ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন পশ্চিমবঙ্গ এবং এখানকার মানুষদের একটি বিশেষ স্থান দিয়েছেন। কেবলমাত্র আধুনিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই আমরা দেখতে পাই বাঙ্গালিদের গৌরবময় অতীতের কথা। সমগ্র ভারতের কাছে শিক্ষিত, কৃষ্টি- সংস্কৃতি মনস্ক একটি সমাজরূপে বিশেষভাগে সমাদৃত বাঙ্গালিরা। এখানে সবাই স্বাধীনচেতা, মেয়েরা লেখাপড়া এবং কেরিয়ারে বিশেষ ভাবে অগ্রণী, বাঙ্গালি বলতে এমন একটি ধারণা ভারতে আছে। অথচ বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা সবথেকে বেশি হয়ে আসছে। মহিলাদের প্রতি অত্যাচার, শােষণ, পণের জন্য প্রতারিত করা, দুষ্কর্ম, অপহরণ এমনকী মহিলাদের কেনা-বেচার মতাে ঘটনা অনেক বেশি হচ্ছে। এনসিআরবি (ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরাে) এবং এসসিআরবি (স্টেট ক্রাইম ব্যুরাে)-র রিপাের্ট অনুসারে গত দশ বছরে মহিলাদের প্রতি বিভিন্ন অপরাধের জন্য পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে আছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে ইভটিজিং করা, পণের জন্য প্রতারণা বধূহত্যা এবং শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক নব-বিবাহিতাকে অত্যাচার করার কয়েক হাজার ঘটনা থানাতে দায়ের করা হয়েছে। হিসাবমতাে রাজনৈতিক হত্যার মামলায় এর স্থান ১৯, কিন্তু মহিলাদের প্রতি হওয়া অপরাধে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সর্বপ্রথম। স্টেট ক্রাইম ব্যুরাে ২০১৭-২০১৮-এর অপরাধের হিসাব থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করছে না।
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরাের রিপাের্ট অনুসারে ২০১১-তে দুষ্কর্মের ২৩৬৩টি এবং ২০১২-তে দুষ্কর্মের ২০৪৬টি মামলা দায়ের করানাে হয়েছিল। ২০১১-তে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ২৯১৩৩টি এবং ২০১২-তে ৩০৯৪২টি মামলা দায়ের করা হয়। সমগ্র ভারতে মহিলাদের ওপর যত অত্যাচার হয়েছিল, তার ৪১ শতাংশ হয়েছিল আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে।
মহিলাদের প্রতি অত্যাচার এব অপরাধের ঘটনা এইভাবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। এরপর ২০১৪-তে দুষ্কর্মের ১৪৬৬টি এবং ২০১৫-তে ১১৯৯টি ঘটনা ঘটে। এই দুই বছরে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ১৪,৯১৬টি। মহিলা চুরির মতাে ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই সর্বাধিক।
উপরােক্ত পরিসংখ্যানগুলি আমাদের কাছে খুবই বেদনাদায়ক অথচ কঠোর সত্য। আমরা নানান ক্ষেত্রে বিস্তৃত চিন্তাভাবনা এবং উদার মনােভাবের পরিচয় দিলেও মহিলাদের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড়ােই নিষ্ঠুর। একটি পরিবারে নবজাত কন্যাসন্তান কেবলমাত্র ‘মেয়ে’ হিসাবেই পরিগণিত হয়। সেখান থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার জন্য তাকে অনেক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মেয়েদের প্রতি হওয়া অত্যাচারের মূল কারণ তাকে ‘দুর্বল’ করে দেওয়া। এই যুগেও খুব কম অভিভাবক একজন পুত্রসন্তানের মতাে সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কন্যাসন্তানকে বড়াে করে তােলেন। একজন ‘দুর্বল’ সবসময় অত্যাচারিত হতে থাকে। সেই অত্যাচার নানারূপে হয়ে থাকে। সবসময় মারধাের করা বা খেতে না দেওয়া নয়। অনেক মেয়েকে চূড়ান্ত মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয় বিয়ের আগে অভিভাবকদের এবং বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির। মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলে তাদের অবশ্যই স্বনির্ভর হবার সুযােগ দিতে হবে। আর্থিক স্বনির্ভরতা একজন মানুষকে অনেকটাই স্বাধীনচেতা করে তােলে, সে তখন নিজেই দুর্বলতাকে জয় করে। এমন একজন মানুষকে অত্যাচার করা, শােষণ করা অত সহজ নয়।
দুর্ভাগ্যবশত বিয়ের পরে যেসব মেয়ে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের শিকার হয়, তারা অনেকেই বাপের বাড়ির লােকেদের জানাতে দ্বিধা করে। এত অর্থ ব্যয় করে বিয়ের পরে, আবার সেই বাপের বাড়িতে ফিরে যাওয়া তারা মানসিক ভাবে চায় না। লােভী, অসৎ ওই শ্বশুরবাড়ির লােকেরাও তা বােঝে। সেজন্য যতক্ষণ না তাদের চাহিদা মিটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অত্যাচারের সীমা আরও বাড়াতে থাকে। পরিণতিতে অনেক সময় মেয়েরা নিজেরাই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, নতুবা শ্বশুরবাড়ির লােকজনের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়। এই সত্য কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?
আমাদের সমাজে একটি মেয়ে বড়াে হয় এই জেনে যে, এই বাড়ি তার বাপের বাড়ি, একদিন তার বিয়ে হবে এবং শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে কিছু হলেই অনেক স্বামী মন্তব্য করে বসে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। দুর্বল মেয়েটি ভাবতে বসে, বেরিয়ে সে যাবে কোথায়? আগে ছিল ‘বাপের বাড়ি। শ্বশুরবাড়িতেও অনিশ্চয়তা, তাহলে? একজন স্বনির্ভরশীল মেয়ে আর দুর্বল থাকে না, তার নিজস্ব বাসস্থান থাকতেই পারে। সে তখন ভাবতে বসবে যে সে কোথায় যাবে। সেক্ষেত্রে, তাকে কেউ অন্যায় কিছু বলার সাহস পাবে না। মেয়েটি দুর্বল থাকবে না।
সুতপা বসাক ভড়