#ছোট্ট_একটা_দেশলাই_বাক্সের_গল্প


#তৃতীয়_ভাগ


১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ  প্রতিরোধ আন্দোলন বঙ্গ তথা ভারতের সমাজ জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল। তার ছাপ তৎকালীন গান নাটক সাহিত্য ও শিল্পের মতো দেশলাই বাক্সতেও পড়েছিল।  দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়বস্তু দেশলাইএর ওপর দেখা যেতে লাগলো ১৯০৫ সাল থেকে পরবর্তী পর্যায়গুলোতে । দেশী কোম্পানি গুলি বেশিরভাগ তাদের লেবেলের উপর #স্বদেশী বা Swadeshi কথাটি ছাপাত। সেই সব দেখেই কিনা জানিনা এদেশের সুইডেনের দেশলাই বাক্সেও Use Swedish Matches লেখা শুরু হল। ফলে অনেকেরই Swedish কথাটিকে অসর্তক Swadeshi মনে হতো। 
ইংরেজ শাসকের ভয়ে কিছু দেশলাইবাক্সে প্রস্তুতকারক কোম্পানির নামও থাকত না। কয়েকটা বাক্সের গায়ে লেখা: ‘স্বাধীনতা সম সুখ নাই’, ‘নিরুৎসাহ হয়োনা বাঙ্গালী’, ‘বিদেশী পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য গ্রহণ’।  তখন কলকাতা থেকে ট্রেনে বা স্টিমারে করে দেশলাইয়ের পেটি পূর্ববঙ্গে যেত। স্টেশনে, বন্দরে ইংরেজ পুলিশ সতর্ক থাকত। আপত্তিকর লেখা মনে হলেই দেশলাইবাক্স বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করে ফেলত।

এই বঙ্গভঙ্গ এবং তার পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলন কালে কলকাতার দেশলাইয়ে সবচেয়ে বেশি দেখা গেল পতাকা , চরকা ও বন্দেমাতরম । 

বঙ্গীয় দিয়াশলাই কার্যালয়’-এর ছাপ দেওয়া, ‘মুক্তিসংগ্রাম’ লেখা দেশলাই ছিল যার ওপর থাকত চরকা আর পিস্তলের ছবি পাশাপাশি। মাদাম ভিখাজি কামা-র ছবিওয়ালা দেশলাইও ছিল। মাদাম কামা জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ১৯০৭ সালের ২২ অগস্ট তাঁর পরিকল্পনায় তৈরি ভারতের পতাকা (বেসরকারি) উত্তোলন করেন।


কয়েকটি দেশলাই-বাক্সে ‘বন্দেমাতরম’ লেখা সাধারণ ব্যাপার ছিল, এটি ছিল স্বাধীনতার সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্র। দেশলাই বাক্সের একটা ছবিতে পাওয়া যায় একটা হাতি ‘বন্দেমাতরম’ লেখা পতাকা নিয়ে যাচ্ছে। কলকাতায় এই দেশলাই বাক্সের বিখ্যাত সংগ্রাহক হলেন গোপাল বিশ্বাস। তাঁর নিকট  দুটো দেশলাইবাক্স আছে বন্দেমাতরম লেখা, সেগুলো ছাপা হয়েছিল সুইডেনে! তাঁর সংগ্রহে আছে খোদ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ)-র ব্যবহার করা দুষ্প্রাপ্য একটা আস্ত দেশলাইবাক্স— যার এক পিঠে নেতাজির ছবি, অন্য পিঠে চরকা-আঁকা পতাকা। কলকাতারই শেখর চক্রবর্তীর কাছে আছে বালগঙ্গাধর তিলকের বিখ্যাত উক্তি ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার’ লেখা মার্কা।

ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা কি হবে তা নিয়ে আন্দোলনের চার দশক ধরে বিস্তর আলাপ আলোচনা চলেছিল। বেশিরভাগই তিরঙ্গার পক্ষে এবং কেউ কেউ চতুর্বর্ণের পরামর্শ দেন। দেশলাই বাক্সের উপরও সেই সামাজিক প্রতিফলন দেখা গেল। একটি ব্যতিক্রমী দেশলাই দেখা গেল কেবল গেরুয়া রঙের। 
এক সময় শ্ৰী সুনীতি চ্যাটার্জি প্রশ্ন তুললেন যে , একটি রাষ্ট্রের পতাকার রং গুলি শোয়ানো কেন হবে ? তা হওয়া উচিত দণ্ডায়মান ,  ফ্রান্স, ইতালি বা বেলজিয়ামের পতাকার ধাঁচে। কলকাতার KMMfgCO প্রথম সুনীতি চ্যাটার্জির কথা মেনে সম্ভাব্য ভারতের জাতীয় পতাকার দন্ডায়মান ছবি দেশলাই বাক্সে ফুটিয়ে তুলল। দেশলাইএর উপর দেশাত্মবোধের প্রতিফলনের এই ধারা ১৯০৫ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও তারও কয়েক বছর পর অবধি চলেছিল। সেই ধারার অঙ্গ হিসাবে  দেশলাইএর ওপর দেখা গেল বাংলার বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি। 

দেশলাইবাক্সে রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি থাকত। নিবেদিতার নাম ও ছবি দেওয়া একটি বাক্স ও পাওয়া গেছে। ভগৎ সিংহের চাররকমের ছবি চলত দেশলাইবাক্সের ওপর। 

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর ছবি দেওয়া বহু পুরনো তিনটি স্বদেশি দেশলাই পাওয়া গিয়েছে, একটিতে দেশবন্ধুর পাশে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীও ছিলেন। এই দেশলাই কোম্পানির নাম পূর্বেই উল্লেখ করেছি। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর ছবি-দেওয়া মার্কাও ছিল।  দেশলাইবাক্সের ওপর লোকমান্য তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সরোজিনী নাইডু, নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পটেলের ছবি থাকত। এমন দেশলাইও ছিল, যার ওপর জ্বলজ্বল করছে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ছবি।

দেশকে ‘মা’ হিসেবে কল্পনা করে ছবি আঁকা ও ‘ভারতমাতা’, ‘হিন্দ মাতা’, ‘স্বরাজলক্ষ্মী’, ‘জয়ন্তী’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি লেখা দেশলাই বেরিয়েছিল সে সময়। দেশলাইবাক্সে হাতি, হরিণ, বাঘের ছবির ব্যবহার সে-কালে খুব হত। একটা দেশলাইবাক্স ছিল কলকাতার ‘ক্রাউন ম্যাচ ফ্যাক্টরি’র বানানো, সেখানে মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে একটা হরিণের ছবি! হয়তো গাঁধীকে পৌরাণিক ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে তাঁর মহত্ত্ব বোঝানের চেষ্টা হয়েছে, বা বলা হচ্ছে, তিনি আমাদের দেশে এমনই রূপকথার রাজ্য আনবেন! একটি মার্কায় অবশ্য গাঁধী তাঁর সবচেয়ে পরিচিত পোজ-এ, চরকায় সুতো কাটছেন।

 স্বাধীনতার সময় বা পর-পর তো বটেই, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত নেতাজির ছবিওয়ালা দেশলাই পাওয়া গিয়েছে। সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জাতীয় নেতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছবি ছিল তাঁরই। নানা ভাবে ‘জয় হিন্দ’ লেখা দেশলাইবাক্সও ছিল অনেক।

উক্ত যেসব দেশলাই বাক্সের কথা বললাম সেইসব দেশলাই বাক্সের কোম্পানিগুলির কয়েকটির নাম এবং ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করলাম । যেমন : বঙ্গমাতা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, বঙ্গীয় দিয়াশলাই কার্যালয় – ব্র্যান্ড স্বাধীনতা , ভাগীরথী ম্যাচ ফ্যাক্টরি – সোনার বাংলা, চ্যাটার্জি সাউ এন্ড কোম্পানি – ভারতলক্ষ্মী , ধরমসি কোম্পানি কলকাতা – বন্দেমাতরম , গৌরাঙ্গ ট্রেডিং এজেন্সি – পল্লী মঙ্গল, মুখার্জি ম্যাচ ফ্যাক্টরি – স্বদেশী সেফটি ম্যাচ  ― এই ফ্যাক্টরির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কাসিমবাজারের মহারাজা , স্বদেশী দিয়াশলাই কার্যালয় বোস এন্ড কোম্পানি – বন্দেমাতরম , ঊষা ম্যাচ কোম্পানি  – মোহনবাগান ইত্যাদি।

ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কলকাতা ও বাংলার দেশলাই : গোপাল বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.