ভারতের অখণ্ডতার জন্যই কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি প্রয়োজন

শিক্ষার আলো কখনো ধর্মান্ধদের চোখের পর্দা সরাতে পারে না। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাকিস্তান। দোষ শুধু জঙ্গিদের কেন হবে? সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেনা প্রধান, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ সবার একই মানসিকতা অর্থাৎ শেষ কথা জঙ্গিপনা। হ্যাঁ, কিছু ভালো মানুষ আছেন, তারা শতাংশের হিসেবে পড়েন না। আমরা ভারতীয়রা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না কিন্তু তাদের বিশ্বাস পাকিস্তান যেহেতু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে সুতরাং ইসলাম সর্বোপরি। পাকিস্তানে ছোটোদের কোমল মনে হিংসার বীজ রোপণ করে শেখানো হয় হিন্দু এবং হিন্দুস্থান পাকিস্তানের প্রধান শত্রু। ফলস্বরূপ পাকিস্তানের মাদ্রাসা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের আতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। তাদের জাতীয়তাবাদ মানে ইসলাম, দেশাত্মবোধ মানে জঙ্গিপনা।

এক টিভি অনুষ্ঠানে সঞ্চালিকা রুবিনা লিয়াকতকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সৈয়দ তারেক পিরজাদা মুখের উপরে বলে দেন পাকিস্তানের একটাই উসুল, সেটা ‘ইসলাম’। সেখানকার রেলমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন ভারতের পাখিরা আর ডাকবে না, মন্দিরে কোনো ঘণ্টা বাজবে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা কাণ্ডে আমরা প্রায় অর্ধশত সেনাভাইদের হারিয়েছি। হ্যাঁ আমরা অবশ্যই কড়া বদলা চেয়েছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানের বরবাদি চেয়ে কেউ তো বলেনি পাকিস্তানের সব মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। তাহলে পাকিস্তানের রক্তে এতো হিন্দু বিদ্বেষ কেন? ভাবা যায় সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থার কী করুণ পরিণতি হতে পারে! অথচ এই ভণ্ডরা হিন্দুস্তানকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পাঠ শেখায়। সৌজন্যে অবশ্যই আমাদের আমির, নাসিরের মতো মহানুভবরা। ১৯৭১-এ আমরা বর্তমান বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখা যায় বেশিরভাগ বাংলাদেশি ধর্মের জিগিরে ভারতকে চরম শত্রুর আসনে বসিয়ে পাকিস্তানের অন্ধভক্ত হয়ে আছে। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও তাদের পঞ্চম শ্রেণীর ইসলাম ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা পাঠ্য বইয়ের ১৬ এবং ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় অমুসলিমদের ‘মিথ্যাবাদী, সম্পদ আত্মসাৎকারী, এমনকী পশুর চেয়ে অধম’ হিসাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।

কাশ্মীর ও পাকিস্তানের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মিল রয়েছে, সেটা জঙ্গিপনার জন্য ধর্মের ব্যবহার। কুখ্যাত হাফিজ সাঈদ যেভাবে পাকিস্তানের মসজিদগুলোতে জুম্মাবারে মৌলবাদীদের ধর্মের নামে ব্রেন ওয়াশ করে, সেভাবে আমাদের কাশ্মীরেও বিচ্ছিন্নবাদীরা উপত্যকার যুবকদের ধর্মের নামে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা এবং সন্ত্রাসবাদ শব্দদুটি একে অন্যের পরিপূরক। সম্প্রতি পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলায় মৌলানা মাসুদ আজহার নিয়ন্ত্রিত ‘জৈশ-ই-মোহাম্মদ’ দায় স্বীকার করেছে। এই মাসুদ আজহারকে প্রথমে ১৯৯৪ সালে কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হরকত-উল- মুজাহিদিনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় শ্রীনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর প্রায় ৫ বছর পরে সন্ত্রাসবাদীরা ১৯৯৯ সালে ১৮০ জন যাত্রী-সহ একটি ভারতীয় বিমান নেপাল থেকে অপহরণ করে কান্দাহারে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা ‘কান্দাহার বিমান কাণ্ড’ নামে বেশ সুপরিচিত। পণবন্দি এই বিমান যাত্রীদের বিনিময়ে তখন ভারত সরকারকে কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহার-সহ অন্য দুই জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে হয়। তার পর মাসুদ ২০০০ সালে জৈশ-ই-মহম্মদের সৃষ্টি করে। মাসুদের এই সংগঠনে শামিল হয় হরকত-উল-মুজাহিদিন এবং হরকত-উল-তাংজাম-এর মতো বিষাক্ত সংগঠন।

মূলত ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলা বৃদ্ধি করা এবং কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করাকেই এই সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলস্বরূপ ২০০১ সাল থেকে সংসদ হামলা, জম্মু-কাশ্মীরের সচিবালয়ে হামলা, ২৬/১১ মুম্বই হামলা, ২০১৬-তে পাঠানকোট হামলা, উরি হামলা, আর সম্প্রতি পুলওয়ামা হামলা। ভারত চায় রাষ্ট্রসঙ্ঘ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করুক। কিন্তু চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় বারংবার ভেটো প্রয়োগে মাসুদকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এইবারও মাসুদকে চীন বাঁচিয়েছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ৫১ বিলিয়ন ডলারের ‘One road one bolt’-এর মতো অনেক পারস্পরিক যোজনা রয়েছে। তাই চীন পাকিস্তানকে বাঁচাতে চায়। ১৯৫০ সাল থেকে চীন তিব্বত দখল করে আছে। পাকিস্তানের প্রতি চীনের সহমর্মিতার উদ্দেশ্য হলো ধীরে ধীরে পাকিস্তানকে কবজা করা।

