প্রথমেই জানাই আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।
গ্রামবাসীরা প্রথমে মনে করতেন, বকের বিষ্ঠা! বিগত এক বছর ধরে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়েছে এই সমস্যা। ইদানীং করোনা ভাইরাস (Corona virus)-আতঙ্কে মানুষের নজর নারকেল গাছে। রাতে তোলা নারকেল ছবি ভাইরাল হচ্ছে। কালো রাতের আঁধারে সাদা দাগ; মানুষকে এক ভয়ের পরিবেশ রচনা করিয়ে দিচ্ছে।
পূর্বে ডাব ও নারকেলের গায়ে একরকম নোংরা দাগ হতে শুরু করেছিলো, কৃষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলো, তা মোবাইল-তরঙ্গের কারণে হচ্ছে। কিন্তু তা তো নয়! ওটা হচ্ছে কচি ডাব-নারকেলে মাকড়ের আক্রমণের লক্ষণ, পরে বড় ফলে তার প্রকাশ।
এবার মানুষ মনে করছেন, নারকেল সহ অন্যান্য ফলগাছ যেমন কলা, আম, কাঁঠালের পাতায় সাদা হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল করোনা ভাইরাস (Corona virus) । কিন্তু আদৌ তা নয়, নারকেল পাতায় এটি সংঘটিত হচ্ছে Rugose Spiralling Whitefly (RSW) নামক একটি ক্ষুদ্র সাদা মাছির আক্রমণে।
মাছি(Fly) বললেও তা কিন্তু সাধারণ মাছির অর্ডার ডিপ্টেরা (Diptera)-র অন্তর্ভুক্ত নয়, তার গোত্র এবং পরিবার হল Hemiptera, Sternorrhyncha, Aleyrodidae. পোকার বিজ্ঞানসম্মত নাম Aleurodicus rugioperculatus.
২০১৬ সালে এই মাছিকে কেরালার নারকেল বাগানে প্রথম দেখা যায়। এর আদি নিবাস অবশ্য ভারতবর্ষ নয়, মধ্য আমেরিকার Belize থেকে তা সম্ভবত কোনোভাবে ভারতবর্ষে এসেছে। এই পোকার অসংখ্য কলোনি পাতার রস চুষে খায়, তাতে গাছের পুষ্টি ও জল বহুল পরিমাণে বেরিয়ে গিয়ে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। অধিকন্তু দেখা যায়, এরা যতটা না চুষে খায়, তার বেশি শোষণ করে এবং অতিরিক্ত রস শারীরবৃত্তীয় ভাবে মধুবিন্দু বা Honey Dew আকারে দেহের বর্জ্য-অঙ্গ দিয়ে বের করে দেয়। এইভাবে বেরিয়ে আসা মধুবিন্দুতে ধেয়ে আসে ছত্রাক, তা পাতাকে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা দেয়। গাছ সালোকসংশ্লেষ করতে পারে না, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই পোকা দমন করতে কী সুপারিশ হবে, তা জানতে চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি কীটতত্তববিদ তথা সরকারী আধিকারিক হিসাবে আমার প্রাক্তন সহকর্মী ড. সন্তোষ রায়ের কাছে কয়েকমাস আগে জানতে চেয়েছিলাম। আমি এই সমস্যা নিয়ে এক বছর ধরেই নানান কৃষকের কাছ থেকে খবর পাচ্ছিলাম। আমরা পরস্পর মত বিনিময় করে কৃষকদের জানাই, যেহেতু এখনও এই পোকা দমনের সরকারী সুপারিশ সমন্বিত Control Module হাতে পাই নি, তাই যেকোনো কার্যকরী অন্তর্বাহী কীটনাশক ব্যবহারের সুপারিশ করাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ব্যাপার হবে। কারণ গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে যথাযথভাবে দমনের ব্যবস্থা না করা গেলে, আগামীদিন এই পতঙ্গের দমন করা হাতের বাইরে চলে যাবে। যদি এই পতঙ্গ কোনোভাবে কোনো কীটনাশকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী হয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে আরও বিপদ, কোনো ওষুধেই কাজ হবে না। এই চিন্তা করে আমরা উদ্ভিজ্জ কীটনাশক যেমন বাজার থেকে প্রাপ্ত নিমঘটিত কীটনাশক অথবা খৈনীর দোকানে ফলে দেওয়া ডালপালা সংগ্রহ করে তা পরিমাণ মতো জলে ফুটিয়ে, লঘু করে, স্টিকার মিশিয়ে (তামাক-ঘটিত কীটনাশক) তারসঙ্গে নিম-কীটনাশক যোগ করে গাছে ফুট স্প্রেয়ার দিয়ে স্প্রে করালে বা নতুন শিকড় কয়েকটি কেটে প্লাস্টিকের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার মতো দ্রবণ রেখে গার্ডার বেঁধে গাছকে শোষণ করানো যায়। এইভাবে নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও, তা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। উপরন্তু চেষ্টা করা যেতে নারকেল গাছকে পরিমাণ মত অজৈব ও জৈব সার বছরের নির্দিষ্ঠ সময়ে প্রয়োগ করা। তাতে সবল গাছ, এই পোকার আক্রমণ অনেকটা সহ্য করতে পারবে। পটাশ সার প্রয়োগ গাছকে পোকা ও রোগ সহনশীল করে তোলে। তাই মিউরিয়েট অব পটাশ বা পটাশ নুন স্প্রে করালে (এক লিটার জলে ১৫ গ্রাম) কিছুটা উপকার পাওয়া যাবে। রাসায়নিক দমনবিধি জানতে পারলে এই দেওয়ালে আবারও জানাবো।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।