১৮৮৯-এর ১ লা এপ্রিল বা বর্ষ প্রতিপদ বা হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন (বিক্রম সম্বত) বলিরাম পন্ত হেডগেওয়ার ও রেবতী বাঈ-এর কনিষ্ঠ পুত্র কেশব (Keshab) জন্মগ্রহণ করেন। বলিরাম ছিলেন বৈদিক শাস্ত্রে পণ্ডিত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। কেশবের (Keshab) প্রপিতামহ নরহর শাস্ত্রী হায়দ্রাবাদ থেকে নাগপুরে চলে আসেন নিজামের ধর্মীয় অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। বেদে পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁরা নাগপুরের ভোঁসলে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পান। কিন্তু ১৮৫৩-এ নাগপুর ইংরেজরা দখল করে নিলে এই পৃষ্ঠপোষকতায় ছেদ পড়ে। কেশবকে প্রথমে সংস্কৃত স্কুলে তারপর সেন্ট্রাল প্রভিন্সের সেই সময়ের সবচেয়ে পুরানো ও নামী নীল সিটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। ১৯০২ সালে নাগপুরে ভয়াবহ প্লেগের প্রকোপ দেখা দেয়। এতে কেশবের বাবা-মা দু’জনই মারা যান। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁকে একই দিনে তাঁর পিতা-মাতার শ্মশান যাত্রা প্রত্যক্ষ করতে হয়।
১৮৯৭ সালে কেশবের যখন মাত্র ৮ বছর বয়স তখন রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনারোহণের হীরক জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ভারতবর্ষ জুড়ে। এই উপলক্ষ্যে কেশবের স্কুলেও মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছিল। বালক মিষ্টিটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলে ‘‘ও আমাদের রাণী নয়।’’ আট বছরের বালকের মধ্যে দেশের স্বার্থে বিদ্রোহী মনোভাবের এই প্রথম ঝলক।
সে যুগের বহু বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মত কেশবও (Keshab) তাঁর স্বাদেশিকতার যাত্রা শুরু করেন একটি ‘আখড়া’ (ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী কুস্তি অনুশীলনের জায়গা) থেকে। নাগপুরের (Nagpur) শিবরাম গুরুর আখড়া জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। এখানেই ১৯০৪ সালে কেশবের সঙ্গে ডাঃ বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে (Dr. Balakrishna Shivram Munge) -র পরিচয় হয়। মুঞ্জে ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনাসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি ছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলকের (Bal Gangadhar Tilak) অনুগামী। উভয়ের সম্পর্ক অতি দ্রুত ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ১৯০২ সালে তিলক নাগপুরে যান এবং কেশবের (Keshab) তখন তাঁর বক্তৃতা শোনার ও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়। খুব কম বয়স থেকে ‘কেশরী’ পত্রিকা পড়ার ফলে কেশবের মনে তিলক সম্পর্কে এক প্রচণ্ড শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে উঠেছিল।
ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন শিক্ষিত ভারতীয়দের আকর্ষিত করে। ফলে বহু বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। এই ধরণের কাজকর্মে সর্বাধিক এগিয়ে ছিল বাংলা। এই প্রদেশের বিপ্লবীদের কাজকর্ম অন্যান্য প্রদেশের মানুষদেরও উদ্বুদ্ধ করে। মিডল এক্সাম (Middle exam) পাশ করে কিশোর কেশব (Keshab) সেন্ট্রাল প্রভিন্সের বিভিন্ন বিপ্লবীদের সঙ্গে সময় কাটাতে থাকেন। সেসময় মহারাষ্ট্র (Maharashtra) বলে কোন রাজ্য ছিল না। বর্তমান মহারাষ্ট্র (Maharashtra) , মধ্যপ্রদেশ (Madhya Pradesh) ও ছত্তিসগড়ের (Chhattisgarh) একটি বড় অংশ নিয়ে গঠিত ছিল ব্রিটিশ আমলের সেন্ট্রাল প্রভিন্স (Central Provinces)। এর রাজধানী ছিল নাগপুর (Nagpur)। যাই হোক, মাধবদাস সন্ন্যাসী নামে বাংলার এক বিপ্লবী এই সময় নাগপুর (Nagpur) আসে। কেশব-কে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে গোপনে রাখার। জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বে মাধবদাস নাগপুর ও তার আশেপাশে প্রায় ৬ মাস কাটান। আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় ধরা পড়া বিপ্লবীদের আইনি লড়াই লড়ার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
