বাঙ্গালি হিন্দুকে মানুষ হতে না দেওয়ার দায় বাঙ্গালি মায়ের উপর চাপানো উচিত নয়। বাঙ্গালি আজ শ্রীরামকৃষ্ণের, স্বামীজীর, রানি রাসমণির শ্রীরাম-সাধনার ধারা বিস্মৃত হয়েছে। বাঙ্গালিকে জানানো হয়নি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রামনামে জারিত ছিলেন। কোন পারম্পর্যে কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় ‘শ্রীরাম পাঞ্চালি’ লিখেছিলেন, তা কী বাঙ্গালি জানে? বাঙ্গলার লোকসংস্কৃতিতে রামায়ণ, রামযাত্রা যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল। বহু বাঙ্গালি নামের প্রথমাংশ, মধ্য-নামে ‘রাম’ কথাটি প্রায়শই দেখা যেত। বাঙ্গলার বহু স্থানের নামে রাম কথাটি রয়ে গেছে। ভাঙাচোরার পরেও পশ্চিমবঙ্গে এখনও অনেক রামমন্দির রয়েছে বহাল তবিয়তে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, বাঙ্গালির ইস্ট মন্ত্র— “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/হরে রাম হরে রাম/রাম রাম হরে হরে। ”
যারা বলেন রাম বাঙ্গালির দেবতা নন, তারা বরং রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য মন দিয়ে শুনুন, “বাংলাদেশে যে এক সময়ে সমস্ত জনসাধারণকে একটা ভক্তির প্লাবনে প্লাবিত করিয়া তুলিতেছিল; সেই ভক্তিধারার অভিষেকে উচ্চ-নীচ, জ্ঞানী মূর্খ, ধনী দরিদ্র, সকলেই, এক আনন্দের মহাযজ্ঞে সম্মিলিত হইয়াছিল— বাংলা রামায়ণ, বিশেষভাবে, বাঙ্গলাদেশের সেই ভক্তিযুগের সৃষ্টি। বাঙ্গলাদেশে সেই যে, এক সময়ে, একটি নবোৎসাহের নব-বসন্ত আসিয়াছিল, সেই উৎসবকালের কাব্যগুলি বাঙ্গালির ছেলে যদি শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ করে, তবে দেশের যথার্থ ইতিহাসকে সজীবভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবে। ” (যোগীন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘সরল কৃত্তিবাস’ গ্রন্থের ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩১৫, যে বইয়ের প্রচ্ছদে দেওয়া আছে, “অমৃত -মধুর এই সীতা-রাম-লীলা। /শুনিলে পাষাণ গলে, জলে ভাসে শিলা॥)
তা কবে থেকে বাঙ্গালি রাম-নামে জারিত? কৃত্তিবাস তার ভণিতায় নিজের জন্ম সম্পর্কে বলছেন, “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাসে”, মানে সেই বছরেরই দিন যেদিন মাঘ মাসের শেষ দিনটি ছিল রবিবার এবং শ্রীপঞ্চমী তিথি বা সরস্বতী পুজো। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জ্যোতিষ গণনায় তা নির্ণয় করেছেন ১৩৮৬ থেকে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক মাঘী পঞ্চমীতে অর্থাৎ কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচলীর স্বাদ বাঙ্গালি পেয়েছে অন্তত ছ’শো বছর আগে। অনুমান করা যায় তার আগে থেকেই বাঙ্গলার প্রবুদ্ধ-মহলে রামায়ণের সংস্কৃত কাব্যের চর্চা ছিল যথেষ্ট এবং লোককথায় তার অবিসংবাদিত বিস্তার। লোকায়ত-মানসে এমনই শক্ত ভিত্তি না থাকলে কৃত্তিবাস এমন জনপ্রিয় ও লোকপ্রিয় রামায়ণ কাব্য লিখতে প্রেরণা পেতেন না। আর এমনি এক কবিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এ বঙ্গের অলঙ্কার’ বলবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রামায়ণ-বিরোধিতা করতে গিয়ে হিন্দু বিরোধী ভ্রান্ত-সেকুলারি সমাজ তাকে অবাঙ্গালির দেবতা বলে দেগে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে তুলসীদাসী রামচরিতমানস লেখা হয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেক পরে। সম্ভবত রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বির্তকে বাঙ্গালিকে শামিল না করার ‘সেকুলারি-চালাকি করেছিলেন কিছু অসত্য কথা-বলা ইতিহাসবেত্তা। রাম যে বাঙ্গালির আরাধ্য দেবতা ছিলেন, তা নানান সময়ে আলোচনা করেছি। শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা শ্রীরামচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দের রাম-উপাসনা, রানি রাসমণির রঘুবীর-সাধনাকে বাঙ্গালি ভুলে গেছে। বাঙ্গালি কীভাবে ভুলে যায় মহামন্ত্র!
ভারতীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনিই রামায়ণের সেরা ভাষ্যকার। কারণ তিনি রামায়ণের কাহিনিতে জারিত হয়েছিলেন এবং আত্তীকরণ করে তা সুপাচ্য সাহিত্য-ব্যঞ্জনে পরিবেশন করেছিলেন। তিনি সংস্কৃত রামায়ণ পড়লেও রামায়ণ সংক্রান্ত তার সমূহ-ভাষ্য এবং সাহিত্য ও সমাজ সমীক্ষার মূল ভিত্তি ছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণ, যাকে নিয়ে আজও সকল বাঙ্গালি গর্ববোধ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের অধ্যয়ন নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের লেখা থেকে জানা যায় সবচাইতে বেশি দাগানো বইযা তিনি পড়েছিলেন এবং বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনে আজও সংরক্ষিত রয়েছে তার অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এবং নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত (১৩৪৩) কৃত্তিবাস রামায়ণ। বিশ্বকবি বিশ্বাস করতেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙ্গলার নিজস্ব সম্পদ। বইটি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “কৃত্তিবাসের স্মৃতি নিজেকেই নিজে এতকাল রক্ষা করিয়া আসিয়াছে। যাঁহারা বড়ো কবিতাহারানিজের কাব্যেই নিজের তাজমহল তৈরি করিয়া যান। ” (কৃত্তিবাসকে উপলক্ষ্য করে চট্টগ্রাম সম্মিলনীর সম্পাদককে চিঠি, ১৩১৫ বঙ্গাব্দ, সূত্র : বিশ্বভারতী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫৪)। জানা যায়, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত রচিত রামচরিত মানস (তুলসীদাস) বইটিও তিনি পড়েছিলেন। এই যে রামায়ণ সম্পর্কে কবির আগ্রহ এটা শুরু হয়েছিল জীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই। বলা ভালো, কৃত্তিবাসী রামায়ণতার জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে দেখতে পাই ভৃত্যরাজকতন্ত্রে বেড়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথের অবাধ্য-মনের আবহ যেন বদলে যেত রামায়ণের আবহে। পাঁচালী গায়ক কিশোরী চাটুজ্জে জোড়াসাঁকোয় আসতেন গান গাইতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “কৃত্তিবাসী সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় বিলুপ্ত হইল— অনুপ্রাসের ঝকমারি ও ঝংকারে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। ” ‘ছেলেবেলা (১৩৪৭) নামক আত্মনিষ্ঠ প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছেন রামায়ণে মজে থাকার কথা, “ব্রজেশ্বরের কাছে সন্ধেবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সাতকাণ্ড রামায়ণটা। ”
