের নাম মহীরাবন। রাম যখন রাবনের সৈন্যদের মেরে ছারখার করছিলো, তখন উপায় না দেখে রাবন তার অনুগত, অহিরাবন ও মহীরাবনকে তলব ক’রে রাম লক্ষ্মনকে হত্যার নির্দেশ দেয়।

 
ত্রেতাযুগে, নাগলোকে নাগরাজার কন্যা ছিলো চন্দ্রসেনা। সেই সময় পাতাল পতি ছিলো দুই ভাই অহিরাবন ও মহীরাবন। এই দুই ভাই মিলে নাগরাজ্য দখল করে এবং নাগকন্যা চন্দ্রসেনাকে ধরে নিয়ে এসে বিয়ে করার চেষ্টা করে। এরপর রাম যখন সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, তখন রাবন তার অনুগত,অহিরাবন ও মহীরাবনকে তলব ক’রে রাম লক্ষ্মনকে হত্যার নির্দেশ দেয়। বিভীষণের রূপ ধরে অহিরাবন তার মন্ত্রের শক্তি দ্বারা পাতাল থেকে রামের শিবিরে রামের ঘর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং মন্ত্রের শক্তিতে রাম লক্ষ্মণ ক’রে অজ্ঞান করে পাতালে নিয়ে যায়।
হনুমান যখন বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে অপহরণ করা হয়েছে, তখন সেই সুড়ঙ্গ পথেই হনুমান পাতালে নেমে যায় এবং দুই নারীর কথাবার্তা আড়ালে থেকে শুনে বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। 


হনুমান সেখানে পোঁছে যায় এবং রাম লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে। সেই সময় সেখানে অহিরাবন ও মহীরাবন এসে উপস্থিত হয় এবং তাদের সাথে রাম লক্ষ্মণের যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু যতবারই তাদের হাতে অহিরাবণ ও মহীরাবন মরে ততবারই তারা জীবিত হয়ে উঠে।
 এই রহস্য জানার জন্য হনুমান সেই নারীর কাছে যায়, যার কথা আড়াল থেকে শুনে হনুমান রাম লক্ষ্মণকে খুজেঁ বের করেছিলো। তার কাছে হনুমান জিজ্ঞেস করে, কিভাবে অহিরাবন ও মহীরাবন মরবে ? 


নারীটি বলে,সঞ্জীবণী ভ্রমর, অমৃত এনে উনাদের ক্ষত স্থানে দিলে উনারা জীবিত হয়ে যায়। তুমি যদি ঐ ভ্রমরদের আসা বন্ধ করতে পারো তাহলেই অহিরাবন ও মহীরাবন মারা যাবে। এরপর হনুমান ভ্রমরদেরকে মারা শুরু করলে, ভ্রমররা আর অমৃত এনে তাদেরকে বাঁচাবে না।

অহিরাবন তার মন্ত্রের শক্তি দ্বারা পাতাল থেকে রামের শিবিরে রামের ঘর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং মন্ত্রের শক্তিতে রাম লক্ষ্মণ ক’রে অজ্ঞান করে পাতালে নিয়ে যায়। হনুমান যখন বুঝতে পারে যে রাম লক্ষ্মণকে অপহরণ করা হয়েছে, তখন সেই সুড়ঙ্গ পথেই হনুমান পাতালে নেমে মহিরাবনের মন্দিরে চলে যায় এবং সেখানে রাম লক্ষ্মণকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পেয়ে দেবী পাতাল ভৈরবীর মূর্তির পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। এরপর মহিরাবন সেখানে আসে এবং রাম লক্ষ্মণকে দেবীর কাছে বলি হওয়ার আদেশ দিয়ে প্রণাম করার ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রাখতে বললে- রাম বলে,
“আমরা তো রাজপুত্র, কোনোদিন কাউকে প্রণাম করি নি, সবাই আমাদেরকেই প্রণাম করতো, তাই কিভাবে প্রণাম করতে হয় সেটা আমরা জানি না, তুমি শিখিয়ে দাও।”


শুনে মহিরাবন বলে, “এই কথা, দাঁড়াও শিখিয়ে দিচ্ছি,” এই ব’লে মহিরাবন যেই প্রণামের ভঙ্গিতে হাড়িকাঠে মাথা রেখেছে, অমনি হনুমান মূর্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে হাড়িকাঠের শিক আটকে দিয়ে এক কোপে মহিরাবনের গলা কেটে ফেলেছে। মহিরাবন শেষ।


 এইদিকে মায়াবী অহিরাবন । তাকে কিভাবে বধ হবে। হনুমান অহিরাবণের প্রাসাদে প্রবেশ করে দেখতে পান, সর্বত্র উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। এই আলোগুলি না নেবালে অহিরাবণকে বধ করা সম্ভব নয়। তিনি তখনই পঞ্চমুখী রূপ গ্রহণ করেন এবং পাঁচ মুখে ফুঁ দিয়ে সমস্ত আলো নিবিয়ে দেন এবং রাম লক্ষ্মণ অহিরাবণকে বধ করেন।


হনুমানের এই পাঁচটি মুখের স্বতন্ত্র নাম রয়েছে। সেগুলি এই— হনুমান, হয়গ্রীব, নরসিংহ, গরুড় এবং বরাহ। এই পঞ্চমুখ অবশ্যই প্রতীকী। হনুমান পবনপুত্র। পবন বা বায়ু পঞ্চভূতের অন্যতম। পাঁচটি ভৌতজগৎকে পেরিয়ে সীতা অর্থাৎ ভূমিকে স্পর্শ করতে হয়। সার্বিকভাবে রামায়ণের এই ব্যাখ্যা দক্ষিণ ভারতে বেশ জনপ্রিয়। পাঁচ— এই সংখ্যাটির আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিপুল।  প্রার্থনার পাঁচটি রূপ— নমন, স্মরণ, কীর্তন, যাচন, অর্পণ। হনুমানের পঞ্চমুখকে এই পাঁচটির প্রতীক বলে মনে করেন অনেকে।
পঞ্চমুখী হনুমানের উপাসনা উপাসককে জগতের সঙ্গে যুক্ত করে, মোক্ষের পথ উন্মুক্ত করে বলেই বিশ্বাস করেন ভক্তজন।

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.