“আমার স্ত্রী দিল্লিতে চাকরি করে। মেয়ে অরুনা সেন্ট স্টিফেন্সের স্নাতকোত্তরে চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। ছেলে উর্ণাভ দিল্লির একটি নামী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। দিল্লি থেকে ওরা শান্তিনিকেতনে এসেছিল বিশ্বভারতীর বসন্ত উৎসব দেখতে। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগেই হল ছন্দপতন। কেন্দ্রীয় সরকার করোনার ব্যাপারে সর্তকতা জারি করল। শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠান হল না। ওদের ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল হয়ে যায়।” আলাপচারিতায় এ কথা জানালেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। বললেন, “বিশ্বভারতীতে আমরা চারজন পরস্পরকে সারা দিন কাছে পাচ্ছি। আমরা এ রকম অনাবিল পারিবারিক জীবন আগে খুব একটা পাইনি। এটা আমাদের সকলের কাছেই একটা বড় পাওনা।”১৯৮৪-তে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সাইন্সের পিএইচডি, জেএনইউ-এর পরিচালন সমিতিতে রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রাক্তন সদস্য বিদ্যুৎবাবু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। পরিবারের উপস্থিতির পাশাপাশি বিশ্বভারতীর এই পরিবেশ আর প্রকৃতিও ভাললাগার পরিবেশ গড়ে তুলেছে। কে বলছিলেন, “এমনিতে আমি ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠি। তার পর হাঁটতে যাই। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে হাঁটা বন্ধ। সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ উপাচার্যের বাসভবন ‘পূর্বিতা’-র দ্বিতল বারান্দায় এসে বসি। কত রকম পাখি। যেন তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলে। ছোট-বড় নানা গাছ। একটা গাছ তো প্রায় দেড়শো ফুট উঁচু! আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, ফুলগাছ— সবুজের সমারোহে একটা অন্য আনন্দ।”এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। কিভাবে সময় কাটাচ্ছেন? বিদ্যুৎবাবু জানান, “ডুবে গিয়েছি গবেষণায়। আমি আপাদমস্তক রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তাঁর প্রতিটি ভাবনা, অনুপ্রেরণা আমার অস্থিমজ্জায় মিশে। রবীন্দ্রনাথের উপর নানা দিক থেকে প্রচুর লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সেভাবে গভীর চর্চা হয়নি। রোমা রোঁলার চিঠি, গান্ধীজীর অনুভব, ১৯৮১ সালে ম্যাকমিলন প্রকাশিত এডওয়ার্ড থম্পসনের বই, প্রকাশিত কিছু ছোট রচনায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গেলে সামাজিক রবীন্দ্রনাথকে ভালভাবে বোঝা দরকার। তাই এই বিষয়টার উপর আমি গভীরভাবে চর্চা করছি।”কাজটা শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। কিন্তু অন্য ব্যস্ততায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলাম না। লকডাউনে তার পুরো সদ্ব্যবহার করছি। এর মধ্যেই কাজটা শেষ করে ফেলতে চাইছি। ইংরেজি বইটি প্রকাশ করবে অক্সফোর্ড। ক’দিন বাদে ‘দেশ’ পত্রিকায় এ সম্পর্কে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হবে। সেটির শিরোনাম ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সমাজচিন্তা’। কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বলেই নয়, বিভিন্নভাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও স্বীকৃতি বিশ্বজোড়া। এর আন্তর্জাতিক মান আরও উন্নত করতে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। গান-বই-গবেষণা-পরিবার— যা ই প্রাধান্য পাক, দায়িত্বের কথাটা সব সময়ে গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখেন। বললেন, “আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি একটা অদৃশ্য শক্তি আছে। তিনি ঠিক সময়ে সব কিছুর মূল্যায়ণ করবেন!”কেমন লাগছে? প্রশ্নের জবাবে বললেন, “আমার জন্ম এই বীরভূমেই ১৯৫৭ সালে। ১৯৬৪ পর্যন্ত ছিলাম এই জেলাতেই। তার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শহরে নানা সময় কাটিয়ে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছি গত বছর ৯ নভেম্বর। তাই নতুন করে ছেলেবেলার মাটির স্বাদ অনুভব করছি। আর এই প্রতিষ্ঠানে আমার পূর্বসূরীরা প্রায় সকলেই এখানকার আবাসিক নন, কর্মী ছিলেন। আমার স্থায়ী সাকিন কিন্তু এই ‘পূর্বিতা’! এটা ভাবলেও ভাল লাগে। ”
2020-04-08