রবীন্দ্রনাথের এক সম্পর্কিত দিদিমা (রবীন্দ্রনাথের মায়ের এক সম্পর্কিত খুড়ি)-র মালিকানাধীন কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি বই ছিল। তা পড়তে গিয়ে কোনো করুণ বর্ণনায় তার চোখ দিয়ে যখন জল পড়ত, দিদিমা জোর করে তার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে যেতেন। রামায়ণ পড়ে কান্নার কথা ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামদাসের মহাভারত পড়িতে বসিতাম। রামচন্দ্র ও পাণ্ডবদিগের বিপদে কত অশ্রুপাত ও সৌভাগ্যে কী নিরতিশয় আনন্দলাভ করিয়াছি। তাহা আজও ভুলি নাই। ”আর দিদিমার মার্বেল কাগজমণ্ডিত কোণ-ছেড়া মলাটওয়ালা মলিন বইটির কথা (বইটি রবীন্দ্র-স্মৃতি-ভবনে সংরক্ষিত ছিল) কবি ‘আকাশ প্রদীপ’কাব্যের ‘যাত্রাপথ’ কবিতায় অমর করে রেখেছেন, “কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা/দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা,/আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাট/দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট। ”
অতএব দেখা যায়, ভৃত্যশাসনে রবীন্দ্রনাথের পড়া বইগুলির অন্যতম হলো কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং তার স্মৃতি সারা জীবনের জন্য তার কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার। কিছুটা বড়ো হয়ে তিনি বাবার সঙ্গে হিমালয়ে গিয়ে পড়েছিলেন বাল্মীকি রচিত অনুষ্ঠুভ ছন্দের রামায়ণ। কিন্তু তার প্রভাব অতটা ছিল হয়তো, যতটা না ছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাব ছিল তার চেতনায় ও ভাষ্যে।
তার দুটি গীতিনাট্য ‘বাল্মিকী প্রতিভা (১২৮৭) এবং ‘কালমৃগয়া’ (১২৮৯)-য়। সংস্কৃত রামায়ণের প্রভাব রয়েছে। রয়েছে আদিকাণ্ড ও অযোধ্যাকাণ্ডের শ্লোক। ১. “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ” এবং ১. “পুত্র ব্যাসনজং দুঃখং যদেতন্মম সাম্প্রতম”।
‘অহল্যার প্রতি’ (১২৯৭), ‘পতিতা’ (১৩০৪) কবিতার কাহিনি নির্মাণ হয়েছে রামায়ণের গভীর পাঠ অনুসরণ করে। ‘পুরস্কার’ (১৩০০) কবিতাতে ধরা পড়েছে রামায়ণের নির্যাস, চিত্রা’ কাব্যের ‘নগর সংগীত’ কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথকে রামায়ণ সম্পর্কিত ‘মিথোম্যানিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখি। শিশু’ কাব্যগ্রন্থ ও ‘সহজপাঠ’-এ তো রবীন্দ্রনাথ শিশু মনকে রামায়ণে জারিত করে দিয়েছেন একেবারে!
রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে অজস্র রামায়ণ সম্পর্কিত উক্তির উজ্জ্বল উদ্ধার করতে পারবেন তন্বিষ্ট গবেষক, তার পরতে পরতে ভারত সংস্কৃতির প্রতি মান্যতা এবং অনুপম শ্রদ্ধা চোখে পড়বে। শিক্ষার হেরফের’প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “মনে আছে আমরা বাল্যকালে কেবলমাত্র বাংলা ভাষায় শিক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলাম, বিদেশি ভাষার পীড়নমাত্র ছিল না। …কিন্তু আজকাল আমার জ্ঞানে আমি একটি ছেলেকেও ওই দুই গ্রন্থ পড়িতে দেখি নাই। ”
রবীন্দ্রনাথকে রামায়ণ সম্পর্কিত দুটি বইয়ে ভূমিকা লিখতে দেখা গেছে। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’বইয়ের ভূমিকায় তিনি সংস্কৃত রামায়ণ থেকে শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছেন (পৌষ, ১৩২০)। রবীন্দ্রনাথকে যোগীন্দ্রনাথ বসু প্রণীত সরল কৃত্তিবাস’অর্থাৎ কৃত্তিবাস-প্রণীত সপ্তকাণ্ড রামায়ণের ভূমিকা লিখতে দেখা গেছে (বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে ১৩১৫ সালে)। যোগীন্দ্রনাথের বইয়ের ভূমিকায় তিনি দুঃখ করে বলছেন, “এতকাল আমাদের দেশের যে কেহ অক্ষর মাত্র পড়িতে জানিত, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং কাশীরামদাসের মহাভারত না পড়িয়া ছাড়িত না, যাহার অক্ষরবোধ ছিল না, সে অন্যের মুখ হইতে শুনিত। এই রামায়ণ, মহাভারত আমাদের সমস্ত জাতির মনের খাদ্য ছিল, এই দুই মহাগ্রন্থই আমাদের মনুষ্যত্বকে দুর্গতি হইতে রক্ষা করিয়া আসিয়াছে। আজকাল। আমরা যাহাকে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলি, সেই সমাজে এই দুই গ্রন্থ এখন আর কেহ পড়ে না। অথচ জনসাধারণের মধ্যে এখনও এই দুই গ্রন্থের আদর রহিয়াছে। ” যোগীন্দ্রনাথ বসুর বই সম্পর্কে আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে একটি চিঠি লিখেছিলেন (কার্তিক, ১৩৩৫) সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ যদি বাঙ্গালি ছেলেমেয়েরা না পড়ে তবে তার চেয়ে শোচনীয় আশঙ্কা আমাদের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না। ”
শিশু কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ দু’ভাবে শিশুকে রামায়ণের সঙ্গে সংপৃক্ত করে দিচ্ছেন, নাম-বাচক শব্দে এবং প্রকৃতি চিত্রণে। কখনো নাম না বলেই শিশু রামায়ণের দেশে পাড়ি দিয়েছে—“মা গো, আমায় দেনা কেন/একটি ছোটো ভাই—দুইজনেতে মিলে আমরা/বনে চলে যাই। ” এখানে নাম না করেও শিশু নিজের সঙ্গে শ্রীরামকে অভেদ কল্পনা করেছে, ছোটো ভাইটি যে সহোদর লক্ষ্মণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতি চিত্রণে রামের বনবাস-জীবন শিশুর কল্পনায় মুহূর্তেই চলে আসে- “চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই/এমনি বরষাতে…”। রাজপুত্রের বনবাসী হয়ে যাওয়া বাঙ্গালি তথা ভারতীয় শিশুর মানস-কল্পনায় কতটা প্রভাব এনেছিল, সহজপাঠ’-এর একটি কবিতায় কবিতা এক লহমায় ধরে দিয়েছেন— “ঐখানে মা পুকুরপাড়ে/জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে/হোথায় হব বনবাসী— কেউ কোত্থাও নেই। /ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধবো তোমার ছোট্ট কুঁড়ে,/ শুকনো পাতা বিছিয়ে। ঘরে থাকব দুজনেই। ” কী বলবেন একে, মিথোম্যানিয়া নয় ? রামায়ণ-ম্যানিয়া নয়! পারবেন তো এই শিকড়কে কেটে দিতে! আমার কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। আপনার?
বাঙ্গালি শ্রীরামকৃষ্ণের, স্বামীজীর, রানি রাসমণির শ্রীরাম- সাধনার ধারা বিস্মৃত হয়েছে। একইদেহে রাম আর কৃষ্ণ সুমধুর; একতারাতে দোঁহে বাঁধা। অথচ অবতার-বরিষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণর পরিচিতির মধ্যে বুধজন যেভাবে তার শ্রীরাম সত্তাকে, শ্রীরাম-সাধনাকে লুক্কায়িত রাখতে চায়, মাঝে মাঝে তা অত্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হয়। কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ তো বলেই বসেন, বাঙ্গলায় শ্রীরাম-উ পাসনা একেবারেই অপ্রচলিত, কোনো একটি রাজনৈতিক দল তার আমদানি ঘটিয়েছে। কিন্তু সত্যিই কী তাই?
১. গদাধরের (শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যনাম) পিতামহ মানিকরাম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। ‘দেড়ে’ গ্রামের এক সদাচারী ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ; দিন কাটতো রঘুবীরের সেবায়। গদাধরের পিতা ক্ষুদিরাম রঘুবীরের পুজো না করে জল পর্যন্ত স্পর্শ করতেন না। জমিদার রামানন্দ রায়ের অত্যাচারে যখন ক্ষুদিরামকে দেড়ে গ্রাম ছেড়ে কামারপুকুর চলে আসতে হলো তখন প্রায় কর্মহীন ক্ষুদিরমের সিংহভাগ কাটতো তার আরাধ্য রঘুবীরকে নিয়ে; রাম-ই তখন তার একমাত্র শান্তি ও প্রাণের আরাম।
২. মানিকরাম-সহ তার বংশের প্রায় সকলের নামের মধ্যে রাম’ কথাটি যুক্ত হয়েছিল, তা অবশ্যই অচেতনভাবে নয়। মানিকরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র তথা শ্রীরামকৃষ্ণের পিতার নাম ‘ক্ষুদিরাম। মানিকরাম তার অপর দুই পুত্রের নাম রাখলেন ‘নিধিরাম ও ‘কানাইরাম’, কন্যার নাম “রামশীলা। ক্ষুদিরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকুমার’, মধ্যমপুত্র ‘রামেশ্বর, কানাইরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রামতারক’; রামশীলার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচাঁদ’; রামশীলর দৌহিত্র ও দৌহিত্রীদের নাম যথাক্রমে রাঘব’, ‘রামরতন’, ‘হৃদয়রাম’ এবং ‘রাজারাম’।
৩. ক্ষুদিরাম এক গ্রীষ্মকালের দুপুরে কাজে বেরিয়েছেন দূর গ্রামে; রৌদ্রতেজে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। পথে এক বৃহৎ গাছতলের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন। তখনই দেখলেন এক বিচিত্র স্বপ্ন। এক শ্যামলা ছেলে বায়না করছে তাকে যেন ক্ষুদিরম সঙ্গে নিয়ে যান। ক্ষুদিরামের তখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু চিনতে পারেন, সেই শ্যামল সুন্দরকে; এ তো বালক রঘুবীর! তিনি দেবসেবা করবেন কী করে! বালক বলছে, সে তো বিশেষ কিছু চায় না, ক্ষুদিরাম যেভাবে রাখবেন সেভাবেই খুশি থাকবেন। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। নির্দেশ অনুযায়ী পাশের ধানক্ষেতে গেলেন। মাটির ঢিপির পাশে এক শালগ্রাম শিলা; একটি বিষধর সাপ তার পাশে। সাপ সরে গেলে আনন্দে শিলাখণ্ডটি মাথায় তুলে নিলে ক্ষুদিরাম। চিনতে ভুল হয় না তার! এ যে সত্যিই রঘুবীর শিলা! অতঃপর রঘুবীরই হয়ে উঠলেন ক্ষুদিরামের গৃহের অন্যতম আদরের রামলালা। , শিলাখণ্ডটিকে তিনি শ্রীরামচন্দ্রের ঘটের পাশে স্থাপন করলেন; রাঘব রঘুনন্দনই তাদের গৃহদেবতা হলেন।
৪. আনুমানিক ১২৩০ সালে ক্ষুদিরাম রামেশ্বর তীর্থ দর্শনে যান এবং একটি বাণলিঙ্গ নিয়ে ফেরেন। ১২৩২ সালে জন্ম নেয় তার দ্বিতীয় পুত্র রামেশ্বর।
৫. শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা রামকুমারকে দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর সেবার দায়িত্ব তুলে দিলেন রাসমণি। ঘটনাক্রমে এই রাসমণির বাপের বাড়িতেও ছিল রঘুবীর। আর রাসমণি বিয়ের পর অচেনা সন্ন্যাসীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন সুলক্ষণ রামশিলা। বোধহয় রামকুমার ও রাসমণির জীবনে এ এক আশ্চর্য সমাপতন। রাসমণি কী চেয়েছিলেন? শ্রীরামঘরানার কোনো পুরোহিতই আদ্যাশক্তির পুজোর ভার নেবেন? শ্রীরাম যোদ্ধাবতার, ক্ষত্রিয় বীর; মা কালী অসুরদলনী। দেশপ্রেমী জমিদার গিন্নীর নেপথ্য-ভাবনা কী ছিল বাঙ্গলার মাটিতে শক্তি সাধনার পীঠ তৈরি করা? তাতে সমন্বয় সাধিত হোক রাম আর কালী?
