তিনরায়তিনধর্মবেঙ্গাই_গাঁ

পর্ব_৬ : রাজার রাজা ধর্মরাজার নিকট শালেভর মানত

সঙ্গে সুয় ভকিতা সভাই চলে সাথে।
ধর্ম্মের পাদুকা রঞ্জাবতী নিল মাথে।।
সদুল্যা বাজায় ঢাক হরিহর।

বেদ পড়ে পন্ডিত করিয়া উচ্চস্বর।।

পূজার পদ্ধতি হাথে যান পুরোহিত।
কালিনী গঙ্গার ঘাটে হইল উপনীত।।
জয়ধ্বনি শঙ্খধ্বনি পড়ে ঘন ঘন।
নানা ধনে ধর্ম্মবতী করিল সাজান।।

বেঙ্গাই গাঁয়ের কুলদেবতা শ্যামরায়কে ভিন্ন ভিন্ন তিথিতে দুটি বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে শ্যামরায়কে অন্নভোগ সহ #নিজভোগ নিবেদন করা হয়। আবার অক্ষয়তৃতীয়ার সময় অনুষ্ঠিত #বারোধর্মেরগাজন মহোৎসবে #মনুইভোগ নিবেদনের রীতি আছে। আতপচাল, দুধ , নারিকেল, চিনি বা গুড় দিয়ে একই রন্ধন প্রণালীতে পরমান্নস্বরূপ নিজভোগ এবং মনুইভোগ প্রস্তুত করা হয়। পৃথক নামকরণের কারণটি অতীব সূক্ষ্ম। মনুই ভোগ হল গ্রামদেবতা বা গরামদেবতার প্রীত্যর্থে ভোজ দিয়ে অরিষ্ট বা অমঙ্গল দূরীকরণ। প্রোয়জন বা ক্ষেত্র বিশেষে মনুইভোগ গ্রামবাসীরা নিবেদন করতে পারেন। পক্ষান্তরে নিজভোগ হল ধর্মরাজের নিজস্ব জমি থেকে উৎপাদিত শস্য ও আয় থেকে ক্রীত দুগ্ধ দ্বারা প্রস্তুত ভোগ। এই ভোগ দানের অধিকার একমাত্র সেবাইতদের। কারন তারাই দেবত্তোর সম্পত্তির উপস্বত্ব ভোগ করে থাকেন। হুগলী জেলার মনুই ভোগ সাধারণতঃ ধর্মরাজসেবায় প্রদত্ত হলেও, বেঙ্গাই গ্রামে শঙ্কেশ্বর শিব মন্দিরেও গাজনের সময় এই ভোগ নিবেদনের প্রথা আছে।

নিজভোগ ছাড়া পৌষসংক্রান্তিতে শ্যামরায়ের উদ্দেশ্যে সিদ্ধচালের ভাত – ভোগ, শাক ভাজা , কপির তরকারী , ডাল , বেগুন পোড়া , মাছপোড়া এবং মাছের টক বা অম্বল নিবেদন করা হয়। অতীতে একটি বোয়ালনি মানে স্ত্রী বোয়াল মাছকে সিদ্ধ করে টক প্রস্তুত হত । এখন এই রান্নায় পোনা মাছ ব্যবহার করা হয়। কূর্মাকৃতি শিলায় ধর্ম উপাসনা এবং দগ্ধ মৎস দান প্রাচীন তন্ত্র উপাসনার একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

শ্যামরায়ের বার্ষিক উৎসব রথযাত্রা। পুরাতন কাঠের রথটি ভেঙ্গে যাওয়ায় ১৯৮২ সালে একটি লোহার রথ নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ শিল্পী অমরপুরের কর্মকার সম্প্রদায়ের ফটিক কাইতি। গ্রামের লক্ষ্মীতলায় #রথঘর আছে। সেখানে সারা বছর রথ থাকে । আষাঢ়ের রথযাত্রায় তিন ধর্মরাজ রথে আসীন হন। পালকিতে চেপে রথতলায় যান প্রভু শ্যামরায়। অন্যদিকে দুজন আমন্ত্রিত – তাদের খাটে বসিয়ে মাথায় করে আনা হয়। একজন লস্কর দীঘির জিতেন পান্ডা , কাজল পান্ডা , ষষ্ঠী পান্ডা ও অশোক পান্ডা সেবিত ধর্মরাজ #যাত্রাসিদ্ধি ও অন্যজন ক্ষুদিরাম আচার্য সেবিত ক্ষুদিরায় ধর্ম। সম্প্রতি ক্ষুদিরায় খাটুল গ্রামে স্থানান্তরিত হওয়ায় রথে আসীন হন যাত্রাসিদ্ধি এবং শ্যামরায়।

বার চান্দে পরম সুন্দর রথঘর।
নানা আয়োজন তোলে নৌকার উপর।।
পুরট কলসে লক্ষভার গঙ্গা জল।
পূজা শেষে ভকতি করিতে চারফল।।
চাঁপাকলা চিনি ঘৃত আতপ তন্দুল।
গগন উপরে কত উড়িছে গহুল।।
পশ্চাতে তুলিল তায় নিদারুন শাল।
যাহার সদনে বৈসে বার গন্ডা ঢাল।।

রথঘর থেকে লক্ষ্মীমন্দির পর্যন্ত আধকিলোমিটার পথ রথ যাত্রার জন্য সুনির্দিষ্ট। জনশ্রুতি আছে একসময় এই রথযাত্রায় আমন্ত্রিত হয়ে রথে আসীন হতেন ষষ্ঠীরাম আচার্য সেবিত ক্ষুদিরায় ধর্ম।

