অনুভব করতে পারলে কলকাতা শহর থেকেও কিন্তু জীবনের শিক্ষা পাওয়া যায় । sophistication এর মোড়ক পরা এই শহরটির ভিতর লুকিয়ে আছে আর একটি শহর , যার চটক নেই , গমক নেই কিন্তু আছে অন্তরঙ্গ এক হৃদয় যার প্রতি পরতে নির্মল জীবনের গন্ধ ।
মোটামুটি বছর দশেক আগের একটি রবিবার । কোন একটি কাজে বউবাজারে এসেছিলাম । ওখানেই হঠাৎ দেখা কলেজ জীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে । দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে হঠাৎ মনে হল ডিউক রেস্তরাঁয় যাব । ভাবামাত্র কাজ , ঠিক করলাম দুই বন্ধু মিলে হেঁটেই চলে যাব । ভীম নাগের মিষ্টির দোকানের কাছে এসে দেখি গোটা আকাশটা কুচকুচে কালো হয়ে গিয়েছে । জোরে হাওয়া দিচ্ছে । নিমিষের মধ্যে এত অন্ধকার হয়ে এল দেখি একটা ট্রাম হেডলাইট জ্বালিয়ে শ্যামবাজারের দিকে যাচ্ছে । ভাবলাম আর তো বড়জোর মিনিট দশেকের রাস্তা — তাড়াতাড়ি হাঁটলে বৃষ্টি নামার আগেই পৌঁছে যাব । সেন্ট্রাল এভিনিউয়ে পা রাখতে টের পেলাম ঝড়ের দাপট । কোথাও যে দাঁড়াব তাঁর উপায় নেই । অন্যদিন দোকান-টোকান খোলা থাকে আজ রবিবার বলে সব বন্ধ । হঠাৎ নজরে এল জবাকুসুম হাউসের পাশে ভাঙাচোরা একটি বাড়ি থেকে একজন ইশারায় ডাকছে আমাদের । বাড়ীটার উপরে পুরসভার সতর্কীকরণ নোটিশ ‘ বিপজ্জনক বাড়ি ’। কিন্তু তখন আর ওসব দেখে কে ! দৌড়ে ঢুকে পড়লাম সেই বাড়ির অন্দরে ।
এ কোথায় এলাম ? ঘরটায় ঢুকে অন্ধকারে প্রথমে কিছু দেখতেই পাচ্ছিলাম না । চোখটা সয়ে গেলে দেখি এটি এই অঞ্চলের ঠেলাওয়ালা , রিক্সাওয়ালাদের আস্তানা । একপাশে গুটিয়ে রাখা সার সার চট জড়ানো বিছানা । আর এক পাশে মাটির উনুন , মশলার কৌটো । তারই মধ্যে একটা কোণে প্রদীপ জ্বলছে । রাম -সীতা ও বজরঙ্গবলীজির ছবি ঝুলছে । ঐ প্রদীপের এক চিলতে আলো ঘিরে জনা সাত- আটেক লোক । তাদেরই একজন আমাদের বলল , ‘ বৈঠিয়ে বাবু ’ । তার হাতে একটি ছেঁড়াখোঁড়া ‘ রাম চরিতমানস’ । আমরা একটা চটের আসনে বসতেই শুরু হয়ে গেল ‘রামচরিতমানস’ পাঠ ।
‘ এক সময় সব সহিত সমাজা ।
রাজসভা রঘুরাজ বিরাজা । । ’
বিশ হাত দূরে সেন্ট্রাল এভিনিউ , তিলোত্তমা কলকাতার নাগরিক জীবনস্রোত , গাড়ীর হর্ন , হোটেল , বার । আর তারই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে আজও স্পন্দিত তুলসিদাস ।
ভাঙা ঘরটায় দরজা বলতে কিছু নেই , চটের বস্তা ঝোলানো । ঝড়ের দাপটে সেই বস্তা উড়ছে — গায়ে লাগছে বৃষ্টির ছাঁট , বাতাসে কেঁপে উঠছে প্রদীপের শিখা । আর সেই কম্পমান স্বল্পালোকে অবিচল শুধু কথক আর তার মুগ্ধ শ্রোতারা । বাইরের মেঘ গর্জনের মধ্যেও সুরেলা কন্ঠে কথক পড়ে চলেছেন —-
‘ সুমিরত জহি মিটাএ অজ্ঞান,
সোই সর্বজ্ঞ রামু ভগবান । ’
কথক ব্যাখ্যা করছেন , জিন কি স্মরণমএসে অজ্ঞান নাশ হো জাতা হ্যায় । ওহী সর্বজ্ঞ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রজী হ্যায় । সব কুছ রামজীকে কৃপা । ’
বৃষ্টির দাপট কমতে যখন ঘর থেকে বাইরে পা দিলাম , রাস্তায় তখন হাঁটু জল । আমাদের দুজনের হাতে দুটো করে ভিজে বাতাসা । দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আমাদের হাতে প্রসাদ তুলে দিয়ে কথক ঠাকুর বিদায় জানিয়ে বললেন , ‘ বাবুজি সামহালকে জাইয়ে । জয় শ্রীরাম । ’
আধুনিকতার গুঁতোয় কবেই হারিয়ে গিয়েছে সেই ভাঙা বাড়িটা । আমার বুকের মধ্যে কিন্তু রয়ে গিয়েছে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির দিনে আমাদের আশ্রয় দেওয়া দেহাতি মানুষগুলোর আন্তরিকতা , মন । এই মনটাই তো ভগবান রাম যা কোটি কোটি ভারতীয়র অন্তরে প্রজন্ম ধরে রয়ে গিয়েছে ।
জয় শ্রীরাম ।
সৌভিক বসু