শাকম্ভরী দুর্গা কৃষি দেবী:
আদিম মানুষ একটি জিনিস খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বুঝেছিল যে, সন্তান আর শস্য দুই-ই উৎপাদন; সন্তান ধারণ করেন মা আর শস্যের জন্মস্থান মাটি। মাটির গর্ভে ফসলের জন্ম। সুতরাং মাটিও মা; ফসল নিয়ে আবির্ভূত পৃথিবী মাতৃদেবী।
মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা (Mahenjodaro-Harappa) থেকে প্রাপ্ত মাতৃদেবী মূর্তি ভারতবর্ষের মাতৃমূর্তির প্রাকরূপ; তা ছিল পৃথিবী মূর্তি — সেখানে একটি মূর্তির ক্রোড়দেশ থেকে একটি গাছকে বের হতে দেখা যাচ্ছে। মাটি বা পৃথিবী প্রাণশক্তি ও প্রজনন শক্তির প্রতীকরূপে আদিম কৌম সমাজের আরাধ্যা। পৃথিবীপুজোর এই ‘মিসিং লিঙ্ক’ আজও সবদেশে সবজাতি গোষ্ঠীতে চলছে। নল সংক্রান্তির সময় বাংলায় যে নলপূজা অনুষ্ঠিত হয়, গর্ভিণী ধানের সাধভক্ষণ উৎসব হয়, তাও প্রকারান্তরে পৃথিবী-পুজো।
আজ বাসন্তী পূজা (Basanti puja)। মহামুণি মেধষের আশ্রমে রাজ্যচ্যূত মহারাজা সুরথ ও শ্রেষ্ঠী সমাধি এই তিথিতেই দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম শ্রবণ করেন এবং মর্ত্যভূমে সেই পূজার প্রচলন করেন। বসন্তকালের দেবীর এই আরাধনাই বাসন্তী পূজা বলে খ্যাত। শিশু কিশোর মঞ্চের ময়ূখ মুখোপাধ্যায়, চণ্ডীপাঠ ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে দেবীর আরাধনা করল।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণে দেবী দুর্গাকে ‘শাকম্ভরী‘ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টিকালে দেবী ফসল-শাকসব্জি দ্বারা লোকপালন করেছিলেন। যদি দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী‘ হবেন এবং ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা‘-ই হবে, তবে দেবী অন্নপূর্ণা কৃষকের গোলায় অধিষ্ঠান করে জীবনের সার্বিক দুর্গতিও নাশ করবেন — এটাই কাঙ্ক্ষিত। আর তিনি যদি মাটি বা পৃথিবীর দেবী না হবেন তবে বিশ্বের দুর্গতি দূর করবেন কীভাবে?
দেবী দুর্গার শাকম্ভরী রূপটি পরিস্ফুট হয় দেবী-আরাধনার ‘নবপত্রিকা’ বরণে। নয়টি উদ্ভিদের সপত্র শাখারূপ হচ্ছে ‘শস্যবধূ’ নবপত্রিকা। নিঃসন্দেহে দেবীপূজার এই উপকরণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেবীর অন্নদাত্রী সত্তা।
“রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকাশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।”
কলাগাছ — ব্রাহ্মণী ; কালো কচুগাছ — কালিকা; হলুদগাছ — দুর্গা; জয়ন্তী — কার্তিকী; বেলশাখা — শিবা; দাড়িমশাখা — রক্তদন্তিকা; অশোকশাখা — শোকরহিতা; মানকচুর গাছ — চামুণ্ডা; ধানগাছ — লক্ষ্মী। এরা নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী। এই নয়টি গাছকে অপরাজিতা লতা দিয়প একসঙ্গে বাধা হয়। স্ত্রী-রূপ দান করার জন্য যুগ্মবেল দিয়ে রচনা করা হয় স্তনযুগল; পরিয়ে দেওয়া হয় লালপেড়ে শাড়ি। সপত্র কলাগাছ সর্ববৃহৎ হওয়ায় তার মাথা জুড়ে ঘোমটা টানা হয় — যেন এক অবগুণ্ঠনবতী নারী, দৈব-বধূ। এর মধ্যে প্রাচীন বৃক্ষপুজোর অবশেষটি সুস্পষ্ট। এই নয়টি উদ্ভিদের কারও রয়েছে খাদ্যগুণ আবার কারও ভেষজগুণ।
ধানচাষকে কেন্দ্র করেই বাংলার প্রায় সকল লোকানুষ্ঠান। আগমনী গান গাওয়ার কাল হচ্ছে শ্রাবণী ধান পাকার পরবর্তী সময়, যখন গোলায় ভরে উঠেছে আউশধান। শালী ধানেরও ফুলেল দশা, থোড় বের হবার সময়। একদিকে আউশ ধান ঘরে তোলার আনন্দ, অন্যদিকে আমনধান ঘরে তোলার প্রার্থনা। এই দুয়ের মিলনানন্দ শারদীয়া দুর্গাপূজাকে করে তুলেছে কৃষিনির্ভর এক শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। শস্যকামনা আর শস্যনির্ভর অর্থসম্পদের কামনা নিয়েই তো দেবীপুজোর পরিকল্পনা।
শস্যঋতুর শুরুতে (আউশধানকে কেন্দ্র করে) শরৎকালে দেবীপুজোর যে সূত্রপাত, বসন্তকালে চৈত্রের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে তারই পরিণতি অন্নপূর্ণা পুজোয়। অন্নের ভান্ডার তখন পূর্ণ, নিরন্নের অন্নস্বপ্ন তখন পেয়েছে বাস্তবতা, আর তখনই তিনি অন্নদাত্রী আরাধ্যা দেবী — অন্নপূর্ণা বসুন্ধরার দয়াময়ী মাতৃরূপ।
ধানের দেবী লক্ষ্মী:
কৃষি নৃতত্ত্বের দৃষ্টিতে — পেঁচা লক্ষ্মী এবং ইঁদুর অলক্ষ্মী। সে ‘পাকা ধানে মই’ দেয়। ইঁদুরকে খাদ্য তালিকায় রেখে অনেককাল ধরে পেঁচা কৃষিজীবী মানুষের মন জয় করেছে। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু — এই নীতিতে পেঁচা একসময় Zoo-morphic থেকে Anthero-morphic হল। পেঁচা নৈশপ্রহরী, পরিবেশ-বন্ধু, উপাস্য দেবতা, ক্ষেত্রলক্ষ্মী।
কার্তিক সংক্রান্তিতে ‘আউড়ি-বাউড়ি’ উৎযাপিত হয়। মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড় পাকিয়ে দড়িতে বাঁধা হয় প্রতিটি জিনিস। আড়াই মুঠো কাটা ধানে লক্ষ্মীপুজো হয়।
অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে মেয়েরা উৎযাপন করে ইতুলক্ষ্মীর ব্রত। রবিশস্য কামনা এই ব্রতের উদ্দেশ্য। যেখানে রবিশস্যের প্রসার নেই সেখানে হৈমন্তি ধান মাড়াই-ঝাড়াই করাী শুভারম্ভে খামারেই করা হয় ইতুলক্ষ্মীর ব্রত। আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীকে ভোগ দেওয়া হয়।
পৌষসংক্রান্তির আগের দিন বাড়ির উঠোনে ‘পৌষ তোলা’-র ধানের আঁটি রেখে লক্ষ্মীপুজো করা হয়। লক্ষ্মীর আসন পেতে, ধান-কড়ি সাজিয়ে, দু-পাশে কাঠের পেঁচা রেখে লক্ষ্মীপুজো করা হয়।
সেকালে ধানই ছিল ধন। ধানের দেবী আর ধনের দেবী ছিল অভিন্ন; ধান্যলক্ষ্মীই ছিল ধনলক্ষ্মী।
সালোকসংশ্লেষের দেবী সরস্বতী :
‘সরস‘ শব্দের অর্থ জল। শুরুতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। বিদ্যার দেবীর ধারণা অনেক পরে। উর্বর নদী উপত্যকায় কৃষির ফলন ছিল পর্যাপ্ত। তাই সরস্বতী নদীতীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। সেইসূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী। সভ্যতার অভ্যুত্থান ও তার ক্রমবিকাশে নদী সবসময় সহায়ক ও সঙ্গত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই কল্পনা করা যেতেই পারে সরস্বতী নদীর দু’কূলে সৃজিত পলল মৃত্তিকার উর্বর শস্যক্ষেত্র ছিল আর্য ঋষিদের ‘শস্যাগার’।
আবার ‘সরস’ শব্দের অপর অর্থ ‘জ্যোতি‘। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে পাওয়া যায় অগ্নিরূপ, জ্যোতির্ময়ী এক দেবী রূপে। সরস্বতীর মধ্যে সূর্যকিরণের সপ্তবর্ণের ধারণা VIBGYOR এখানে পরিষ্কার। যেহেতু উদ্ভিদ দেহে বৃদ্ধি ও পরিস্ফূরণের অপরিহার্য শর্ত আলোক ও জল, সরস্বতী তাই সালোকসংশ্লেষ বা Photosynthesis প্রক্রিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৌরশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলের আবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, জলের সরবরাহকারিণী দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাই কৃষি উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘শ্রী‘ অর্থে লক্ষ্মী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে একসময় হয়তো লক্ষ্মীপুজোই হত, এখনও অনেক পরিবারে দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীকেও ভক্তি সহকারে ফুল নৈবেদ্য দেন। আর এই দিনটি থেকেই যেন শুরু হয় মুকুল-বিকাশের পর্ব, বসন্তের সৌকর্য, সুপ্তির অবসান, মনের মুক্তির মরশুম। দেবী সরস্বতী উপাসনায় লাগে পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব; ধান, যব, গম, মুগ, তিল দিয়ে এই পঞ্চশস্যের অর্ঘ্য রচিত হয় আর আম, অশোক, অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুরের বিটপ দিয়ে সাজানো হয় পঞ্চপল্লব।
পলাশপ্রিয়া হলেন দেবী সরস্বতী। পলাশের রক্ত রঙ উর্বরতার প্রতীক, আর ঋতুমতী নারীর রজোদর্শনই প্রাণীজন্মের প্রথম শর্ত। দেবী সরস্বতী তাই উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী রূপে পূজিতা; জলের দেবী, আলোর দেবী উর্বরতার দেবী।
কার্তিক নবান্নের দেবতা:
রাঢ়বঙ্গের কোনো কোনো স্থানে (কাটোয়া মহকুমা) নবান্ন উৎসবে কার্তিক পুজো হয়। এই কার্তিক ‘নবান্নে কার্তিক‘ নামে অভিহিত। ‘নবান্ন’ একটি কৃষি কেন্দ্রিক লোকানুষ্ঠান। ‘নবীন ধান্যে নবান্ন পালিত হয়। শস্যরক্ষাকর্তা দেবতাকে তুষ্ট করে শস্য ঘরে তোলার জন্য ‘নবান্নে কার্তিক’ পূজিত হয় বলে মনে করা যেতে পারে। বাংলার শস্য উৎসবে যখন শস্যদেবতারূপে কার্তিক পূজিত হন (‘নবান্নে কার্তিক‘), তখন মধ্যরাত্রে ফসল চুরির অভিনয় করা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। লোকসমাজে কার্তিক শস্য দেবতাদের অন্যতম। কার্তিক সংক্রান্তির দিন ও তার আগে এই কৃষি দেবতার ব্রত উৎযাপিত হয়। ব্রতিনীরা একটি ঘটের চারিদিকে আলপনা দিয়ে নানা আচার পালন করেন। সারা রাত গাওয়া হয় কৃষি-সংগীত; ফসলের কীটশত্রু, জীবজন্তু তাড়িয়ে ফসল সুরক্ষার কাহিনীই গানের বিষয়বস্তু। পুজো বা ব্রতানুষ্ঠানের পর কার্তিকের মূর্তি জলে বিসর্জন দেওয়া হয়না, তাকে শস্যক্ষেত্রে রেখে দেওয়া হয় ফসলের রক্ষাকর্তা হিসাবে।
লোকসমাজে দেখা যায়, সন্তান কামনায় বন্ধ্যানারী কার্তিক পুজো করেন। সন্তান উৎপাদনের দেব-দেবী কার্তিক-ষষ্ঠী যুগ্মদেবতা ভ্রূণ সৃষ্টকারী দেবতা রূপেই পূজিত। আবার লোকসমাজে কার্তিক বৃত্তি পাল্টিয়ে মানব-প্রজনন থেকে উদ্ভিদ প্রজননের দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। বারবণিতারা কার্তিকের পুজো করেন আকস্মিক ভ্রূণ উৎপাদন বন্ধ করতে।
বাহন সমেত কার্তিক উর্বরতাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কুক্কুট বা ময়ূর — কার্তিকের যে বাহনই হোক না কেন, পাখি দুটি উর্বরতা-কেন্দ্রিক। ময়ূরের মিলনানন্দ তখনই যখন বর্ষায় সজল মেঘের আনাগোনা, আর তখনই কিশলয়ের নবসৃষ্টির মরশুম। ময়ূর অগ্নির প্রতীকরূপে অভিহিত ও ব্যাখাত, আবার পুরাণে কার্তিক সূর্যসম্ভব দেবতা। ‘কুক্কুট’ শব্দের অর্থও অগ্নিপিণ্ড। বৌদ্ধ শিল্পদর্শনে কুক্কুট সূর্যের দ্যোতক হিসাবে প্রতিভাত। মোরগের কাছেই সৌরালোক প্রথম স্বাগত-সম্ভাষণ পায়।
একটি লোককথায় দেখা যায়, দেবসেনাপতি কার্তিকেয় ও দেবকন্যা ঊষার প্রপম বিবাহের কাহিনীর মধ্যে তাদের কৃষি-সম্পৃক্তি জড়িয়ে আছে। কার্তিক ঊষাকে বিয়ে করেছেন, কিন্তু তাঁর খেয়াল হল মায়ের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অনুমতি নিয়ে নিয়ম করেই নববধূকে গৃহে আনতে চান। কাজেই এক শস্যক্ষেত্রে ঊষাকে রেখে দ্রুত মায়ের কাছে গেলেন। সেদিন মায়ের অদ্ভুত আচরণে কার্তিক যারপরনাই বিস্মিত, আতঙ্কিত হয়ে শপথ নিলেন চিরকুমার থাকার। অন্যদিকে কার্তিকের জন্য অপেক্ষায় থেকে প্রহরের পর প্রহর গুণে লজ্জায়, অপমানে ঊষা শস্যক্ষেত্রে চিরজীবনের জন্য অদৃশ্য হলেন। এই যে শস্যক্ষেত্রে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মোটিফ, তার মধ্যেই কৃষি-সম্পৃক্ততা নিহিত রয়েছে। বেদ ওও পুরাণানুসারে ঊষা সূর্যের স্ত্রী আর কার্তিক সূর্যসম্ভূত দেবতা। ঊষা হলেন