ইংরেজিতে একটি শব্দ রয়েছে Population Blast অর্থাৎ জনবিস্ফোরণ। আজকের দিনে বিশাল বিশাল পারমাণবিক বোমার থেকেও ভয়ংকর এই জনবিস্ফোরণ, এককালে চীন এই মহামারিতে জর্জরিত হলেও এক সন্তান নীতি’তে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে। গত বছরের জুন মাসে ‘The World Population Prospects 2019 : Highlights’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি থেকে বেড়ে ৯৭০ কোটিতে পৌঁছে যাবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই রিপোর্টের সবচেয়ে ভয়ংকর দাবি, জনসংখ্যায় আগামী ৮ বছরের মধ্যে চীনকে টপকে ভারতের স্থান শীর্ষে হবে। বিশ্বের জনসংখ্যা বিস্ফোরণে আগামী দিনে। ভারত ছাড়াও আরও ৮টি দেশ তালিকাভুক্ত রয়েছে– পাকিস্তান, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইজিপ্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯০ সালে মহিলা পিছু গড় সন্তানের জন্মহার ছিল ৩.২।২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ২.৫ এবং ২০৫০ সালে কমে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ২.১-এ। সমীক্ষানুসারে এশিয়া, ইউরোপের জনসংখ্যা কমার সম্ভাবনা প্রবল থাকলেও আফ্রিকান দেশগুলির কঙ্গোতে ৩০.৪ শতাংশ, ইথিওপিয়াতে ১৫৬ শতাংশ, তানজানিয়াতে ৩৭৮ শতাংশ এবং মিশরে ১২০ শতাংশ জনসংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা। তবে সুখকর তথ্যে এই যে, ২১০০ সালের মধ্যে ব্রাজিলে ১৫ শতাংশ, বাংলাদেশে ৮ শতাংশ, রাশিয়ায় ১৪ শতাংশ এবং চীনে প্রায় ৩৭ কোটি জনসংখ্যা কমার সম্ভাবনা আছে।
স্বাধীনতার পর থেকে সংসদে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫টি প্রাইভেট মেম্বার বিল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে উত্থাপিত হয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই কংগ্রেস সদস্যদের। বিজেপির ৮ সদস্য, টিডিপির ৫, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি, সপাদের একজন করে সদস্য, বাকি কিছু ক্ষেত্রীয় সাংসদ সদস্য উত্থাপিত করেছিলেন। সর্বশেষ বিলটি ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জীব বালিয়ান উত্থাপিত করেছিলেন। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। তারপর ১৯৭৫-৭৭ সালে কংগ্রেসের সঞ্জয় গান্ধী জবরদস্তি বন্ধ্যাকরণে জোর দিলে ভোটব্যাঙ্কে যথেষ্ট প্রভাব পড়ে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প হিমঘরেই চলে যায়। কিন্তু তৎকালীন সরকারগুলো বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলে আজকে জনসংখ্যার বাড়তি বোঝা দেশকে বইতে হতো না। বিগত সরকারগুলো যদি আইন প্রয়োগ করে ন্যূনতম দুই সন্তানের অধিক পরিবারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভোটদানে বিরত রাখতো, সরকারি চাকরিতে অগ্রহণযোগ্যতা, অধিক করদানের ব্যবস্থা লাগু করতো তাহলে নিশ্চিত জনসাধারণ স্বেচ্ছায় পরিবার পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতো। গত আদমশুমারির (২০১১) জনসংখ্যার ৪.৪ গুণ বেশি। তুলনামূলকভাবে চীনে ১৯৫০ সালের জনসংখ্যা ৫৫ কোটি ছিল কিন্তু সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিতে ৭০ বছর পর চীনের জনসংখ্যা মাত্র ১৪২ কোটিতে পৌঁছেছে। যেটা ১৯৫০-এর তুলনায় মাত্র ২.৫৮ গুণ বেশি। উল্লেখ্য যে, চীনের মোট জমি ভারত থেকে ২.৯১ বেশি এবং ভারত পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ ভূমি গ্রহণ করে পৃথিবীর ১৯ শতাংশ জনসংখ্যার বোঝা বহে চলছে। ভারতবর্ষ যদি ন্যূনতম ১৫ বছরের জন্য পরিবার পরিকল্পনা আইন বাধ্যতামূলক করে তাহলে প্রাথমিকভাবে কিছুটা জনসংখ্যার চাপ থেকে স্বস্তির অনুমান করা যায়।
সম্প্রতি প্রবীণ আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়ের এক আবেদনে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র সরকারকে ভৎর্সনা করে জবাব চায় যে সংবিধানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কানুন লাগু করার নীতি থাকলেও জনসংখ্যা বিস্ফোরণে সরকার কেন উপযুক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট নয় ? ২০১১ সালের শেষ আদমশুমারির হিসাবানুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যা ১২১ কোটির সামান্য উপরে ছিল, কিন্তু ২০২১-এর আদমশুমারির আগেই বর্তমানে ভারতে ১২৫ কোটি মানুষের আধার কার্ড বানিয়ে নিয়েছে। প্রায় ২৫ কোটি মানুষ এখনো আধার বানায়নি এবং কয়েক কোটি অবৈধ নাগরিক ভারতে বসবাস করছে। অর্থাৎ বর্তমানে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটির সংখ্যায় পৌঁছে চীনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষিযোগ্য জমি মাত্র ২ শতাংশ এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল মাত্র ৪ শতাংশ পরিমাণ আছে। উল্লেখ্য, তকালীন অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে ১১ সদস্যের এক সংবিধান সমীক্ষা আয়োগ দুই বছরের কঠোর পরিশ্রমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে সংবিধানে ৪৭ (এ) অনুচ্ছেদ যুক্ত করতে এবং তৎক্ষণাৎ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন বলবৎ করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রস্তাব জানিয়েছিল। কিন্তু দিল্লিতে এরপর অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলেও, সংসদে অনেক ধারা যুক্ত এবং বিলুপ্ত হলেও আর কোনো কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে পূর্ণরূপে সক্রিয় হতে পারেনি। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং হরিয়ানা সরকার পঞ্চায়েত প্রার্থীর সর্বোচ্চ দুই সন্তান সম্পৰ্কীয় আইন প্রণয়ন করলেও পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা সরকার আবার আইন সংশোধন করে তাদের রাজ্যে আইনটি বাতিল করে। হরিয়ানা বিধানসভা পঞ্চায়েত প্রার্থীর দু’সন্তান সম্পর্কীয় সিদ্ধান্ত ২০০৫ সালে উঠিয়ে দেয়। The Rajasthan Various Services (Amendment) Rules 2001-এর মাধ্যমে রাজস্থান সরকার আইন প্রণয়ন করে যে ০১.০৬.২০০২ তারিখের পরে তৃতীয় সন্তান জন্ম নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সকল সরকারি চাকরি এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচনা করা The Amendment Rules 2001এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে রাজস্থান উচ্চ ন্যায়ালয়ে DBCWP No. 18662/2012 অভিযোগ দাখিল করলে মহামান্য আদালত সরাসরি নাকচ করে দেয়। The Madhya Pradesh Civil Services (General Condition of Services) Rules-41 সংশোধনীর মাধ্যমে মধ্যপ্রদেশ সরকার আইন প্রণয়ন করে যে ২৬.০১.২০০১ তারিখের পরে তৃতীয় কোনো সন্তান জন্ম নিলে সকল প্রকার সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। The Maharashtra Civil Services (Declaration Of Small Family)_Rules 2005 অনুসারে দু’সন্তানের অধিক সন্তান জন্ম দিলে সরকারি চাকরি-সহ অন্যান্য সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। মহামান্য উত্তরাখণ্ড উচ্চ ন্যায়ালয় ১৭.০৯.২০১৯ তারিখে SAL No. 736/2019-এ রায়দান করে যে দু’সন্তানের অধিক সন্তান জন্ম দিলে সরকারি চাকরিতে প্রসবকালীন ছুটি মঞ্জুর হবে না। গত ২৫ জুন ২০১৯-এ উত্তরাখণ্ড পঞ্চায়েতি রাজ (সংশোধনি) বিল ২০১৯ রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীদের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত আইন সংশোধনী করে দু’সন্তানের নীতি কার্যকারী করা হয়। অসমের পঞ্চায়েত আইনের সূত্র ধরে Section 111(2) Assam Panchayat Act 1994 অনুসারে কাছাড় জেলার বড়োখলা বিধানসভা কেন্দ্রের ভাঙ্গারপার জিপিতে কংগ্রেসের আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সদস্য নার্গিসকে তিন সন্তানের জন্ম দেওয়ায় পদ থেকে অপসারিত করা হয়। উল্লেখ্য, অসমে পৌরসভা প্রার্থীদেরও দু’সন্তান নীতি কার্যকারী হয়েছে।
১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থার সময়ে সঞ্জয় গান্ধী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক বন্ধ্যাত্বকরণ অভিযান চালান, যেখানে সরকারি পুলিশ, কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক এর আওতায় আনা হয়। গ্রাম-শহরে অনেক জবরদস্তি বন্ধ্যাত্বকরণ করার ফলে প্রায় ৬২ লাখ লোকের বন্ধ্যাত্বকরণ হয়ে যায় যার মিশ্র প্রভাবে পরবর্তী ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হার হয়। তারপর পরিবার নিয়োজন’ প্রকল্পের নাম বদলে হয় পরিবার পরিকল্পনা। কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই জ্বলন্ত এই ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করার আর সাহস পায়নি। সম্প্রতি ৭৩ তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশবাসীর কাছে ছোটো পরিবারের আহ্বান জানান এবং সেটাকে দেশভক্তির অন্যরূপ হিসেবেও বর্ণিত করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণে এতটাই চিন্তিত যে দেশের শিক্ষিত সমাজকে পরিবারে জন্ম নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার আকুল আবেদন জানান এবং ছোটো পরিবারের সুফলতা তুলে ধরেন। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে একটি বিশেষ সম্প্রদায় ধর্মান্ধতায় বিভোর তারা জেনে বা না জেনে জন্মহার বৃদ্ধি করে চলেছে। তাই ভোট ব্যবসায়ীরাও তাদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, সংখ্যালঘু নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েসির মতো উচ্চশিক্ষিত লোক দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে সমর্থন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সৎ আহ্বানকেও সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাহলে আমরা কীভাবে ওই ধর্মান্ধ অশিক্ষিত সমাজ থেকে কিছু আশা করতে পারি! উল্লেখ্য যে, ২০০১-২০১১ সাল পর্যন্ত মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৪.৬ শতাংশ ছিল যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ কিন্তু সেটা ২০০১ সাল পর্যন্ত ১৩.৪ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে হিন্দুদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ যা গত দশকের তুলনায় ৩.২ শতাংশ কম। ভারতবর্ষের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অসফল সেখানে প্রতিবেশী ইসলামিক দেশ পাকিস্তান ২০২৫ পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশের নীচে রাখার টার্গেট রেখেছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতি প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন সেই সংখ্যা এখন ৬৩.১ শতাংশে অর্থাৎ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন মাত্র ২ শতাংশের একটু উপরে। উল্লেখ্য যে, সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি শিক্ষা বিভাগ, এমনকী মাদ্রাসায়ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে জোর সচেতনতা অভিযান চালানো হয়ে থাকে এবং সেটা বিনা বিতর্কে। কিন্তু আমাদের এমন দুর্ভাগ্য যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যকটি সুপরিকল্পনাকে ধর্মের গোড়ামির বিতর্কের চাদরে ঢেকে দেওয়ার এক অপ্রত্যাশিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সেটা সিএএ হোক, এনআরসি, এনপিআর কিংবা পরিবার পরিকল্পনাই হোক না কেন। তবে দেশের বিরোধী দলগুলি যখন বিশেষ এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি দুর্বল তখন দেশের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রীকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তো সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতেই হবে।
রঞ্জন কুমার দে
2020-03-13