ভাবঘনমূর্তি শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দ (Srimati Swami Pranavananda) এক যুগপুরুষ, পতিতপাবন, ত্যাগব্রতী সন্ন্যাসী ও আচার্য; যিনি হিন্দু জাতি-গঠনের জন্য জনসংগঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। যিনি প্রাচীন ভারতীয় সঙ্ঘজীবনের সাদৃশ্যে, বৌদ্ধবিহার ও বৃহত্তর শিক্ষাসঙ্ঘের অনুকরণে সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসে সৃষ্টি করেছিলেন; তারই পরিণতি ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ‘(Bharat Sevaharam Sangh), যার কর্মক্ষেত্র মূলত ভারতবর্ষ, ভারতীয় জাতির পুনর্গঠনই যার উদ্দেশ্য।
সঙ্ঘ-সৃষ্টি বিষয়ে তিনি বলছিলেন সংগঠনের নামে ‘ ভারত ‘ কথাটি থাকা আবশ্যক। ভারত শব্দের দ্বারা বোঝাবে এই সঙ্ঘ ভারতীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভারতের সুমহান ধর্ম, সংস্কৃতি, আদর্শ ও ভাবধারা সমগ্র জগতে প্রচার করবে। সনাতন বৈদিক আদর্শই হবে এই সঙ্ঘের ভিত্তি। ‘ আশ্রম ‘ এই শব্দটি দিয়ে বোঝা যাবে — এই সঙ্ঘের মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রাচীন ভারতের বৈদিকভাব ও শিক্ষা-সংস্কৃতির আদর্শ। সুতরাং ‘আশ্রম‘ শব্দটিও বাদ দেওয়া চলবে না। জাতি-সমাজ-ব্যক্তির সর্ববিধ সেবাই হবে সঙ্ঘের প্রধান কাজ; তা হতে পারে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক অথবা আধ্যাত্মিক। সেবাই হবে সঙ্ঘের ধর্ম, সেবাই হবে সঙ্ঘের কর্ম; সুতরাং ‘ সেবা‘ কথাটিও থাকবে। ‘ সঙ্ঘ ‘ শব্দে রয়েছে সংহতি-চেতনা, তা বৌদ্ধ যুগের সন্ন্যাসী সঙ্ঘের অনুরূপ। এই সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, “আমার সঙ্ঘ হবে দ্বিতীয় বুদ্ধের সঙ্ঘ। আমি সমগ্র দেশ ও জাতিকে বুদ্ধ-শঙ্কর-চৈতন্যের মত আদর্শ ও তপঃশক্তিতে সঞ্জীবিত করতে চাই।” স্বামী প্রণবানন্দ সঙ্ঘশক্তি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, কারণ, একটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বিশাল জাতিকে এক ধর্মসূত্রে গেঁথে নেবার প্রয়োজন ছিল। অতএব সংগঠনের নামে সঙ্ঘ-শক্তি-সূচক শব্দ তিনি যোগ করেছিলেন।
প্রণবানন্দ মহারাজের ‘সেবা‘-র পরিধি ছিল বহুধা বিস্তৃত; সেবা বলতে তিনি কেবলমাত্র দুর্গত মানুষের সহায়তা, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা বোঝান নি; সমস্ত মানুষের সঠিক উন্নয়নকে তিনি ‘সেবা‘ বিবেচনা করতেন। ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’ তাই তীর্থ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, আদিবাসী-বনবাসী মানুষের উন্নয়ন, দাতব্য চিকিৎসা র পাশাপাশি হিন্দু সংস্কৃতির উদ্বোধন, হিন্দুর সুরক্ষা এবং শুদ্ধিকরণের দ্বারা ধর্মান্তরিতকে হিন্দু ধর্মে পুনর্বাসন কে সেবা প্রতিপন্ন করে তুলেছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মের মানুষকে মহামিলনে সম্মিলিত করাকেও সেবা আখ্যা দিয়েছিলেন। তাই সঙ্ঘ-সন্ন্যাসী স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “স্বামী প্রণবানন্দ তৎপ্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী প্রণবমঠের ধর্মীয় লোকহিতকর কর্মসাধনার মাধ্যমে তথা তদীয় ভাগবত ব্যক্তিত্বের উদার আলোকে যে মহামিলনের বাতাবরণ সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহা অনবদ্য ও অতুলনীয়।”
১৯১৭ সালের মাঘীপূর্ণিমায় বাজিতপুরের সিদ্ধপীঠে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয় কর্মযোগের মাধ্যমে। পরে ১৯২২ সালে কলকাতায় একটি ভাড়াবাড়িতে আশ্রম স্থাপিত হয়। ১৯২৩ সালে বাজিতপুরের সিদ্ধপীঠে মাঘীপূর্ণিমার পরদিন সঙ্ঘ-সন্তানদের একটি আলোচনা সভায় সংগঠনের নামকরণ হয় ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ‘ (Bharat Sevaharam Sangh)। ১৯৩০ সালে তিনি বাজিতপুরেই গড়ে তোলেন ‘ শ্রীশ্রী প্রণব মঠ‘ ।
একদা আঞ্চলিক সেবাশ্রমগুলির মাধ্যমে ব্রহ্মচারী বিনোদ (স্বামী প্রণবানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ‘বিনোদ’) সেবার যে বীজ বপন করেছিলেন, তাই আজ ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’ নামে পল্লবে-কুসুমে বিপুলায়তন হয়ে বনস্পতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ ভারতের কোণে কোণে, নানান তীর্থস্থানে তার শাখাপ্রশাখা; ভারতের বাইরেও বৃদ্ধি হয়েছে তার কর্মযোজনা। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ তাই ভারতের গর্ব, বিশ্বেরও অস্মিতা।