৫. শ্ৰীম কথামৃতে লিখছেন দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দিরে তার প্রথম দিনের দর্শনের কথা, “এক পার্শ্বে পরহংসদেবের সন্ন্যাসী হতে প্রাপ্ত অষ্টধাতু নির্মিত রামলালা নামধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহমূর্তি ও বাণেশ্বর শিব। ”তা এই রামলালা ঠাকুর পেলেন কীভাবে?
৬. ১২৭০ সাল, তীর্থযাত্রা পথে বিশ্রাম নিতে কালীবাড়িতে এলেন জটাধারী নামক রামাইত সাধু; নিত্য যার সঙ্গে ধাতুনির্মিত শ্রীরামচন্দ্রের শৈশবমূর্তি থাকে। তার ধ্যানজ্ঞান শ্রীরামকৃষ্ণের নিরন্তর সান্নিধ্য ; তার অনুভূতি— শ্যামবর্ণ জ্যোতির্ময় শ্রীরাম নিত্য পুজো নেন তার কাছ থেকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ খুঁটিয়ে দেখলেন এই সেবক -সাধুর রাম পূজন, সাধনভজন-আরাধন; আর জটাধারীর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে লাগলো। শ্রীরামচন্দ্রের শিশুমূর্তিতে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমাকুল হয়ে উঠলেন। তার মনও ধাবিত হলো মায়ের স্নেহের মতো রামলালাকে সেবা করতে দেবশিশুকে কোলে নিতে। ঠাকুরের আগ্রহ দেখে জটাধারী তাকে রামলালার মন্ত্র দিলেন; ঠাকুর মন্ত্র পথে শ্রীরামের অনুসারী হলেন। ঠাকুরের দৈব্য-সেবায় শ্রীরাম ধরা বড়লেন, তিনি দিব্যদর্শন পেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্মুখে এবার আবির্ভূত হলেন দশরথ তনয় শ্রীরঘুপতিরাম; সাধনায় সিদ্ধ হলেন ঠাকুর। আর এই দিব্যলীলা দর্শন করে জটাধারী শ্রীরামকৃষ্ণকে দিয়ে গেলেন তার রামলীলাবিগ্রহটি; উপযুক্ত উত্তরাধিকারই বটে!
৪. স্বামীজীর শ্রীরাম-সাধনা ও মহাবীর-ভক্তি : ১৮৮৬ সালের জানুয়ারি (৭ জানুয়ারি); তখনও নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেননি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়েছে (১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি); শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তার আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন। নরেনের শ্রীরাম ভজনা শুরু হলো। শ্ৰীম (মাস্টারমশাই)-র দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা। ১৩ জানুয়ারি শ্রীম দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন। আর ১৯ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথ-সহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসীবেশী রামের মতো রামাইত সাধুর বেশ ধারণ করলেন। নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভুবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন। নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাবেশী রূপের তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তার ক্ষাত্রধর্ম। অক্ষুন্নই ছিল। শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের শাশ্বত চিন্তন; শৌর্যশালী অথচ তাপসমালী। ভারতবর্ষের তপোবনে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য উ পাচার আর নগর রাজধানে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা— এ দুয়ের এক অমিত মেলবন্ধন হলো শ্রীরামের সন্ন্যাসরূপ। স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনায়। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপুষ্টকরেছেন, বাঙ্গলাতে শ্রীরাম সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। বাঙ্গলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পূজন-আরাধন যে প্রচলিত ছিল তা কবি কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী’ই অমোচ্য প্রমাণ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী