নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে রাজীব— স্বাধীনতার পর কংগ্রেসি রাজত্ব দেশকে অনেকভাবে বিপদগ্রস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু এরা কেউই কংগ্রেসকে ‘দেশদ্রোহী’ করে তোলেননি। রাহুল যা
হেসেখেলে করতে পেরেছেন।
অবশেষে রাজ্যবাসীর সামনে এটুকু স্পষ্ট হয়ে গেল যে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আর যাই হোক বাম-কংগ্রেস জোট বা আসন রফা, যা খুশি বলা হোক না কেন, তা আর হচ্ছে না। বামেদের জন্য কংগ্রেস দু’একটি ছাড়বে, বামেরাও কংগ্রেসের জন্য দু-একটি ছেড়েছে— বাদবাকি আসনে বন্ধুত্বের সুর কেটে লড়াইটাই হবে। রাজনীতি-সচেতন মানুষ এবারে যতটা না বিস্মিত হয়েছেন, তার থেকে ঢের বেশি অবাক হয়েছিলেন ২০১৬-তে বিধানসভা নির্বাচনের সময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বাম-কংগ্রেস, আরও স্পষ্ট করে বললে সিপিএম-কংগ্রেস দ্বৈরথ দেখে এসেছেন। মমতা কংগ্রেস ছেড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েই এ রাজ্যে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তিনি।
রাজনীতি অসম্ভাবনার শিল্প ঠিকই, কিন্তু অহি-নকুলেও যে দোস্তি জমতে পারে তা ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগেও কেউ বিশ্বাস করতো না। শোনা যায়, এক বাংলাখ্যাত বাজারি পত্রিকার বড়ে সরকার নাকি ওই সাপ-বেজি জোটের মুখ্য কারিগর ছিলেন, যার মাশুল তাকে চোকাতে হয়েছিল নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গদিচ্যুত হয়ে। সে যাই হোক, বাম-কংগ্রেস জোটের ফলাফলে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার। বামপন্থীরা যাও বা কংগ্রেসকে ভোট দিতে পারেন, কংগ্রেসিরা বামপন্থীদের নৈব নৈব চ। কারণটা একবারে সোজা। ৭১-এ সাঁইবাড়ির রক্তমাখা ভাত, আর ৭৭-পরবর্তী চৌত্রিশটা বছর ভুলে যাওয়া আর যারই হোক, আপাদমস্তক কংগ্রেস-কর্মীর পক্ষে সহজ নয়।
এদিকে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে বামেরা তো কংগ্রেসিদের শ্রেণীশত্রু ভাবে। তাহলে অন্ততঃ ভোটের ফলে যেটুকু দেখা গেছে তাতে বামেদের ভোট কংগ্রেস পায় কী করে? এর মূলে নিশ্চয়ই রাহুল গান্ধীর তৎকালীন কার্যকলাপ। যে কংগ্রেস সরকার আফজল গুরুর ফাঁসির আদেশ রাতারাতি কার্যকর করেছিল তার পরিবারবর্গকে জানবার সময়টুকুও না দিয়ে, সেই কংগ্রেসের প্রধান মুখটিই যখন অকৃত্রিম ভোটলোলুপতায় চরম-নরম সবধরনের বামপন্থীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আফজলের মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপকদের পাশে দাঁড়ান, তখন আর কংগ্রেসকে শ্রেণীশত্রু ভাবার অবকাশ খাঁটি কমিউনিস্টদের অবশ্যই থাকে না। গত বিধানসভা ভোটে যার প্রতিফলন বিলক্ষণ দেখা গেছে এবং বামেদের ভোটে বলীয়ান কংগ্রেস আসন সংখ্যার বিচারে বিরোধী দলের মর্যাদাটুকু নিশ্চিন্তে হাসিল করেছে।
তারপর কংগ্রেসের হাঁড়ির হাল যা হবার তাই হয়েছে। মমতার দলের প্রলোভন ছিলই, কিন্তু বিনা প্রলোভনেও অনেক খাঁটি কংগ্রেসকর্মী দল ছেড়েছেন, সারাদেশ জুড়েই। ফলে গোটা দেশেই রাহুলের কংগ্রেস আর বামপন্থীদের আজ বেআব্রু দশা। উত্তরপ্রদেশে মায়া-অখিলেশই হোক বা এ রাজ্যে বামফ্রন্ট— এরা কেউই আর দু-দশটার বেশি আসন কংগ্রেসকে ছাড়ে না। অথচ এই ভোটবল নিয়ে স্রেফ ঘোলা জলে মাছ ধরে রাহুল নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে ঘোষণা করে হাসির খোরাক হয়েছেন। নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে রাজীব—স্বাধীনতার পর কংগ্রেসি রাজত্ব দেশকে অনেকভাবে বিপদগ্রস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু এরা কেউই কংগ্রেসকে। ‘দেশদ্রোহী’ করে তোলেননি। রাহুল যা হেসেখেলে করতে পেরেছেন।