স্বামী প্রণবানন্দ মনে করতেন, ভারত ‘ব্রহ্মৈব ব্রহ্মবিদ‘ অলৌকিক তপঃশক্তির অপূর্ব মহিমাঘন-মূর্ত আদর্শ। এই আদর্শকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে, তাতে সমগ্রজগৎ শান্তি ও সান্ত্বনা পাবে। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সূচনা তারই ফলশ্রুতিতে। তাই এটি একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠান।
স্বামী প্রণবানন্দ পরিস্কার করে বর্তমান যুগের আকাঙ্খিত বিষয়গুলি সূত্রাকারে বলে গেছেন। চারটি সূত্র — মহাজাগরণ, মহাসমন্বয়, মহামিলন এবং মহামুক্তি । হিন্দু তার সুদীর্ঘ অচৈতন্য অবস্থা থেকে জেগে উঠে সকল বাধা ছিন্ন করে পারস্পরিক সমন্বয়ের কাজ করবে, আর তাতেই হবে মহামিলন, এরই বেদীমূলে হিন্দু এক মহান জাতি হিসাবে মুক্তি পাবে। হিন্দু জাতির জন্য তিনি সাধন-উপলব্ধির মহান-সত্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এটাই হল সঙ্ঘবাণীরূপে দশটি ঐশী-সন্দেশ (Ten divine messages ), এগুলিকেই তিনি জগতের কল্যাণের জন্য প্রচার করতে বলেছেন, যাকে বলা যায় যুগ-মন্ত্র, যাকে অভিহিত করা যায় হিন্দু-জাগরণ-মন্ত্র হিসাবে; যা দেশবাসীর নিত্যপাঠ জরুরি। কী এই সঙ্ঘবাণী , তা এক ঝলকে জেনে নেবো।
১. লক্ষ্য কি? What is the Goal of life?
লক্ষ্য হল আত্মতত্ত্বোপলব্ধি এবং মহামুক্তি (Self-realization and Universal emancipation)
২. ধর্ম কি? What is religion?
ধর্ম হল ত্যাগ, সংযম, সত্য ও ব্রহ্মচর্য (Self-sacrifice, Self discipline, Adherence to Truth and Continence)
৩. মহামৃত্যু কি? What is Real Death?
আত্ম-বিস্মৃতি (Forgetfulness of the ‘self’)
৪. প্রকৃতজীবন কি? What is Life?
আত্মবোধ, আত্মস্মৃতি, আত্মানুভূতি (Self-realization, Self-remembrance, Self-conciousness)
৫. মহাপুণ্য কি? What are Real Virtues?
বীরত্ব, পুরুষত্ব, মনুষ্যত্ব এবং মুমুক্ষুত্ব (Heroism, Virtuality, Manliness, Aspiration for Emancipation)
৬. মহাপাপ কি? What are Real Sins?
দুর্বলতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, সঙ্কীর্ণতা এবং স্বার্থপরতা (Weakness, Fear, Cowardice, Meanness and Selfishness)
৭. মহাশক্তি কি? What are Real sources of strength?
ধৈর্য, স্থৈর্য এবং সহিষ্ণুতা (Patience, Fortitude and Endurance)
৮. মহাসম্বল কি? What are Real Assets?
আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা, আত্মমর্যাদা (Self-confidence, Self-reliance, Self-respect)
৯. মহাশত্রু কি? What are Real Enemies?
আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা, রিপু ও ইন্দ্রিয়বৃন্দ (Indolence, Slumber, Inertia, Procrastination)
১০. পরমমিত্র কি? What are Real friends?
উদ্যম, উৎসাহ, অধ্যাবসায় (Energy, Enthusiasm and Perseverance)
“ধর্মই বর্ম“, “হাতে কাম (কাজ), মুখে নাম“, ” মহামৃত্যু হল আত্মবিস্মৃতি” — যার বাণী তিনি হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয়পাত্র যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ। আজ ছিল তাঁরই শ্রদ্ধাঞ্জলী সভা, শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের ১২৫ তম আবির্ভাব বর্ষে (১৮৯৬-২০২০)। আয়োজনে লোকপ্রজ্ঞা, অখিল ভারতীয় প্রবুদ্ধ মঞ্চ ‘প্রজ্ঞাপ্রবাহ-র শাখা। আলোচনার বিষয়: ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের নামকরণে মধ্যে ‘ভারত-বোধ’, ‘সেবা-ব্যাপ্তি’, ‘আশ্রমিক হিন্দুত্ব’ এবং ‘সঙ্ঘশক্তি’ সূচক শব্দবন্ধ। উপস্থিত রয়েছেন ‘প্রণব‘ পত্রিকার সম্পাদক স্বামী যুক্তানন্দ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী, প্রজ্ঞাপ্রবাহের পূর্বাঞ্চল ক্ষেত্র-সংযোজক শ্রী অরবিন্দ দাশ প্রমুখ। ১৫ ই মার্চ, ২০২০; ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কলকাতা হেডকোয়ার্টার, শ্রীনাথ সভাগৃহ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।