শ্যামরায় ধর্মের দোলযাত্রার কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এই দোলযাত্রায় গ্রামস্থ সদগোপ ঘোষরা বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। চাঁচরের দিন ঘোষবাড়িতে শ্যামরায়ের নিমন্ত্রণ থাকে। পন্ডিতরা শ্যামরায়কে কোলে বসিয়ে ঘোষবাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে ঘোষগৃহিনী পরমান্ন ভোগ নিবেদন করেন।আহারাদি সেরে বিকালে মন্দিরে ফিরে আসেন শ্যামরায়। সন্ধ্যায় পালকি চেপে চাঁচর তলায় যাওয়া ,হোলিকাদহন এবং গ্রাম প্রদক্ষিণের পালা।

গ্রামের দুলেপাড়া , সদগোপ অধ্যুষিত মালসপাড়া , উগ্রক্ষত্রিয় পাড়া, খাঁ পাড়া, হাজরাপড়া, সদগোপ অধ্যুষিত রানাপাড়া, কুমোর পাড়া, বৈষ্ণব পাড়া হয়ে আবার পন্ডিত পাড়ায় নিজের গৃহে ফিরে আসেন শ্যামরায়।

রায় অর্থাৎ রাজন্ । শ্যামরায় গ্রামের রাজা বিশেষ। গ্রাম পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর প্রজাদের দেখভাল করে থাকেন , খোঁজ খবর নিয়ে থাকেন। তাঁর চলার পথে গ্রামস্থ প্রজারা চাল ,কলা, মুড়কি, বাতাসা দিয়ে উপঢৌকন বা নজরানা দেন। গরিব প্রজাসকল প্রজাসকল তাঁদের সীমিত সামর্থে অতি সামান্য দর্শনী দিয়ে সেই রাজার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন।

বেঙ্গাই গ্রামে শ্যামরায় ধর্মের নেতৃত্বে বারো বছর অন্তর #বারোধর্মেরগাজন মহোৎসব হয়। সেই উৎসব উপলক্ষ্যে গ্রামে একটি মেলা বসে । উৎসব শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়। বেঙ্গাইয়ের বড় মাঠে বারো হাত লম্বা মাটির বেদী নির্মাণ করে তার উপর বারো ধর্মের আসন পাতা হয়। আমন্ত্রিত হয়ে এই মহাগাজনে যোগ দেন কামারপুকুরের সন্ন্যাসী রায়, দুর্গাপুরের বংশীধারী রায়, তালপুরের বুড়ো রায়, কামারপুকুরের স্বরূপনারায়ণ, খাটুলের ক্ষুদিরায়, লস্করদীঘির যাত্রাসিদ্ধি, গোয়ালাপাড়ার ধর্মরাজ প্রমুখ গ্রামদেবতারা। গাজনে তাঁরা যেন শ্যামরায়ের আত্মীয় স্বরূপ।

চারজন পন্ডিত পাশাপাশি বসে একসঙ্গে পূজা করেন। একজন অর্ঘ্য নিবেদন ও মন্ত্র পাঠ করেন , একজন থাকেন তন্ত্র ধারক, একজন ধর্মমঙ্গল কাব্য পাঠ করেন এবং চতুর্থজন ধর্ম মাহাত্ম্য প্রচার করেন।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের পালা গান হয় সন্ধ্যাবেলা। গাইতে আসেন মাঢ় – গঙ্গাদাস পুরের ষষ্ঠীদাস পান্ডা ও মুঈদাঁড়া গ্রামের রাধারমণ পন্ডিতের দল।

গাজন উপলক্ষ্যে অনেকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এখানে মূল সন্ন্যাসীকে বলা হয় #পাটসন্ন্যাসী। এই পদ অলঙ্কৃত করেন সদগোপ সম্প্রদায়ের এক জনৈক ব্যক্তি। পাট সন্ন্যাসীর সঙ্গে অন্যান্য পুরুষ সন্ন্যাসী থাকেন এবং অবশ্যই থাকতে হয় পাঁচ জন মহিলা সন্ন্যাসীকে । এই সকল মহিলা সন্ন্যাসীদের #আমিনী বলা হয়।

অক্ষয়তৃতীয়ার দিন ধর্মরাজের অভিষেক ও গাজনমন্ডপ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে গাজন উৎসবের শুভারম্ভ হয়। চার হাত লম্বা শাল কাঠের পাটাতনে ভোঁতা পেরেক পোঁতা থাকে । একজন সন্ন্যাসী #শালেভর দেন । সন্তান লাভের ইচ্ছায় আরও অনেকে স্নান সেরে শালে ভর দেন । ধর্মমঙ্গল কাব্যে দেখি রঞ্জাবতী সন্তান লাভের কামনায় শালে ভর দিয়ে ছিলেন। সেই থেকে এই প্রথার শুরু।

বিস্তর সংকটে ধর্ম্ম দিলা দরশন।
চম্পক ধরণী বনি ধর্ম্মের গাজন।।
পুরদত্ত বারুই উসতপুরে ঘর।
এখানে পূজিয়া ধর্ম্ম পাইলা পুত্রবর।।
তুমি এক মনে পূজা কর নিরঞ্জন ।
তীর্থ চূড়ামণী এই চাম্পাই ভুবন।।
তবে যদি মরে ইথে শালে দিয়া ভর।
সাক্ষাৎ আপুনি হবে সেই মায়াধর।।
পশ্চাৎ বলিব ধর্ম্ম পূজা বারতা।
মনে কর সাহস কিবা মন ব্যাথা।।

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ শ্যামরায় : বেঙ্গাই ( হাওড়া জেলার লৌকিক দেব দেবী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.