মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক-একটি রোগ মহামারী হিসাবে এসেছে। পবিত্র বাইবেলের দ্বিতীয় অধ্যায় এক্সোডাস বা গণপ্রস্থান। এখানে মিশরের সভ্যতা, ফারাওয়ের সাম্রাজ্য মহামারীতে ধ্বংসের কথা আছে। ১৩৪৭ সাল থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের জনসংখ্যার অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষের প্রাণ নিয়েছিল এক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ—প্লেগ।


পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগটি হল স্মলপক্স’। বহু পুরনো এই ভাইরাস বা জীবাণু ঘটিত রোগ। খ্রিস্টপূর্ব ১১৫৭ সালে মৃত্যু হয় ফারাও পঞ্চম র‌্যামসিসের। তাঁর মমি করা দেহের মুখমণ্ডল, চিবুক, গলাসহ সর্বত্র স্মলপক্সের দাগ স্পষ্ট। স্মলপক্স গত শতাব্দীতে আনুমানিক ৩০ থেকে ৫০ কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ (Who) পৃথিবী থেকে স্মলপক্সের বিদায়ের কথা ঘোষণা করে।
গত কয়েক মাসে বিশ্ববাসীকে আবার ভাবিয়ে তুলেছে ‘উহান করোনা ভাইরাস।’ কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলছেন, এই রোগ বিশ্বের সামনে ভয়ানক বিপদ নিয়ে আসবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে রোগটি এতটা সাংঘাতিক নয়। ৫১,৩৩৪টি ‘ক্লোজড কেসের’ মধ্যে ৪৮,২১৫ জন রোগমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।


নোভেল করোনা ভাইরাসে (Novel Corona Virus) এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর হার শতাংশ। তাই প্রাথমিকভাবে বলা যায় যে অনেক কঠিন অসুখের থেকে এই করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ সহজ উপশমযোগ্য ব্যাধি। এর একমাত্র ভয়ের বিষয় হল এর উৎপত্তিস্থল চীন। গত ফেব্রুয়ারির ১৬-২৪ তারিখ পর্যন্ত হু এবং চীনের যৌথ মিশনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির পর্যালোচনা চলে। সেই রিপোর্টেও দুশ্চিন্তার কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীন সরকার অবশ্য এ বিষয়ে ভাইরাল জেনোমিক্স, অ্যান্টি ভাইরাল গবেষণার পরেই গুরুত্ব দিয়েছে ‘ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনের’ (Traditional Chinese Medicine)। চীনে বিরোধী দলও নেই আর লেফট লিবারাল সংবাদ মাধ্যমও নেই। তাই ‘ট্রাডিশনাল মেডিসিনে’ (Traditional Medicine) গোমূত্র দিচ্ছে বলে কেউ চিৎকার চেঁচামেচিও করবেন না। ভয়টা অন্য জায়গায়। চীনে সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক হবে না। কেবলমাত্র রাজনৈতিক এবং একনায়কতান্ত্রিক হবে। এই মিশনে চীন, জার্মানি, জাপান, কোরিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকার সর্বমোট ২৫ জন প্রতিনিধি থাকলেও তাইওয়ানকে জোর করে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ তাইওয়ান থেকে বছরে ৬০ হাজার বিমানযাত্রায় প্রায় ১ কোটি মানুষ চীনে (China) যাতায়াত করেন প্রতি বছরে। তাইওয়ান করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ দিতে চেয়েছিল।


চীনের (China) চাপেই হু তাইওয়ানকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) চীনের (China) বিরোধিতার জন্য তাইওয়ানকে জরুরি সতর্কবার্তা, তথ্যাদি পাঠায় না। অথচ তাইওয়ান বিশ্ববাণিজ্য, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসার এক অন্যতম স্থান হয়ে উঠেছে গত কয়েক দশকে। তাই বিপদ বাড়ছে সারা পৃথিবীর। তাইওয়ানের উপর চীন বহুদিন ধরে অমানবিক অত্যাচার করেছে। ১৯৪৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে তাইওয়ানে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের উপর নেমে এসেছিল চরম নিপীড়ন। রেড আর্মি চীনের ক্ষমতা পাওয়ার পরে সেটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাস। তাইওয়ানের লোকে তাকে ২২৮ (ফেব্রুয়ারি ২৮) বা শ্বেতসন্ত্রাস বলে ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করে। অদ্ভুত বিষয় হল গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলের অত্যাচার নিয়ে এরাজ্যে পাতাজোড়া উত্তরসম্পাদকীয় লেখা হয় বা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ বলে হাতে গোনা দু’চারজনের বিক্ষোভও গুরুত্বসহকারে একশ্রেণীর কাগজ ছাপিয়ে চলেছে। কিন্তু তিব্বত বা তাইওয়ানের মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের প্রায় কোনও বিবরণই বাংলার মানুষকে এঁরা জানান না। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাইপেয়ির সঙ্গে আরও একবার নিষ্ঠুরতম আচরণ করল চীন (China)।
করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনে হওয়ায় দুটি প্রধান সমস্যা হয়েছে। প্রথম সমস্যা হল, আধুনিক পৃথিবীর এটি এমন একটি জায়গা যেখানে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কোনও স্থান নেই। ইন্টারনেট এবং বাইরের সংবাদমাধ্যম অর্থনৈতিক সংস্কারের পরে অল্পবিস্তর প্রবেশ করলেও আদতে তাদের হাত-পা বাঁধা। সরকারি সংস্থা সিনহুয়া, সিসিটিভি আর পিপলস ডেইলির অনুমতি ছাড়া কিছুই প্রকাশ পায় না। তাই করোনা রোগের গতিপ্রকৃতি, প্রকৃত সংখ্যা, বিপদের মাত্রা প্রায় কোনও কিছুই ঠিকঠাক প্রকাশিত হচ্ছে না। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আর ইউরোপের মহাকাশ সংস্থাগুলি এক অদ্ভুত সঙ্কেত দিয়েছে। চীনে বায়ুদূষণ আশ্চর্যভাবে কমে গিয়েছে। পরিবেশদূষণ পরিমাপ করে যেসব মহাকাশযান, তারা দেখিয়েছে যে চীনে (China) নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। সেটা শিল্পবাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলেই সম্ভব। সিনহুয়ার পরিবেশিত করোনা প্রকোপের সঙ্গে এই পর্যবেক্ষণ মেলে না। এই ঘটনা সোভিয়েত রাশিয়ার চেরনোবিলের ১৯৮৬ সালের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের (Nuclear power plant) দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিনও কমিউনিস্ট রাশিয়া বহুদিন সত্যি কথাটি বলেনি। তেজস্ক্রিয়তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্যদেশে যখন পৌঁছে গিয়েছে তখন জানা গেল রাশিয়ার ঘেরাটোপে কী ভয়ানক ঘটনা ঘটে গিয়েছে।


আজও পৃথিবীর মধ্যে যেক’টি দেশ সবচেয়ে বিপজ্জনক সেগুলি এমনই ‘তথাকথিত সমাজবাদী’ ঘেরাটোপের মধ্যে আছে। উত্তর কোরিয়া, চীন প্রভৃতি সবার ক্ষেত্রেই সমস্যাটা একইরকম। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও সেখানে মধ্যযুগীয় গোপনতা। ‘তথাকথিত সমাজবাদী’ বলার একটা কারণ আছে। সমাজবাদের যেসব গালভরা কথা শুনে বাঙালি বড় হয়েছে গত অর্ধ শতাব্দীতে তার কোনও কিছুই প্রায় এই দেশগুলিতে নেই। সমাজবাদী চীনে পৃথিবীর সবথেকে বড় স্পেশাল ইকনোমিক জোন (এসইজেড), কোথায় ‘বিশ্বজুড়ে যৌথ খামার?’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিপতিরা চীনের হুনান প্রদেশের এসইজেডে শ্রমিকদের শোষণ করছেন। ওয়ার্কার্স পার্টি অফ কোরিয়ার শাসনে আজকের উত্তর কোরিয়া। সাধারণ মানুষের জীবনের দাম একটি পিঁপড়ের থেকেও কম। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে গণতন্ত্রও নেই, তাই গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমও নেই। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ যে ‘অচলায়তন’-এর ছবি বর্ণনা করেছিলেন, ২০২০ সালে টিকে থাকা কমিউনিস্ট দুনিয়াতে হুবহু সেই চিত্র। ২০২০ সালে আধুনিক মানবসভ্যতার সেটাই অন্যতম বড় সঙ্কট।


