রামজন্মভূমিতে রামমন্দির শুধুমাত্র আর দশটা মন্দিরের মতো একটি উপাসনাস্থল নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মর্যাদার প্রতীক। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সেই ভাবনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। দীর্ঘ পরাধীনতার ফলে আত্মগ্লানি এ দেশকে এমন ভাবে গ্রাস করেছিল যে ভারতীয়দের একটা ভালো অংশ ভারতের প্রাণপুরুষ রামের জন্মস্থল অযোধ্যায়। আক্রমণকারী বাবর নির্মিত অপমান চিহ্ন মসজিদের ধাঁচাকেই ভারতের জাতীয় স্মারক। বলে ভাবতে শুরু করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর নতুন ভারত গড়ে তোলার জন্য রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের নিজস্ব ভাবনাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ব্রিটিশকে বিদায় দিলেও ব্রিটিশের অনুকরণে তৈরি শাসনতন্ত্র দিয়েই নতুন ভারত গড়ে তোলার কাজ শুর হয়েছিল। এই শাসনতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ লেজিসলেটিভ, এক্সিকিউটিভ, জুডিসিয়ারি ও মিডিয়া।
সংবিধান প্রণেতারা ভারতীয় সংবিধানকে এদেশের ধর্মসংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস করেছিলেন। এই ভাবনা থেকেই সংবিধান রচনার সময় ভারতীয় ধর্মসংস্কৃতির। সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য ডাক পড়েছিল প্রবাদপ্রতীম চিত্রকর নন্দলাল বসুর। নন্দলাল বসুর আঁকা সেই সমস্ত ছবি ভারতের মূল সংবিধানে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। মূল সংবিধানের যে পৃষ্ঠায় মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে সেই। পৃষ্ঠাটি শুরু হয়েছে প্রভু রামচন্দ্র, মা সীতা ও লক্ষ্মণের বনবাস থেকে অযোধ্যায় ফিরে আসার দৃশ্য দিয়ে। যে পৃষ্ঠায় ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপ্যাল ও স্টেট পলিসির উল্লেখ আছে তার শুরুতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনকে গীতার উপদেশ দেওয়ার ছবি আঁকা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া হয়েছে নটরাজ, বুদ্ধ, মহাবীর-সহ ভারতের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আঁকা বিভিন্ন ছবি। যত দিন গেছে সংবিধান থেকে এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য মুছে দেওয়া হয়েছে। ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে ভারতকে তার নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি ও নীতিশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তকমা দেওয়া হয়েছে। এখন তো ভারতীয় গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভের ঘুণাক্রান্ত লড়ঝড়ে চেহারা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সমস্ত ব্যবস্থাটিতেই ঘনীভূত হচ্ছে সংকট। ভারতে এখন ঘোড়া কেনাবেচার মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা, বুথ দখল, ছাপ্পাভোট, দুর্নীতির দায়ে উচ্চপদে আসীন রাজনৈতিক নেতা, আইএএস, আইপিএসদের। জেলযাত্রা, পেইড নিউজ, হলুদ সাংবাদিকতা গা-সওয়া ব্যাপার। ভারতে এখন ন্যায়বিচার বিলম্বিত, মহার্ঘ এবং আমজনতার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই সংকট শুধু ভারতেনয়, বিশ্বজুড়ে।
১৯২৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ‘ইয়ং। ইন্ডিয়ায়’ গান্ধীজী লিখেছেন, “রামরাজ্য মানে আমি হিন্দুরাজ বোঝাতে চাইছি না। রামরাজ্য মানে ঈশ্বরের রাজত্ব। আমার কাছে রাম ও রহিম একই। আমি সত্য ও ন্যায় বিচারে ঈশ্বর ব্যাতীত অন্য কোনো ঈশ্বরকে স্বীকার করি না। আমার কল্পনায় রাম এই পৃথিবীতে বাস্তবে ছিলেন কিনা সেটা বড়ো কথা নয়, রামায়ণের প্রাচীন আদর্শ নিঃসন্দেহে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যার সাহায্যে দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়বহুল। পদ্ধতি ছাড়াই সাধারণ মানুষ দ্রত ন্যায় বিচার পেতে পারে। ১৯৩৪ সালে ২ আগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকায় গান্ধীজী লিখেছেন, ‘আমার স্বপ্নের রামায়ণ রাজপুত্র ও দরিদ্র কাঙালের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। ১৯৩৭ সালের ২ জানুয়ারি গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় আবার লিখলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে আমি ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স, রাশিয়ার সোভিয়েত শাসন, ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসন, জার্মানির নাজি শাসনের অনুকরণকে বোঝাতে চাইছি না…আমাদের নিজস্ব কিছু থাকা চাই যা আমাদের সঙ্গে খাপ খায়… আমি এটাকে রামরাজ্য বলি যা নৈতিক আধিপত্যের উপর ভিত্তি করে মানুষের সার্বভৌমত্বকে বর্ণনা করে। গান্ধীজীর ধারণা অনুসারে রামরাজ্যকে রাজনৈতিক দিক থেকে এই ভাবে বর্ণনা করা যায়, ধর্মের ভূমি এবং যা সর্বভূতে একই চেতনা ক্রিয়াশীল এই তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে যুবা, বৃদ্ধ, উচ্চ, নীচ সৃষ্টির সবার এবং এই পৃথিবীর নিজের জন্য সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি, ঐকতান নিশ্চিত করে। এখানে ধর্ম মানে কোনো উপাসনা পদ্ধতি নয়। ধৃধাতু’থেকে আসা ধর্ম হচ্ছে সেই সমস্ত নিয়ম যা ব্যক্তি, সমাজ, প্রকৃতি ও পরমেষ্ঠিকে এক সঙ্গে ধারণ করে রাখে। স্বামী। বিবেকানন্দও বার বার বলেছেন, “তোমরা যদি ধর্মকে জাতীয় জীবনের প্রাণ শক্তি না করে রাজনীতি, সমাজনীতি বা অন্য কিছুকে তার জায়গায় বসাও, তবে তোমরা একেবারে লুপ্ত হয়ে যাবে। এরকম যাতে না হয়, সেই জন্য তোমাদেরকে সব কাজ করতে হবে ধর্মের মধ্য দিয়ে যা তোমাদের প্রাণ শক্তি।… যদি রক্ত সতেজ ও পরিষ্কার থাকে, তা হলে মানুষের শরীরে কোনো রোগ জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। ধর্মই আমাদের জাতীয় জীবনের রক্ত। যদি সেই রক্তপ্রবাহ চলাচলের কোনও বাধা না থাকে… যদি এই রক্ত বিশুদ্ধ থাকে, তবে রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্য যে-কোনও ধরনের বাহ্যিক ত্রুটি-এমনকী দারিদ্র্য পর্যন্ত দূর হয়ে যাবে।
স্বাধীনতা লাভের পর নতুন ভারত রচনার জন্য জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন ভারত সেই ধর্মকে দূরে সরিয়ে রেখে সোভিয়েত স্টাইলে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়ল। গুরুত্ব পেল না গান্ধীজীর গ্রাম স্বরাজ, রামরাজ্য কিংবা স্বামীজীর ভারত গঠনের ধারণা। এই ভারতের বুকেই গড়ে উঠল ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রবর্জিত এক ব্যবস্থা। যার ফলিত রূপ এখন আমাদের চোখের সামনে।বনবাসে যাওয়ার সময় শ্রীরাম ছিলেন দশরথ পুত্র, অযোধ্যার যুবরাজ। ১৪ বছর বসবাসের কৃচ্ছ্বসাধন লড়াই, সংগ্রাম। রাবণের মৃত্যুর পর লঙ্কাধিপতি হওয়ার মতো প্রলোভনের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী’ ভাব নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এলেন তখন তিনি মর্যাদা পুরোষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র। ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমাত্রিক আদর্শের সমাহারের নাম ‘শ্রীরাম’। তিনি ছিলেন আদর্শ পুত্র, আদর্শ ভাই, আদর্শ স্বামী, আদর্শ রাজা। মানব জীবনের সমস্ত গুণাবলীর সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল তার জীবনে। একদিকে তিনি ধৈর্য, ত্যাগ, তিতিক্ষা, শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক, আবার অন্যদিকে সর্বকালের সর্বযুগের আদর্শ প্রজাপালক।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি মনে করা হয়। রাবণ ও বানররাজের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেই যুগেও ক্ষমতাধরদের মধ্যে বহুগামিতার প্রচলন ছিল। কিন্তু রামচন্দ্র নিজের সহধর্মিণী সীতাকে উদ্ধারের জন্য অর্থাৎ নারীর সম্মান রক্ষার জন্য ধৈর্য সহকারে সমাজকে সংগঠিত করে, নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে রাবণের মতো দুষ্কৃতীকে তার যোগ্য শাস্তি দিয়েছেন। আবার অযোধ্যায় ফিরে আসার পর সীতাকে নিয়ে প্রজাদের মধ্যে সংশয়ের বার্তা কানে আসতেই তিনি নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখের কথা না ভেবে তাকে ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে রেখে আসেন। প্রমাণ করলেন রাজার কাছে ‘পতিধর্ম’ ও ‘পরিবার ধর্মের চেয়ে ‘রাজধর্মের’ স্থান অনেক উঁচুতে। নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ দূরের কথা প্রজামনোরঞ্জনের জন্য যিনি নরকেও যেতে প্রস্তুত সেই রঘুপতি রাঘব রাজা রামের রাজত্ব কেমন ছিল? বাল্মীকি রামায়ণে ঋষি বাল্মীকী লিখেছেন—‘ন পর্যদেবন্বিধবা ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম্।/ ন ব্যাধিজং ভয় ব্যাপি রামে রাজ্যং প্রশাসতি। অর্থাৎ রাম যখন রাজ্য শাসন করছিলেন তখন কোনো বিধবাকে বিলাপ করতে শোনা যেত না, হিংস্র প্রাণী থেকে কোনো ভয় ছিল না, ভয় ছিল না রোগব্যাধি থেকেও।
‘আসন্বর্যসহস্রাণি তথা পুত্রসহস্ৰিণঃ। / নিরাময়া বিশোকাশ্চরামে রাজ্যং প্রশাসতি। অর্থাৎ যখন রামচন্দ্র শাসন করতেন সে সময় মানুষ হাজার হাজার সন্তান সন্ততি নিয়ে রোগ ভোগ থেকে মুক্ত হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকতেন। ‘সর্বং মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্ম পরোহভবৎ। রামমেবানু পশ্যতো নাভ্যহিষ্পরস্পরম৷৷’অর্থাৎ প্রত্যেক জীব আনন্দে বসবাস করতো, পুণ্য অর্জনই ছিল সকলের স্বভাব, শুধুমাত্র রামের দিকে তাকিয়ে কেউ কাউকে হত্যা করতো না। নিত্যপুষ্প নিত্যফলাস্তরবঃ স্কন্ধবিস্তৃতাঃ।/ কালবর্ষী চ পর্জন্যঃ সুখস্পর্শশ্চ মারতঃ। অর্থাৎ কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ রহিত হয়ে উদ্ভিদজগৎ ফুলে ফলে সজ্জিত থাকতো, মেঘেরা নিয়মিত বর্ষণ ঘটাতো, বায়ু প্রবাহের স্পর্শও ছিল রোমাঞ্চকর।‘রামো রামো রাম ইতি প্রজানামভব কথাঃ।/ রামভূতং জগাভূদামে রাজ্যং প্রশাসতি৷৷’অর্থাৎরামচন্দ্র যখন শাসন করতেন তখন মানুষের আলাপচারিতার কেন্দ্রে ছিলেন শুধু রাম, রাম এবং রাম। সমগ্র জগৎ যেন রামময় হয়ে গিয়েছিল। সর্বে লক্ষণসম্পন্নাঃ সর্বে ধর্মপরায়ণাঃ।অর্থাৎরাম রাজত্বে সমস্ত মানুষ চমৎকার বৈশিষ্ট্যে বিভূষিত হয়েছিল। পুণ্য অর্জনে সবাই নিজেকে ব্যস্ত রাখতো।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার আলোকে রামরাজ্যের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে—(১) রামরাজ্যে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল যেখানে শাসক শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই শাসন করতেন। (২) প্রত্যেকের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল। (৩) মানুষ দ্রুত ন্যায়বিচার পেত এবং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিও অত্যন্ত সহজে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। (৪) নীতি ও মূল্যবোধই ছিল আইন ও বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি। সরকারের সমস্ত কাজেই প্রতিফলিত হতো সততা ও স্বচ্ছতার নীতি এবং সরকারও মানুষের কাছ থেকে তাই আশা করতো। (৫) প্রশাসনের কাজে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা ছিল না। (৬) রামরাজ্যে সমস্ত মত, পথ সমমর্যাদা ও সম্মান পেত। (৭) ঋষি বাল্মীকি রামরাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে ভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের উল্লেখ করেছেন তাতে এটা স্পষ্ট যে পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি না করে মানবীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন হতো। রামায়ণকে আমরা ইতিহাস অথবা পৌরাণিক কাহিনি যাই বলি না কেন এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে রামরাজ্যের ধারণা আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় রামরাজ্য নামক আদর্শ ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তম্ভের মাঝখানে আরেকটি স্তম্ভ ছিল। ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার সমন্বয়ে নির্মিত সেই স্তম্ভটিই ছিল অন্য সমস্ত স্তম্ভের দৃঢ়তার উৎস, চালিকা শক্তি। অযোধ্যায় প্রস্তাবিত রামমন্দির হচ্ছে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার সমন্বয়ে নির্মিত সেই স্তম্ভের প্রতীক। এই প্রতীক যদি লেজিসলেটিভ, এক্সিকিউটিভ, জুডিসিয়ারি ও মিডিয়া এই চারটি স্তম্ভের চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে তাহলে সার্থক হবে রামমন্দির নির্মাণ।
সাধন কুমার পাল