সারা বিশ্ব যখন করোনা আতঙ্কে দিশাহারা, চীনের (China) পর তার করাল থাবা ইউরোপের সভ্যতা ধ্বংস করে আমেরিকা (America) কাঁপাচ্ছে, তখন হামাগুড়ি দিয়ে একটা দুটো করে ভাইরাস সংক্রমণের খবর ভারতেও (India) আসছিল। আর তারপর হঠাৎ নিজামুদ্দিন (Nizamuddin) মারকাজে তবলিগী জামাত অনুষ্ঠিত হল, পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এই রোগ। প্রায় 11,000 জামাতি এখানে ধর্ম প্রচারের জন্য জমায়েত হয়েছিল। দেশ বিদেশ থেকে তারা এই নিজামুদ্দিনে (Nizamuddin) এসেছিল আর তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। এখনও সবাইকে ধরা সম্ভব হয় নি। বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এর মধ্যে সব থেকে অদ্ভুত হচ্ছে তামিলনাড়ু থেকে পাওয়া তথ্য। আজকের হিসাব অনুযায়ী 690 জন আক্রান্তের মধ্যে 636 জন তবলিগী জামাত ফেরত। এর মধ্যে কোন বৈসাদৃশ্য কি পাওয়া যাচ্ছে?
তামিলনাড়ু (Tamil Nadu) এমন এক রাজ্য যারা তামিল বাদে অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে নিরন্তর। ভাষার জন্য এরা এতটাই নিবেদিত প্রাণ যে তামিল ভাষা এদের কাছে একটা গর্বের পরিচয়। এর জন্য এরা কম লড়াই করে নি। এমনকি 2019 এ যখন বিজেপি (BJP) সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করল, লেফ্ট লিবারেল গোষ্ঠী তাদের জঘন্য মিথ্যা প্রচারের হাতিয়ারকে সম্বল করে প্রচার করতে থাকে যে কেন্দ্র সরকার সরকারী ভাষা হিসাবে হিন্দীকে চাপিয়ে দেবে। ডিএমকে নেতা স্টালিন বিরাট প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের সাথে যোগ দেয় বাংলা পক্ষ। এরা একযোগে প্রচার করতে থাকে যে হিন্দীকে সরকারী ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছে মোদী সরকার যেটা তারা কোন ভাবেই মেনে নেবে না। অথচ এই তামিলনাড়ু (Tamil Nadu) থেকে প্রচুর লোক তবলিগী জামাতে উপস্থিত ছিল। তবলিগী জামাত এর প্রধান মৌলানা সাদ চোস্ত উর্দুতে কথা বলছে, দেখা গেছে সব মিডিয়ায়। তবলিগী জামাত তাদের সম্মেলনে উর্দু ও আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করে না। তাহলে কৌতুহল তো থেকেই যায় যে হিন্দী না বলা তামিল জামাতিরা কোন ভাষায় দিল্লীর জামাতে ভাবের আদানপ্রদান করেছে। মৌলানা সাদের সঙ্গে কোন ভাষায় জামাতিরা কথা বলেছে। একটা মাধ্যম তো চাই কথা বলার বা বোঝার জন্য। মৌলানা সাদ নিশ্চয়ই তামিল ব্যবহার করে নি! যে কোন মুসলিম আরবী ভাষায় তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠকে আভিজাত্য বলে মনে করে। প্রতিদিন পাঁচ বার যে আজান দেওয়া হয় সেটাও এই আরবীতে। সমস্ত মাদ্রাসার ভাষা হিসেবে আরবী বাধ্যতামূলক। উর্দুকে মুসলিম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার বহুল প্রচলন হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্নৌ বা যে কোন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেখানে স্থানীয় ভাষার থেকে উর্দু বা আরবীতে জোর দেওয়া হয় মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য। এরা আরবীতে নাম রাখে তা সে যতই প্রগতিশীল হোক বা আধুনিক হোক। যে কোন রাজ্যের যে কোন ভাষার মানুষ শুধু মাত্র মুসলিম হলেই তাদের এই ভাষা প্রেম এতটাই গভীর যে সেখানে আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য লোপ পায়। তাই যে তামিলরা হিন্দী চাপানোর প্রতিবাদে এক সময় উত্তাল প্রতিবাদ করেছে তারাই আবার মুসলিম হলে সেই অস্মিতা, ভাষা প্রেম ভুলে গিয়ে মুসলিম পরিচয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
এদেশের লেফ্ট লিবারেল সমাজ বরাবর হিন্দু ধর্মের উপর বিদ্বেষ পোষণ করে এসেছে। এরা মারকাজ নিজামুদ্দিন (Nizamuddin) ফেরত উগ্রপন্থী জঙ্গীদের সাথে বৈষ্ণো দেবী বা তিরুপতিতে আটকে যাওয়া হিন্দু তীর্থযাত্রীদের তুলনা করেছে। অথচ একবারও সঠিক কথা সঠিক ভাবে বলার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই। এরা একবারও বলছে না যে হিন্দু তীর্থ করতে যারা যায় তারা ধর্মপ্রচার করে না। তারা মন্দিরে মাথা নোয়ায়, ফুল বেলপাতা চড়ায়, নিজের ও পারিবারিক সবার মঙ্গল কামনা করে, ফিরবার সময় একটু প্রসাদ নিয়ে আসে পরম শ্রদ্ধায় আর বিশ্বাসে। সেই বিশ্বাসে অন্যের হানি করার কথা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে না। তারা সম্মেলন শেষ হবার পরে দশ দিন ধরে লুকিয়ে থাকে না রোগ ছড়ানোর জন্য। তারা যে ভজন কীর্তন করে, তাতে বিশুদ্ধ ভক্তি থাকে। আর অন্য দিকে যাদের হয়ে আমাদের সুশীল উদার সমাজ, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ গলা ফাটায়, তারা রাত থাকতে সবাইকে শব্দ দূষণের মাত্রাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একত্র হবার নির্দেশ দেয়। সেই ধর্মীয় নির্দেশে আরবী ভাষায় বলা হয়, কারা ইসলাম অবিশ্বাসী। ইসলাম অবিশ্বাসী কাফেরের সঙ্গে সহাবস্থান এদের কাছে অপরাধ, পাপ। আর পাপ স্খলন করবে যে সেই হবে শহীদ। আর এই সব বক্তব্যের সূত্রধার ওই আরবী ভাষা।
লেফ্ট লিবারেল সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন, কোন তামিল অটো চালক যখন হিন্দী গান শোনে, তা অপরাধ হয়। অথচ জামাত ফেরতদের জন্য কোন ফতোয়া থাকে না। তবে কি ভাষার ব্যবহার আসলেই ধর্মের উপর ভিত্তি করে? এই রাজ্যের বাংলা পক্ষ জামাত প্রিয় সুশীল সমাজ যারা সবসময় হিন্দী ভাষা ও হিন্দী ভাষীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছে, তারা কি একবারও তাদের ঘোমটার ভিতর খেমটা নাচ করতে গিয়ে সত্য কথা স্বীকার করার বুকের পাটা দেখাতে পারবে? চৌত্রিশ বছরের বাম অপশাসনের ফলে ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ‘ প্রচার করা লোকেরা ক্লাস সিক্স থেকে ইংরাজী শেখানোর মাধ্যমে যে কয়েক প্রজন্ম ইংরেজী না শেখা প্রজন্ম তৈরি করেছে, যারা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিদারুণ পিছিয়ে গেল, তারা অন্য রাজ্যে গেলে কোন ভাষায় কথা বলবে? মুসলিমদের তো সমস্যা হবে না, কারণ তাদের একটা কমন ভাষা আছে, উর্দু বা আরবী। বাকি বাঙ্গালী তো ইংরেজী না জেনে, হিন্দী না শিখে পিছিয়েই যাবে ক্রমশঃ। তাতে কি অবিভক্ত বাংলাস্তান গঠনে সুবিধা হবে? নাকি ওদিকে তামিল অস্মিতা আবার উর্দু বা আরবীর বিরুদ্ধে জেগে উঠবে? প্রশ্নটা থেকেই গেল।
দেবযানি হালদার (Debjani Haldar)