ইংরেজিনবিশ হয়েও, কর্মক্ষেত্রে ইংরাজি লিখনের পারিপাট্যে ও ইংরাজি বলনের অনবদ্যতায় প্রশংসা পেলেও সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Bankimchandra Chattopadhyay)উপলব্ধি করেছিলেন, যতদিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙালিরা বাংলা ভাষায় আপন উক্তি বিন্যস্ত করবেন, ততদিন বাঙালির কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি প্রথম উপন্যাস ইংরাজিতে লিখলেও (১৮৬৪), পরে বাংলা ভাষার অগণ্য অমূল্য রতন নিয়ে শুরু করলেন কালজয়ী বাংলা কথা-সাহিত্য সাধনা। তৈরি করলেন বাংলা ভাষার লেখক ও পাঠককূল। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা হয়ে উঠল তার এই চিন্তনের অন্যতম ব্যবহারিক প্রয়োগশালা।
ইংরাজি সাহিত্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় ও ইংরাজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের সুলুকসন্ধানকে তিনি অস্বীকার করেন নি। বলেছেন, আমরা ইংরাজি বা ইংরেজের দ্বেষক নই। ইংরেজ থেকে এ দেশের লোকের যত উপকার হয়েছে, ইংরাজি শিক্ষাই তার মধ্যে প্রধান। অনন্তরত্নপ্রসূতি ইংরাজি ভাষার যতই অনুশীলন হয়, ততই ভাল। সমাজের মঙ্গলের জন্য কতকগুলি সামাজিক কাজ রাজপুরুষের ভাষাতেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। আমাদের এমন অনেক কথা আছে, যা রাজপুরুষদের বোঝাতে হবে। অনেক কথা আছে তা কেবল বাঙালির জন্য নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ তার শ্রোতা হওয়া উচিত। তবুও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিন কোটি বাঙালি তিন কোটি ইংরেজ হতে পারে না, পাঁচ-সাত হাজার নকল ইংরেজ সিংহচর্মাবৃত শৃগাল ছাড়া আর কিছু নয়। সমগ্র বাঙালির উন্নতি না হলে দেশের কোনো মঙ্গল নেই। দেশের সব লোক বোঝে না, শোনে না, সে কথায় সামাজিক কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই।
বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির ইংরাজিতে লেখা সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। তাই রমেশচন্দ্র দত্তের ‘Three years in Europe‘ বইয়ের সমালোচনায় লিখেছেন, “বাঙালি হইয়া যিনি ইংরাজিতে কবিতা রচনা করেন, আমরা তাঁহার প্রশংসা করিব না, ইহা আমাদের স্থির প্রতিজ্ঞা। সুতরাং তাঁহার কবিতার প্রশংসা করিতে পারিলাম না।”
‘লোকরহস্য’ প্রবন্ধ-সংগ্রহ গ্রন্থের ‘বাবু’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষা বিরোধী, তাহারাই বাবু। … এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। … যাঁহার কথোপকথনে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু।” ‘ইংরেজস্তোত্র’ প্রবন্ধে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করে লিখেছেন, “হে মিষ্টভাষিন! আমি মাতৃভাষা ত্যাগ করিয়া তোমার ভাষা কহিব; … তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও! আমি তোমাকে প্রণাম করি। … আমার স্পীচ শুন, আমার এশে পড়, আমায় বাহবা দাও, … আমি তাহা হইলে সমগ্র হিন্দুসমাজের নিন্দাও গ্রাহ্য করিব না। আমি তোমাকেই প্রণাম করি।”