হিন্দুদের জন্য কাশীর যা স্থান, ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের জন্য তাই ছিল কলকাতার স্থান। কেশবও (Keshab) চাইতেন কলকাতায় (Kolkata) আসতে এবং এখানের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হতে। অবশ্য তিনি তখন ছিলেন পুলিশি নজরদারির অধীনে। তিনি সিনিয়র ম্যাট্রিকুলেশন (মিডল)পরীক্ষায় উচ্চ দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। তাঁর আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানের প্রতি। আন্তরিকতা ও কাজের প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠার ফলে কেশব দ্রুতই সেন্ট্রাল প্রভিন্সের তিলকপন্থীদের সুনজরে পড়েন। তাঁরা তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। ডাঃ মুঞ্জে ও সেন্ট্রাল প্রভিন্সের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ কেশবকে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার সমস্ত প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন- যাতে কেশব কলকাতায় কোথাও থেকে তাঁর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ এবং পড়াশোনা একই সঙ্গে চালানোর সুযোগ পান। রামলাল বাজপেয়ী তাঁর আত্মজীবনীতে এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে, হেডগেওয়ারের কলকাতায় থাকার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এখানের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা এবং বাংলা ও সেন্ট্রাল প্রভিন্সের বিপ্লবীদের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষার সেতু হিসাবে নিজেকে কাজে লাগানো।
ডাঃ এস কে মল্লিক, মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের সাহায্যে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ (National Medical College) প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ (National Council of Education) —এ যে সমস্ত ছাত্ররা পড়াশোনা করত তারা এই কলেজে ভর্তি হত, কারণ তাদের কোন সরকারী মেডিকেল কলেজে ভর্তি নেওয়া হত না। তাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এই কলেজে পড়তে আসায় এটির একটি সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল। মারাঠি ছাত্ররাও এখানে পড়তে আসত। এদের মধ্যে ওয়াই এস অ্যানে, নারায়ণরাও সাভারকর, এথালভে প্রমুখ ছিলেন কেশবের বন্ধু।
কেশব (Keshab) যখন কলকাতায় পৌঁছন তখন বাংলা বিশেষত কলকাতার বিপ্লবীদের ওপর পুলিশি নিপীড়ণ পুরোদমে চলছে। এইসময় সরকার Seditious Assembly Act (১৯০৭), Criminal Law Amendment Act (১৯০৮) এবং Indian Press Act (১৯১০)-এর ব্যবহার করে বিভিন্ন বিপ্লবী সংস্থা, প্রকাশনী এবং বিপ্লবীদের শনাক্তকরণ, নিষিদ্ধ করা এবং শাস্তি দিতে ব্যস্ত ছিল। ঔপনিবেশিক সরকার তখন বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের ও সংযোগ রক্ষাকারীদের গ্রেফতার করছিল, এর মধ্যে বান্ধব সমাজ, অনুশীলন সমিতি ও আত্মোন্নতি সমিতি ছিল প্রধান। তদানীন্তন বাংলায় এই ধরণের নিষিদ্ধ বৈপ্লবিক সংগঠন ছিল প্রায় ৫০টি। ১৯০২-এ প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘অনুশীলন সমিতি’ ছিল এই ধরণের সংগঠনগুলির মধ্যে প্রধান ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। প্রমথনাথ মিত্র ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলার প্রায় সমস্ত প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামী এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, পুলিনবিহারী দাস, ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তী, নলিনী কিশোর গুহ, প্রতুল গাঙ্গুলি, যোগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন বিপ্লবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
হেডগেওয়ার (Hedgewar) কলকাতায় পৌঁছানর সঙ্গে সঙ্গেই অনুশীলন সমিতির কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি সমিতির অত্যন্ত বিশ্বস্ত সদস্যে পরিণত হন এবং তিনি যেখানে থাকতেন সেটি বৈপ্লবিক কাজকর্মের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। আত্মগোপন করে থাকার সময় বিপ্লবী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী মাঝেমধ্যে তাঁর বাসস্থানে আসতেন। বিপ্লবী নলিনী কিশোর গুহ ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য এটি একটি আত্মগোপন করে থাকার এবং অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জায়গায় পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে নলিনী কিশোর গুহ তাঁর ‘বাংলায় বিপ্লববাদ’ বইয়ে লিখছেন, ‘‘হেডগেওয়ার (Hedgewar) ছিলেন সবদিক থেকেই একজন প্রকৃত বিপ্লবী। তিনি সমিতিতে পরিচিত ছিলেন তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও কাজের জন্য’’। বিপ্লবী বন্ধুদের মধ্যে হেডগেওয়ারের (Hedgewar) ছদ্মনাম ছিল ‘কোকেন’। সমিতির সদস্যদের শপথ নিতে হত যে এর কোন ঘটনা বা কাজকর্ম সম্পর্কে বাইরের কাউকে জানানো যাবে না। চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হত বিভিন্ন কাজকর্মের। অনুশীলন সমিতিতে হেডগেওয়ারকে নির্দিষ্টভাবে কী কী কাজ করতে হতো সে সম্পর্কে তথ্যের অভাব আছে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যুক্ত সমিতির অন্যান্য সদস্যরা সকলেই তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিপ্লবী যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি (Yogesh Chandra Chatterjee), যিনি প্রায় ২৪ বছর জেলে কাটিয়েছিলেন, তাঁর বই ‘In Search of Freedom’ গ্রন্থে লিখেছেন, হেডগেওয়ার (Headgear) অনুশীলন সমিতির গোপন অংশে একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে কাজ করতেন।
অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী জীবনতারা হালদার তাঁর ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন যে- ‘‘কেশব ম্যাট্রিক পাশ করে বিপ্লবের পীঠস্থান বাংলায় যাবার স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় এসে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। উদ্দেশ্য বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলন ছড়ানো। অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়েই ভিতরের গোষ্ঠীতে প্রবেশের অধিকার পেলেন তিনি। ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী, পুলিন দাস, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী প্রভৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন কেশব। দামোদরের বিধ্বংসী বন্যায় রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সমিতির অন্যান্য সভ্যদের নিয়ে ত্রাণকাজে যোগ দিয়ে সমাজ সেবার অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করলেন তিনি।’’
হেডগেওয়ার মতিলাল ঘোষ ও আশুতোষ মুখার্জি-র ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং রাসবিহারী ঘোষ (Rasbihari Ghosh) ও বিপিন চন্দ্র পালের (Bipin Chandra Pal) সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। বালশাস্ত্রী হরদাস তাঁর ‘Armed Struggle for Freedom’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘Hedgewar won the hearts of young revolutionaries through the purity of character, commitment and extraordinary organizational capacity. There was a big retinue of patriots who held a lot of reverence for him.’’
অনুশীলন সমিতির খ্যাতনামা বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (Trilokyanath Chakraborty) তাঁর ‘জেলে ত্রিশ বছর এবং পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন যে- ‘‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক-সঙ্ঘের (R.S.S) অধিনায়ক শ্রী কেশব হেডগেওয়ার আমাদের অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেন। তিনি যখন ১৯১০ সনে কলিকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল পড়িতেন, তখন তিনি, বীর সাভারকরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নারায়ণ দামোদর সাভারকর, ডাঃ এথলে (সাতারা) এবং আরও কিছু মহারাষ্ট্রদেশীয় যুবক, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ছাত্র আমাদের বিপ্লব-দলে যোগ দিয়াছিলেন। ‘বাংলায় বিপ্লববাদ’ পুস্তকের লেখক শ্রী নলিনীকিশোর গুহ ঐ সময় ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পড়িতেন, তিনি তাঁহাদিগকে দলে টানিয়া আনেন। আমার পলাতক অবস্থায় আমি ২/১ বার তাঁহাদের ছাত্রাবাসে ছিলাম। ১৯৪০ সনে আমি হঠাৎ তাঁহার নাগপুরের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হই এবং জিজ্ঞাসা করি ‘‘কালীচরণ দা’র কথা মনে আছে কি?’’ তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘‘আপনার ভলান্টিয়ার-বাহিনীর সংখ্যা কত?’’ তিনি বলিলেন, ‘’৬০ হাজার।’’… আমি তাঁহার সহিত আলাপ শেষ করিয়া কাশী যাই। নাগপুর শহরে হেডগেওয়ারের একখানা ছোট্ট বাড়ী ছিল, আমি সেই বাড়ীতে ছিলাম।’’
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক রাকেশ সিনহা তাঁর ‘ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার’ (Dr. Keshav Baliram Headgear) গ্রন্থে দেখাচ্ছেন যে, ভারত সরকারের ‘Criminal Intelligence office’ ১৯১৪-র জানুয়ারীতে ‘‘Political Criminals of India’’ বলে একটি পুস্তিকা বার করে। বইটিতে তাদের নামই অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘‘যারা বিভিন্ন ধরণের বিপ্লবী সংগঠন ও তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত’’ এবং যারা ‘‘বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক পদার্থ বানাতে সক্ষম’’। এই পুস্তিকাটি পুলিশ ও গোয়েন্দা দফতরে ‘Book 1914’ হিসাবে পরিচিত ছিল। সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে হেডগেওয়ারের (Headgear) নাম এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর শারীরিক গঠন (হেডগেওয়ার ৬ ফুটের ওপর লম্বা শালপ্রাংশু চেহারার অধিকারী ছিলেন) এবং নাগপুরের নীল সিটি স্কুল থেকে অনুশীলন সমিতি পর্যন্ত তাঁর নানা কার্যকলাপের বিবরণ এই পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ হয়।
সমস্ত ধরণের কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করার পরেও হেডগেওয়ার (Headgear) বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ১৯১৪-র সেপ্টেম্বরের পরীক্ষায় ৭০.৮% নম্বর পেয়ে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করেন। শারীরতত্ত্ববিদ্যা-য় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন ১৯১১-১২ ও ১৯১২-১৩ সালে পরপর দু’বার। কলকাতার ভিক্টর হসপিটালে ট্রেনি হিসাবে ১৯১৫-র মাঝামাঝি দু’মাস কাজ করেন হেডগেওয়ার। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন ১৯১৪-১৫ সালে একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারের প্রচণ্ড দমন-পীড়ন, বিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য, অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ না হওয়া প্রভৃতি ছিল এর প্রধান কারণ। হেডগেওয়ার নাগপুরে একজন পুরোদস্তুর চিকিৎসক হিসাবে ফিরে যান।
ভারতবর্ষের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার (Ramesh Chandra Majumder) ১৯৬০ সালে কলকাতার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শীতকালীন অধিবেশনে বলেছিলেন- ‘‘সঙ্ঘের সকল কাজ ও প্রোগ্রাম এর প্রতিষ্ঠাতার এক মহান চিন্তা দিয়েই প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি (হেডগেওয়ার) এক বিশাল ভাবনা নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলেন- লক্ষ্য ছিল সঠিক অর্থে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটিয়ে জাতিকে শক্তিময় মহাপরাক্রমশালী করে গড়ে তোলার। তিনি সাহসের সঙ্গে সত্য কথাটি বলেছিলেন, এই মহান দেশে হিন্দুরাই মূল নাগরিক। বহু লোক একথা বলতে লজ্জা পান, যদিও তাঁরা জানেন এই-ই ঠিক কথা। আমাদের সাহসের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যখন এ দেশের মহান সংস্কৃতি, অতীতের কথা বলি তখন হিন্দু ইতিহাস, হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতার কথাই বলি, সে জন্যই গর্ববোধ করি। আমি বুঝতে পারি না, এঁরা কেন একথা স্বীকার করতে লজ্জা পায় যে এ দেশের মহান অতীত ও মহান সংস্কৃতি আসলে হিন্দু অতীত ও হিন্দু সংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।’’
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়