তখনও রামকৃষ্ণ (Ramakrishna) -বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের গনগনে রোদ্দুর; তখনও ঠাকুর-মা-স্বামীজির সামীপ্যে আসা বহু মানুষ জীবিত; এমতাবস্থায় কেন প্রয়োজন ঘটলো আর একটি সন্ন্যাসী-সঙ্ঘের? “যত মত তত পথ“-এর বাণীতে বহুধা বিভক্ত হিন্দু সমাজের তো কাছে আসার কথা ছিল! তবে কেন হিন্দু সমাজকে ডাক দিয়ে ‘শক্তি-সংগঠন-সেবা-সমন্বয়-সংযম‘-এর আদর্শে ফের তৈরি করতে হল ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ‘? (Bharat Seva Sharam Sangh)
তার কারণ হল, দেব-অসুরের দ্বন্দ্ব সমাস। অবতার বরিষ্ঠের অমর-বাণীর ব্যাখ্যায় সম্ভবত ভুল হয়েছিল। অমর-পথে আসুরিক শক্তি বা হিংস্র-মতের কথা থাকতে পারে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল যথার্থ হিন্দু সমাজ, কিন্তু কথার বিতর্কে তা ভেসে উঠতে পারে নি। এমনই সময় বাংলায় নেমে এলো হিন্দুদের উপর বিধর্মীদের আক্রমণ-অত্যাচার, তারও পরে মুসলিম লীগের শাসনে এলো ধারাবাহিকতা। হিন্দুরা তাই নতুন করে ভাবতে শিখলো যাদের পথ কেবলই আসুরিক, যাদের কাছে হিন্দু মাত্রেই কাফের ও হিদেন, তাদের সর্বধর্ম সমন্বয় শেখানো নিতান্তই বাতুলতা ।
শতধা বিচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজকে কেটে কেটে টুকরো করতে চাইলো তখনকার ‘টুকরে-গ্যাং‘, তাদের সাথে আপাত ফারাক ছিলো না রাজনীতির সুবিধাবাদী কিছু মানুষের, ফারাক করা গেলো না চতুর বুদ্ধিজীবীকে; তারা বরং হিন্দুদের বিভেদ বাড়িয়ে দিয়ে কোনও কোনও শাস্ত্রের দিকে আঙুল তুললো। হিন্দুদেরকে যথাসম্ভব শাস্ত্র-বিরোধী করতে সচেষ্ট হল তারা; অথচ দেখা গেলো শাস্ত্রে এমন কাজের নির্দেশ দেওয়া তো দূরের কথা, সমর্থনও নেই। এমতাবস্থায় অনাদি-অনন্ত হিন্দু জীবনচর্যার সাময়িক বিক্ষিপ্ততায়, নতশির জাতির সামনে উপস্থিত হলেন এক তাপস-শ্রেষ্ঠ। কর্মযোগী শিবপুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ হিন্দুদের দিয়ে গেলেন অকুতোভয় আত্মবিশ্বাসের সুর । হিন্দুধর্মের আহ্বান “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা” তো আছেই; “অয়তু সর্বতো স্বাহা” তো ছিলই; এবার তিনি বলতে এলেন, “হিন্দু বিদ্যায় বড়, বুদ্ধিতে বড়, অর্থ সামর্থ্যেও সে কাহারও অপেক্ষা কম নয়। কিন্তু নাই কেবল সংহতি শক্তি। এই সংহতিশক্তির অভাবেই হিন্দু আজ সর্বত্র লাঞ্ছিত, নির্যাতিত। সর্বপ্রকার ভেদ-বৈষম্য, অনৈক্য-পার্থক্য, ঈর্ষা-দ্বেষ বিদূরিত করিয়া এই শতছিন্ন হিন্দু সমাজকে যদি আবার ঐক্য, সখ্য, প্রেম, প্রীতি ও মিলনের সূত্রে সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ করা যায়, তাহা হইলেই হিন্দু আবার তাহার সুপ্ত শক্তির পুনরুদ্ধার করিয়া জগতে অজেয় হইয়া দাঁড়াইতে পারিবে।” তিনি বললেন, ” আমি হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দিতে চাই। আমি সমগ্র হিন্দু জনসাধারণকে ‘আমি হিন্দু, আমি হিন্দু, আমি হিন্দু’ জপ করাব।”
হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার মূল্য চুকাতে হয়েছিল যুগাচার্যকে। স্বার্থান্বেষীরা তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক‘ বলে দেগে দিলেন; যেমন দেগে দিয়েছিলেন ‘বন্দেমাতরম-এর রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্রকে; যেমন দেগে দেওয়া হয়েছিল ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে (Dr. Shyam Prasad Mukherjee)। অথচ বঙ্কিম সবসময়েই বুদ্ধিজীবীর সততা রক্ষা করেছেন, মুসলমানদের হিংসাত্মক কাজের সমালোচনা করলেও ইসলামের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেন নি। বঙ্কিম ইতিহাস বিকৃতি কখনও করেন নি। একইভাবে শ্যামাপ্রসাদকে অসাম্প্রদায়িক বলে বর্ণনা করেছিলেন বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কোনো ব্যক্তি যদি স্বধর্মানুরাগে হিন্দুদের জাগাতে চান, কোনো তাপস যদি সঙ্ঘশক্তিতে হিন্দুকে বাঁধতে চান, তবে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন কেন?
ভারতবর্ষের (India) মুসলমানেরা সেই সময় সঙ্ঘবদ্ধই ছিল, সুগঠিত ছিল ভারতীয় খ্রীষ্টানেরাও, কেবল হিন্দুরা ছিল অসার-অবশ হয়ে ঘুমিয়ে। এমনই জাতিকে জাগিয়ে, তারই শাখা-প্রশাখাগুলিকে সমন্বিত করে হিন্দু জাগরণ ঘটালেন একজন জাদুকর, হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া — যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ। বললেন, ভারতবর্ষকে যদি শক্তিশালী করতে হয়, তবে শক্তিশালী হিন্দু জাতির উত্থান ছাড়া তা সম্ভব নয়। বললেন, নানা জাতির মিলন সর্বদা সমানে-সমানে হওয়া উচিত, সবলে-দুর্বলে নয়। হিন্দুকে তাই সবল হতে হবে।
যুগাচার্য পরিস্কার করে দিলেন, ” আমি সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে চাইনে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী দুষ্টের দমন চাই। ” সেবা আর হিন্দু মিলন মন্দির নির্মাণের জন্যই তাঁর ধরায় আসা; ‘হিন্দুরক্ষী দল’ গঠন করে আত্মরক্ষা, ক্ষাত্রশক্তি ও সংহতিবলের সঞ্চারের জন্যই তাঁর ধরাধামে আগমন। ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধান করতে তিনি এসেছিলেন। সহস্র স্ব-জাতি সহস্র স্ব-ধর্মপ্রেমী কর্মী, শত শত ত্যাগী সন্ন্যাসীকে হিন্দু-ভাবনায় ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে তাঁর আবির্ভাব। তিনি মিলনের ঈশ্বর; সে মিলন হিন্দুত্বের, সে সমন্বয় সনাতনের, সে বাঁধন অখণ্ড ভারতবর্ষের — “শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়/ বাজিতপুর প্রাণের পুর, মিলনভূমি ভাই ।” এ মিলন একান্তই হিন্দু মিলন, এই কথাটি পরিস্কার করে শোনার জন্য হিন্দু অপেক্ষা করে বসে ছিল।
ভারতীয় সভ্যতার এক যুগসন্ধিক্ষণে প্রণব-ধ্বনি বেজে উঠলো। স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) জীবসেবার বাণীকে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নাম ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ।