রাজনীতির বিভ্রান্তি ও সঙ্ঘ

রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয় জনতা পার্টি দেশের এক নম্বর দল হিসেবে নিজের জায়গা করে নেবার পর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের গুরুত্ব খুব বেড়ে গেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ঘটনা একেবারে উলটো— অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ফলেই রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপির রমরমা এত বেড়েছে। আমার মনে হয় একথা বলাও বোধহয় সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয়। কারণ তাহলে এমন মনে হতে পারে যে ভারতীয় জনতা পার্টি বুঝি আরএসএসেরই রাজনৈতিক ফ্রন্ট। আদতে তা কিন্তু নয়। ভারতীয় জনতা পার্টি একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। রাজনীতির ক্ষেত্রই হলো তার কাজ করার জায়গা। সেখানে সমগ্র ভারতবর্ষে সকলের মধ্যে তার গতিবিধি। একটি পৃথক সংস্থা হিসেবে তার নিজস্ব কর্মসূচির ভিত্তিতে এই দল বেড়ে উঠেছে।
একথা যেমন সত্য তেমনি একথাও সত্য, যে হিন্দুত্বের আদর্শের কথা আরএসএস বলে থাকে সেই একই আদর্শের কথা বিজেপিও বলে থাকে। অপর দিকে আরএসএস কোনো রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের একটা রাজনৈতিক ভূমিকা আছে। এই ভূমিকার অভিব্যক্তি তারা কী প্রকারে ঘটাবে? এমনিতে সঙ্ঘের তরফে একথা স্পষ্ট ভাবে বলা আছে যে, সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের রাজনৈতিক ভূমিকা কী হবে বা না হবে সেটা স্থির করার মালিক তারা নিজেরাই। অর্থাৎ নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণের ব্যাপারে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা স্বাধীন।
তাছাড়া সঙ্ঘ যেহেতু সামগ্রিকভাবে দেশের চিন্তা করে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে থাকে, সেই হেতু তাদের কর্মক্ষেত্রের আওতা থেকে কোনো রাজনৈতিক দলই বাদ নয়। ষাটের দশকের কথা। হাওড়ার কল্যাণগড়ে গ্রীষ্মকালীন সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে তৎকালীন সরসঙ্চালক শ্রীগুরুজীকে যুগান্তর পত্রিকার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনারা তো জনসঙ্ঘকে (তখন বিজেপির জন্ম হয়নি। জনসঙ্ঘ নামেই পরিচিত ছিল ওই দল) নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই নয় কী?” শ্রীগুরুজী চটজলদি জবাব দেন, “শুধু জনসঙ্ঘ কেন? আমরা তো কংগ্রেস সমেত সব দলকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।” এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, সঙ্ঘের আদর্শ বা তদর্থে এদেশের নিজস্ব হিন্দুত্বের আদর্শ দ্বারা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে। আরএসএসও সেই অর্থে একটি ক্ষুদ্র দলী। গণ্ডিতে সীমিত না থেকে সমগ্র দেশের সব রকম গতি বৃদ্ধির মূলে কনসেন্স কিপার’বা দেশের বিবেককে উজ্জীবিত রাখার কাজ করে যাবে নিরলসভাবে।
তাই যদি হয় তাহলে আরএসএস-কে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হলো কোন যুক্তিতে? বিরোধী দলগুলি অর্থাৎ যারা এদেশের হিন্দুত্ববাদী চরিত্রের বিরোধী তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা দুরভিসন্ধি কাজ করে থাকে। এই দুরভিসন্ধির কারণটা যে কী তা বুঝতে খুব একটা ভুল হবার কথা নয়। কিন্তু একশ্রেণীর স্বয়ংসেবকও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে রাজনীতি ক্ষেত্রে বিজেপি হলো একমাত্র দল যাদের বাড়বাড়ন্ত শুধু স্বয়ংসেবদেরই জন্য। যেন অন্য দলগুলিকে হিন্দুত্বের আদর্শে আনার কোনো দায়ই আমাদের নেই। মনে রাখতে হবে যে, দেশের মানসিকতা পরিবর্তন শুধুমাত্র রাজনীতির মাধ্যমে আনা সম্ভব নয়। তার জন্য চাই দেশের মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ সৃষ্টিকরা এবং দেশমাতৃকার প্রতি তাদের সন্তানবৎ আচরণের যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা। আরএসএস হিন্দুত্বের আদর্শের ভিত্তিতে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়।
তবু স্বয়ংসেবকদের মনে বিজেপি সম্পর্কে যে ভ্রান্তি বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে আছে একটি অন্য কারণ। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের স্বাগত জানানো তো দূরের কথা, তাদের দুরছাই করে তাড়াতে পারলেই যেন তারা বেঁচে যায়। একমাত্র রাজনৈতিক দল জনসঙ্ঘ বর্তমানে বিজেপিই তাদের তাড়ালো না-ই, বরং তাদের গ্রহণ করল এবং তাদের কথা শুনলোও। হিন্দুত্বের আদর্শ-সহ অন্যান্য বহু ব্যাপারে তারা ভারতের মৌলিক ভূমিকার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল নির্দ্বিধায়। এই সূত্রে দেখা দিল দুটি বিভ্রান্তি। বিজেপির কতিপয় কর্মী মনে করতে লাগলেন যে তারা যা করবেন আরএসএস তার প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জানাবে। অন্যদিকে এক শ্রেণীর স্বয়ংসেবক মনে করতে লাগলেন যে তাদের শক্তিতেই বিজেপি আজ এত শক্তিশালী। অতএব আমরা যা বলব বিজেপি তা করতে বাধ্য। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো উপরোক্ত দুই ধরনের মানসিকতাই একান্তভাবে ভ্রান্ত। অন্যদিকে হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে যে শক্তিগুলি কাজ করছে তারা এই উভয় মানসিকতার গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে, উস্কে দিয়ে, প্ররোচিত করে দুটি সংগঠনকে সম্মুখ সমরে নামিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দেশের স্বার্থেই আজ বিশেষ প্রয়োজন। স্বয়ংসেবক অথবা বিজেপির সদস্য উভয়কেই বুঝতে হবে যে হিন্দুত্ব বিরোধীরা এই সূত্রে এক খুড়োর কল পেতেছে যাতে পা পড়লে এগোতে বা পিছোতে গেলে দুদিকেই এই ফাদ কাজ করে। তাই বলে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাজনীতির এক্তিয়ার একটা সীমানা পর্যন্ত বাঁধা। অন্যদিকে রাজনীতির বাইরে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্র সর্বব্যাপী যার ভেতর রাজনীতিও আসে। এবার স্বয়ংসেবক পরিচালিত ধর্মীয় সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যদি রাম মন্দির নির্মাণের কথা বলেন, তাতে অন্যায় কোথায় ? হিন্দুদের দেশ হিন্দুস্থানে রামমন্দির না হলে কোথায় হবে? সুতরাং শাসন ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন দেশের মানুষের মনোভাবকে সমীহ করে চলাই হলো শাসকদলের কাজ। স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ সম্পর্কেও ওই এক কথা। আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের স্বার্থরক্ষায় তারা কর্মরত। অর্থনীতির উদারীকরণের অর্থ যদি ভারতকে পাশ্চাত্যের উদরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে তাকে নিশ্চয়ই স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ সমর্থন করতে পারে না।
এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে বা বলা উচিত প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ প্রভৃতি সংগঠনের যারা কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত সরকারের কতিপয় নীতির সামালোচনা করছেন তারাও স্বয়ংসেবক। সেক্ষেত্রে এটাকে কী পরস্পর বিরোধিতা বলা উচিত হবে না? না, তার কারণ প্রথম কথা কেন্দ্রের সরকার শুধুমাত্র বিজেপি সরকার নয়, সেখানে অন্যান্য দলও আছে। তাদের একটা কর্মসূচিও আছে। সেই অনুযায়ী কাজ করতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দ্বিতীয় কথা হলো, মেকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমল না দিলেও প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে সমীহ করতেই হয়। তবু সরকার যদি ভুল করে তাহলে সে ভুল শুধরে দেবে কে? জনগণ। কারণ গণতন্ত্রে সরকার বড়ো নয়, বড়ো হলো জনগণ। যে কোনো বিষয়ে শেষ কথা বলে তারাই। এতে পরস্পর বিরোধিতার কোনো ব্যাপার নেই।
একথা অনস্বীকার্য যে, রাজনৈতিক দলকে ভোটের কথা ভাবতেই হয় এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরএসএস তো আর রাজনৈতিক দল নয়, তাই তার চিন্তা রাজনৈতিক দল থেকে পৃথক হতে বাধ্য। প্রকৃত মানুষ গড়ার কাজে তাদের একমাত্র আরাধ্যা দেবী দেশজননী। এবং আরও স্পষ্ট করে আরএসএস থেকে বলা হয়েছে যে, যারা ভারতমাতাকে মা বলে মনেপ্রাণে স্বীকার করবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত থাকবে—তারা সকলেই হিন্দু। সে তার ধর্ম বা উপাসনা পদ্ধতি যাই হোক না কেন ভারতের মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি প্রভৃতি সকলেই হিন্দু। হিন্দুস্থানে যাদের বাস তারা সকলেই হিন্দু। এটা শুধু বিশ্বাস নয়, ঘটনা। মক্কায় হজ করতে যেসব মুসলমান ভারত থেকে যান তাদের নাম পঞ্জীকৃত হয় হিন্দু হিসেবে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি ছিল খুব পরিষ্কার। তাই তিনি লিখেছেন এদেশে আমরা সকলেই হিন্দু, আমি হিন্দু-ব্রাহ্মণ, আমি হিন্দু-খ্রিস্টান অথবা আমি হিন্দু-মুসলমান প্রভৃতি। শ্রীগুরুজী কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে সত্তরের দশকের গোড়ায় প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ওরা যদি ভারতমাকে মা বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো তাহলে তারা মায়ের অঙ্গচ্ছেদ করে পাকিস্তান সৃষ্টি করত না, ভারতবর্ষের মধ্যেই মুসলমান প্রধান একটি প্রদেশ চাইতে পারত। যেমন বিহারি প্রধান বিহার, ওড়িয়া প্রধান ওড়িশা ইত্যাদি। তেমনি মুসলমান প্রধান একটি প্রদেশ হতেই পারত।
মোদ্দা কথা হলো, দেশের প্রতি আনুগত্য। সেখানে ফাটল থাকলে দেশ বাঁচতে পারে না। আর দেশ না বাঁচলে কীসের রাজনীতি আর কীসের অর্থনীতি। আরএসএস-এর বর্তমান সরসঙ্চালক শ্রীসুদর্শন তাই দেশের মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে বার বার মিলিত হয়ে কাথাবার্তা বলছেন যাতে এই দেশের জলবায়ুতে বড়ো হয়ে অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য রাখার মতো বিশ্বাসঘাতকতা তারা না করে। আরএসএস-এর এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই দেখা যাবে কোথাও কোনো বিভ্রান্তি নেই, তা সে অপপ্রচারকারীরা মিথ্যার ঢক্কা যতই নিনাদ করুন না কেন।
অসীম কুমার মিত্র
(২০০৩ সালের জাগরণ পত্রিকায় প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.