দ্বিতীয় আশঙ্কা হল, উহান করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে। এটি আদৌ বাদুড়ের স্যুপ খেয়ে হল, নাকি মানুষই এটিকে তৈরি করে ছড়িয়েছে? ১৭৮৯ সালে সম্ভবত ইংরেজরা অস্ট্রেলিয়াতে স্মলপক্সের জীবাণু নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন সিডনিতে ইংরেজ উপনিবেশকে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের প্রতিরোধ থেকে বাঁচানোর আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার যুগে যে জঘন্য কাজ করে হাত ধুয়ে ফেলা যেত, আজকের পৃথিবীতে তা কেবল উত্তর কোরিয়ার মতো জায়গাতেই সম্ভব।
শাসকের মর্জিমাফিক লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যার ঘটনা কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রে বহুবার ঘটেছে। কখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে হয়েছে নিষ্ঠুরতম কাজ। ১৯৩২-৩৩ সালে ইউক্রেনে হলোডোমোর অভিযান করেছিলেন কমরেড স্তালিন। অভিযোগ, এই পরিকল্পিত খাদ্যাভাবে ইউক্রেনের ৩৫ লক্ষের কিছু বেশি মূল বাসিন্দা মারা যান। এই মূল অধিবাসীরাই স্তালিনের শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন।
‘দ্য রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’ নিয়ে কয়েক বছর আগে সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যম তোলপাড় হয়েছিল। তথ্যচিত্র, ফিচার ফিল্ম, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন সবকিছুতে উঠে এসেছিল এটি। ১৯৪০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় সামরিক নিয়ন্ত্রণে এক ভয়ানক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। পাঁচজন রাজনৈতিক বন্দিকে টানা ১৫ দিন গ্যাস চেম্বারে ঘুমোতে না দিয়ে নিরীক্ষণের কাজ করেছিলেন কিছু ডাক্তার ও বিজ্ঞানী। সোভিয়েত সামরিক নির্দেশে ১৫ দিনের পরেও এই পরীক্ষা চালাতে না চাওয়ার জন্য একজন ডাক্তার আত্মহত্যা করেন।


মানবসভ্যতার ইতিহাসের আরেক ক্ষতচিহ্ন হল কম্বোডিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন। মূলত কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না (সিপিসি) দলের সক্রিয় সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল ‘খমের রুশ।’ কম্বোডিয়ার অধিবাসীরা স্থানীয় ভাষায় কমিউনিস্ট পার্টি অফ কাম্পুচিয়াকে খমের রুশ বলত।
সেই জমানায় কম্বোডিয়াতে এমন পরিকল্পিত নরহত্যা ছিল রোজকার ঘটনা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে এই কমিউনিস্ট শাসকরা আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়েছিলেন। যাদের বিনা বিচারে মারা হচ্ছে, তাদের সন্তানরা বড় হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে—এই আশঙ্কায় শিশুদের গাছে আছড়ে মারা হতো! সৈন্যরা হাসিমুখে বাচ্চাগুলিকে আছড়ে মারছে কি না তা দেখার জন্য লোক ছিল। আজও এই বধ্যভূমিতে ‘চ্যানকিরি ট্রি’ (Chankiri Tree) পর্যটকদের দেখানো হয়।
ভারতেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সিনহুয়ার তথ্য যদি সঠিক হয় তবে রোগটি অতি ভয়ানক কিছু নয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও আধুনিক চিকিৎসায় এ রোগের নিরাময় সম্ভব। তাই অর্ধসত্য বা মনগড়া গুজব না ছড়িয়ে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আগত সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।


ভারতের মতো দেশে সুবিধা অনেক। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। সংবাদমাধ্যমের গতি অবাধ ও
স্বাধীন। তাই কোন রাজ্যে ঠিক কতজন আক্রান্ত মানুষ আছেন, তাঁদের চিকিৎসার ফলাফল কী, কোনও কিছুই গোপন নয়।
মানুষের কল্যাণের জন্য ভারতের ভাবনাটাও মৌলিকভাবে পৃথক। এদেশের তপোবনে উচ্চারিত হয়েছিল—‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ/ সর্বে সন্তু নিরাময়া। সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু/ মা কশ্চিৎ দুঃখ ভাগভবেৎ।।’ সকলে সুখে থাকুক, সবাই সুস্থ থাকুক, সবার উন্নতি হোক, কাউকেই যেন দুঃখ ভোগ করতে না হয়।
ভারতের পরম্পরায় এই সকলে মানে পৃথিবীর সমগ্র মানবসমাজ। সকল ভারতবাসী, সকল চীনবাসী, ইউরোপবাসী, আমেরিকাবাসী, আরব দেশবাসী, ইজরায়েলবাসী—সক্কলে—পৃথিবীর সব ধর্মমতের, সব পন্থ সম্প্রদায়ের মানুষ। ধনী, দরিদ্র, শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ সবাই এই ভাবনাতে কেউ ‘শ্রেণীশত্রু’ নেই, কোনও ‘নেটিভ’ নেই, কোনও ‘অবিশ্বাসী’ নেই, কোনও ‘পাপী’ নেই। সমগ্র বিশ্ববাসী সুখে থাকুক, নীরোগ থাকুক। এই এক লক্ষ্যে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম তাদের কাজ করবে, বিকশিত হবে। কবিগুরুর ভাষায় বললে, ‘সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.