সৌরশক্তি; আমরা জানি সৌরশক্তি শস্যের ক্লোরোফিল সমৃদ্ধ সবুজ কলায় শোষিত হয়ে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য উৎপাদিত হয়, এরই নাম সালোকসংশ্লেষ। এই কিংবদন্তীর জাগতিক তাৎপর্য এখানেই। সৌরদেবতা কার্তিক এভাবেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কার্তিক পুজো অনুষ্ঠিত হয় সৌরতিথি অনুসরণে — রবির তুলো রাশি থেকে বৃশ্চিক রাশিতে সংক্রমণের দিন, যাকে বলা হয় কার্তিক সংক্রান্তি।
উর্বরতাবাদের সঙ্গে কার্তিকের সংযুক্তির আর একটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হল — কার্তিক সরা যা অ্যাডোনিস গার্ডেনের অনুরূপ। এটি লোকাচারের অঙ্গীভূত নকল শস্যক্ষেত্রের আদলে গড়া একটি শস্য-সরা। পূজাবেদিতে পঞ্চশস্য অথবা ধান ছড়িয়ে তার প্রতিমা স্থাপিত হয়, কোথাও আবার কার্তিক মূর্তির পাশে রাখা হয় ইতুসরার মধ্যে ইতুর ঘট। বঙ্গদেশে ইতুপুজো হচ্ছে সূর্যপূজার নির্দেশক এবং তা কার্তিক সংক্রান্তিতে সূচনা, শেষ হয় অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে। সরায় গঙ্গামাটি রেখে তাতে বোনা হয় ধান, ছোলা, মটর আর রোয়া হয় কচু আর সুশনি শাক। শস্যক্ষেত্রের একটি প্রতিরূপ বা অ্যাডোনিস গার্ডেন এভাবেই গড়ে ওঠে। বরিশাল অঞ্চলে ধানের চারাকে কার্তিকের প্রতীকরূপে পুজো করা হয়। মাটিতে সমকেন্দ্রিক কয়েকটি বৃত্তাকার চওড়া দাগ কেটে, মাটি তুলে, সেইস্থানে বোনা হয় ধানের বীজ, সেই তোলা মাটি গুঁড়ো করে বীজ আচ্ছাদিত করা হয়। এই বীজ বোনার সূত্রপাত হয় কার্তিক মাসের প্রথমার্ধে এবং সংক্রান্তিতে চারা বেশ কিছুটা লম্বা হয়। মনে করা যেতে পারে আদিকালে মূর্তির বদলে ধানের চারাই কার্তিকরূপে পূজিত হত; হয়তো মানবরূপী কার্তিক প্রতিমা পরে চালু হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে বোরোধানের জন্য ধানের বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষাও বলা যেতে পারে; সেখানে বোঝা যায় বীজের গুণমান অনুযায়ী কত হারে জমিতে বপন করা হবে।
কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, গোয়ালপাড়া এবং রংপুরের রাজবংশীয় ক্ষত্রিয় সমাজের গ্রামীণ নারীরা কার্তিকের জন্য পাতা ঘটের পশ্চাতে ফলন্ত মোচাসহ কলাগাছ আর ফলন্ত ময়নাগাছের শাখা রাখে। এই কৃত্যও কার্তিকের সঙ্গে উর্বরতাবাদকে মিলিয়ে দিয়েছে। যে মায়েরা সন্তান চান তারা কার্তিক ব্রত করেন আর সন্তানবতী মায়েরা নৃত্যের তালে তালে সেই কলাগাছ প্রদক্ষিণ করে কলা ও ময়না ফল ছিঁড়ে পশ্চাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে সন্তান মানতকারী মায়েদের আঁচলে নিক্ষেপ করেন। এই পুজোর শেষে গাওয়া হয় গীদালী গান আর তাতে কৃষিকাজের প্রসঙ্গ আবশ্যিক।
কোচবিহারের মাঘপালা গ্রামে কার্তিক পুজোর দিন বর্ষণদেবতা হুদমদেওর আশির্বাদ প্রার্থনায় গোপনে কৃষিক্ষেত্রে পরিবেশিত হয় নারীর নগ্ননৃত্য। কার্তিক শস্যরক্ষক দেবতা হবার জন্য তা করে লোকসমাজ, সেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। এটি হয়তো উর্বরতাবাদের চরম দর্শন।
গণেশ কল্পনায় অরণ্য-কৃষির যুগলবন্দী:
কৃষিজীবী মানুষ মাত্রেই জানেন হাতি অরণ্য সন্নিহিত কৃষিক্ষেত্রে কতটা বিঘ্নকারী পশু। এই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে যখন দলমা পাহাড় থেকে দলে দলে হাতির পাল নেমে এসে ফসলের জমি তছনছ করে যায়, তখন তাকে কী বলা যাবে, দেবতা? হাতি নিজেই বিঘ্নকারী আর বিঘ্নের প্রতীক; তার বাহনটিও তো তাই — ইঁদুর পাকা ফসল কাটে, যত না খায় তার চাইতে ঢের সংগ্রহ করে তার গর্তে। সুতরাং একদিকে হাতি, আর একদিকে ইঁদুর; “একা রামে রক্ষা নেই, লক্ষ্মণ তার দোসর“। হাতিমুখো গণেশ সওয়ার হয়েছেন কিনা অলক্ষ্মীরূপী ইঁদুরের পিঠে! কৃষিজীবনের পরতে পরতে এরা সর্বনাশের প্রতিভূ। অন্তত হাতিমুণ্ডধারী, ইঁদুর বাহন ফসল-বন্ধু হতে পারেন না। আর এখানে রয়েছে এক মনস্তাত্ত্বিক লোক-দর্শন; চিন্তার বৈপরীত্য। ভয়ে-ভক্তিতে এক বিঘ্নকারী শক্তি হয়ে ওঠে বিঘ্ননাশক দেবতা। বিঘ্নকারীকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত না করে বিঘ্ননাশকের দরকার লোকসমাজের। মানুষ কল্পনা করলো — যিনি দুর্গতির হেতু, তিনিই আবার কল্যাণময়; তাই ইঁদুর বাহন হস্তিদেবতা যেন ছেড়ে দিয়েছেন তার চিরাচরিত বিঘ্নকারী স্বভাব। চিন্তার এই বৈপ্যরীত্যে ভয়ঙ্কর-শক্তি হয়ে যায় শুভঙ্কর-শক্তি। আর সেকারণেই ফসল ভক্ষণকারী হাতির পাল হয়ে দাঁড়ায় কৃষি সহায়ক দেবতা।
নৃতত্ত্বের ভাষায় গণেশ হচ্ছেন থেরিওমর্ফিক দেবতা বা অর্ধ-মানুষ দেবতা; তার মুণ্ডটি প্রাণীর আর বাকি অংশটি মানুষেরই মতো। অরণ্যের প্রান্তবাসী লোকসমাজের কাছে গণেশ কেবল হস্তীদেবতাই নন, তিনি হাতিদেরও দেবতা। গণেশ তার হাতি রূপে বন্যপ্রাণী আর অরণ্য-সংস্কৃতির প্রতীক। সভ্যতার বিবর্তনে দেখি আদিতে ছিল অরণ্য-কেন্দ্রিক মানব সভ্যতা — বনের ফল-মূল সংগ্রহ আর পশুশিকার করেই করেই মানুষের খাদ্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল; কৃষি-সভ্যতা এসেছে অনেক অনেক পরে।
বন ছেড়ে মানুষ যখন বন-সংলগ্ন জমি হাসিল করে মানুষ চাষাবাদ শুরু করলো, তার লোভে দলে দলে আবির্ভূত হল বনের শাকাহারি, তৃণভোজী পশুর পাল। তাদের থেকে ফসলকে বাঁচাতে আদিম মানুষ সর্তক হল আর তাদের প্রাচীন রীতিতে বনের পশুকে সন্তুষ্টকরণ করতে উদ্ভূত হল হস্তী দেবতা, তিনিই আজকের সিদ্ধিদাতা গণেশ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।