চীনের পাকিস্তানের প্রতি অনেক কারণে দুর্বলতা থাকতেই পারে, কিন্তু পুলওয়ামা কাণ্ডের পর কিছু মুসলমানের দেশদ্রোহী চরিত্র পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ছাত্র থেকে শুরু করে গুয়াহাটি আইকন কর্মার্স কলেজের অধ্যাপিকা-সহ আমাদের আনাচে কানাচে কত লোক যে এই দেশদ্রোহিতায় শামিল হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। তবে প্রশংসনীয় যে প্রশাসন কড়া হাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের এই চরম মুহূর্তে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। বিরোধীরা পাশে থাকার অভয় দিলেও শেষ পর্যন্ত ভারসাম্য রাখতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি হয়ে গিয়েছিল যেন মনে হচ্ছিল ইমরান খানের স্পেক পার্সন হয়ে দেশের কিছু নেতা-নেত্রীরা ভাষণ দিচ্ছেন। পাকিস্তান সরকারকে যতই জঙ্গিবাদের প্রমাণ দেওয়া হোক না কেন, কোনো সদর্থক ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করবে না। কারণ পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর। তাই পাকিস্তানকে প্রথমে কুটনৈতিক পর্যায়ে ঘায়েল করা অত্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় ছিল। পাকিস্তানকে দেওয়া মোস্ট ফেভারিট নেশনের তকমা কেড়ে নিয়ে হয়, আমদানি শুল্কের উপর ২০০ শতাংশ কর বসিয়ে, তিনটি নদীর জল পাক সীমান্তে আটকিয়ে ভারত সেই অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাশ্মীরের ভারত বিরোধী বিচ্ছিন্নবাদী নেতাদের সরকারি সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়া। অথচ এই দেশ বিরোধীদের পেছনে পূর্বতন ভারত সরকার গত দশ বছরে প্রায় ১১ কোটি টাকা খরচ করেছে। তাদের সরকারি গাড়ি, পেট্রল, সিকুরিটি, হোটেল খরচ ইত্যাদি এলাহি সুযোগ সুবিধা ছিল। তাই এইসব কালসাপদের এইরকম দুধ কলা দিয়ে পোষার আর কোনো মানে ছিল না। মোদী সরকার তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

মোদী সরকারের ২০১৪ সালে নির্বাচনী ইস্তেহারে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং ৩৫ (এ) বিলুপ্তির প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু সেটা গত ৫ বছরে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতপক্ষে ধারা ৩৭০ সংবিধানের একটি অস্থায়ী অনুচ্ছেদ। নিয়মানুসারে অনুচ্ছেদটি ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বিলুপ্ত হয়ে যায় যখন রাজ্য সরকার অনুচ্ছেদটি সংযোজনের জন্য অনুমোদন দেয়। তারপর ১৯৫৭ সালেও অনুচ্ছেদটি তুলে দেওয়া যেত যখন জম্মু কাশ্মীরের সংগঠনীয় পরিষদ ভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। অনুচ্ছেদ ৩৭০ আমাদের দেশের জন্য প্রতিবন্ধক স্বরূপ। এটি সংবিধানের এক দেশ, এক আইন, এক জাতীয় সংগীত, এক জাতীয় পতাকার মর্যাদাকে আঘাত করে। দেশের কোনো বিশেষ রাজ্যের জন্য আলাদা পতাকা থাকবে, দেশের সর্বোচ্চ সুপ্রিম কোর্টের রায় সেখানে প্রতিফলিত হবে না, জাতীয় পতাকার কোনো সম্মান থাকবে না, আলাদা নাগরিকত্ব আইন থাকবে, সেখানকার জমি ক্রয় বিক্রয় করা যাবে না, জন্ম-মৃত্যু-বিয়েতে আলদা বিধি বিচার ইত্যাদি থাকতে পারে না।

ধারা ৩৭০ আমাদের দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই ২০১৯-এর ১৪ জানুয়ারি আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিমকোর্টে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির জন্য আবেদন জানান। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে বেঞ্চটি এপ্রিল মাসের ২ তারিখে শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়। পুলওয়ামা কাণ্ডের আত্মঘাতী জঙ্গি ছিল কাশ্মীরের বাসিন্দা আদিল আহমেদ দার। এতো বিস্ফোরক পাকিস্তান থেকে উড়ে আসেনি। সম্পূর্ণ মদত জুগিয়েছিল এই ৩৭০ ধারার সুবিধাভোগীরা। তাই হাফিজ সাঈদ, মাসুদ আজহারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে অভিশপ্ত ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি সর্বসম্মতিক্রমে ঘটিয়ে দেশদ্রোহীদের চরম জবাব দেওয়া হোক।

রঞ্জন কুমার দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.