এই আইন নিয়ে বিতর্ক অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও রূপ নিল।তবু আমি এই বিরোধিতার মধ্যে ছিটেফোটা সারবত্তাও খুঁজে পেলাম না। ১৯৪৬-এর ফরেনার্স অ্যাক্ট ও ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যম অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো চালু আছে। দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও তার পেছনে যুক্তি রয়েছে। ১৯৪৬ ও ১৯৫৫ এই দুই আইনের বলেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হয়। এখন ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯’ যদি প্রত্যাহার করা হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশি ও অন্য জায়গা থেকে আসা অবৈধ মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের কিন্তু ফেরত যেতে হবে। যেমন যেতে হবে শিখ, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান অনুপ্রবেশকারীদেরও।
বিশ্বের আইনের শাসন লাগু থাকা সমস্তদেশেই নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে মোটামুটি একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। দেশের নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা জন্ম, উত্তরাধিকার সূত্র, সরকারি আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় বসবাস বা দেশটি যদি অন্য কোনো দেশ দ্বারা অধিকৃত হয়ে যায় এই প্রয়োজনীয় শর্তগুলির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এটা খুবই সহজ কথা যে যারা নির্দিষ্ট দেশের অনুমতি ছাড়াই সেদেশে প্রবেশ করে তাদেরই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হয় ও পত্রপাঠ ফেরত পাঠানোই নিয়ম।
বাংলাদেশ যুদ্ধজনিত কারণে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অসমে যেভাবে দেশের বসবাসকারীদের সংখ্যায় ও পরিচয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অসম চুক্তি সম্পাদনা জরুরি হয়ে পড়ে। এই চুক্তির মধ্যেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার নিয়মাবলী ও বিশেষ আইন তৈরি করা হয়। তবুও যথার্থ বিদেশি চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ন প্রায় অসম্ভব কাজে পরিণত হয়। দেশের আদালতে এই আইনটি ‘অসম চুক্তি’র মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত আবেদনকারীদের যুক্তি মেনে সনোওয়াল সরকারকে বিদেশি চিহ্নিতকরণে ও প্রত্যার্পণে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী করে। মনে রাখতে হবে এইমামলাটিকে কেন্দ্র করেই ডিটেনশন ক্যাম্প’তৈরির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ সালে প্রথম সংসদে পেশ হওয়ার পরই উভয় সভার যুগ্ম সংসদীয় কমিটির কাছে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি সংসদীয় কমিটি তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। ২০০৩ সালে এ সংক্রান্ত নিয়মাবলীতে উল্লেখ করা হয়েছিল একটি জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরির ক্ষেত্রে দেশের বসবাসকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হবে। কোনো ব্যক্তির দেওয়া তথ্যাবলীর মধ্যে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তাকে আলাদা করতে হবে। পরবর্তীকালে আরও নিরীক্ষণ সাপেক্ষে নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এই নিয়মাবলী কিন্তু বিগত ১৬ বছর ধরে গৃহীত হওয়া অবস্থাতেই পড়ে আছে। এর কোনো প্রয়োগ হয়নি। আমার মাথায় কিছুতেই এই ব্যাপারটা ঢোকে না যে যদি একটি আইন কোনো নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত এক শ্রেণীর মানুষকে নাগরিক হওয়ার অধিকার দেয় যে অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা একটি যুক্তিগ্রাহ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই অর্জন করতে হচ্ছে সেই আইনকে কেন এমন ধিক্কার জানানো হচ্ছে বা হবে? বলা হচ্ছে এটি বৈষম্যমূলক কেননা এটি আরও একটি বিশেষ শ্রেণীকে কেন আইনের আওতাভুক্ত করে তাদেরও এই অধিকার দিল না? তারা নাকি সুবিধে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সমান অধিকারের নীতি একথা কখনই বলে না যে দেশে লাগু করা প্রত্যেকটি আইনকেই বাধ্যতামূলকভাবে সকলের ওপরই প্রযোজ্য হতে হবে। সাম্যের নীতি অনুসরণ করার অর্থ এই নয় যে এর ফলে রাষ্ট্র তার সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনী শ্রেণীবিভাগ করতে পারবে না। আরও পরিষ্কার করে বললে এটাই দাঁড়ায় যে যদি কোনো আইন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর সকলের প্রতি সমানভাবে প্রযোজ্য হয় তাহলে অন্য একটি শ্রেণীর ওপরও তা কেন তাদের ইচ্ছে মতো একইভাবে প্রযোজ্য হবে যদি তাদের ক্ষেত্রে আলোচ্য আইনের আদৌ কোনো প্রাসঙ্গিকতা নাও থেকে থাকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু বারবার বলেছে এ বিষয়ে তাদের এই ধরনের বিষয়ে নাক গলানোর কোনো প্রয়োজন নেই। দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক এমন সমাধানে পৌঁছনোর অনেক বিকল্প রাস্তাই খোলা আছে। এ বিষয়ে দেশের নির্বাচিত সরকারের হাতেই কোন পদ্ধতিটি সঠিক সমাধান পাওয়ার উপযুক্ত তা নির্বাচনের দায়িত্ব থাকা উচিত এমনটাই সর্বোচ্চ আদালতের অভিমত। এখন সকলেই জানেন সিএএ-র মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত সেখানকার সংখ্যালঘু মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদান করা, সত্যি কি আমাদের প্রামাণ্য দলিলের প্রয়োজন আছে এটা বুঝতে যে এই ইসলামি ধর্মীয় দেশগুলির সংখ্যালঘুদের ওপর কী ধরনের নির্যাতন হয়ে থাকে? দেশের নির্বাচিত সংসদ যদি একথাটা মনে রেখে এই অবিচারের একটা সুরাহা করতে এই সংখ্যালঘুদের পাকাপাকি সুরক্ষা দিতে চায় তাহলে তারা কি খুব অন্যায় করবে?
হ্যা, বলা দরকার ধর্মের ভিত্তিতে শ্রেণী বিভাগ করা মানেই তা জন্মসূত্রে অসাংবিধানিক এটা ঠিক কথা নয়। মনে রাখা দরকার, আমাদের সংবিধান দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বিশেষ অধিকার প্রদান করে রেখেছে। সংশ্লিষ্ট আইনটির পরিধি বাড়িয়ে যদি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে বিনা বাধায় ভারতে আসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে এই সমস্ত দেশগুলির সঙ্গে আমাদের সীমান্তরেখাও তুলে দেওয়া উচিত।
কোনো কোনো মহল থেকে এখনও মন্ত্রণা দেওয়া হচ্ছে যে, আইনের বৈষম্য দূর করতে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো জনগোষ্ঠীই যদি ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয় তাদের সকলের ক্ষেত্রেই এই আইন লাগু করে নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত। আশার কথা, দেশের সাহসী আইনজ্ঞরা কিন্তু এখনও পর্যন্ত উল্লেখিত দাবির পেছনে দাঁড়াননি। তার একটা কারণ সম্ভবত যে তারা টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক নন বা নাগরিক সম্প্রদায়ের উচ্চকোটির বুদ্ধিজীবী নন যারা রাস্তায় নেমে এ ধরনের আওয়াজ তুলছেন। সবচেয়ে উচ্চকিত সমালোচনা হচ্ছে এমনটা ধরে নিয়ে বা ইচ্ছে করে ভুল বোঝানোর জন্য যে এই সরকার দেশ থেকে মুসলমানদের উৎখাত করতে চায়। দেশে এমন কোনো আইন, নীতি, ঘোষণা বা বিজ্ঞপ্তির অস্তিত্ব মাত্র নেই যাতে এই ধরনের কোনো অভিপ্রায় রয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই ধরনের প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে একথা নিশ্চিতভাবে সত্যি যে দেশের অভ্যন্তরে যদি শুধুমাত্র মুসলমানদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে এমন কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় যা অন্যান্য দেশবাসীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে। না সেক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত হতে বাধ্য।
দেশের যে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বাংলাদেশ যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু আগমনের ফলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর চরিত্রগত আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে তার অবস্থান সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সেই বিষম পরিস্থিতিসংশোধন করতে যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেই ব্যবস্থাই সারা ভারতে প্রয়োগ করার মানদণ্ড করা হবে এমনটা ধরে নেওয়া আইনের জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতা বই কিছু না। জাতি ধর্মের মধ্যে মেরুকরণের বিষয়টি আদৌ নতুন নয়। আধুনিক ভারতের সংজ্ঞা নির্ণয়ের সময় থেকেই তা চালু ছিল। এই সূত্রে আর একটি ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ কিন্তু আমার নজরে পড়ছে তা হলো এতদিন যে শ্রেণী ক্ষমতার উৎস থেকে বয়ে আসা সুবিধেগুলি যুগ যুগ ধরে একচেটিয়া ভাবে ভোগ করে এসেছেন তাদের সঙ্গে যারা তাদের বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে সেই শক্তির। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একটি সুবিধেজনক অলীক বিলাসিতা। পৃথিবীতে বিশেষ চরিত্রের কিছু আদর্শ বা মতবাদ যা তার জন্মস্থল-সহ তাবড় বিশ্বে পরিত্যক্ত হয়ে গ্রন্থাগারের নিরাপদ আস্তানায় ধুলো সংগ্রহ করছে সেগুলিকে গৌরবান্বিত করার এক প্রচেষ্টা। আমাদের দেশের নাগরিক সমাজের ওপর যারা বৌদ্ধিক আধিপত্য জারি রাখতে মরিয়া তারা রাজনৈতিক ইতিহাসের এই ধূলিমলিন মতাদর্শকে তুলে ধরার রোমান্সে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভোর হয়ে আছেন। এরই ফলে অযথা বিতর্ক ও আক্রমণাত্মক প্রতিবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে। দেশের নানা জায়গায় এই অলীক কারণে প্রতিবাদী রোমান্স চালানোর স্থানে সত্যকে তুলে ধরলেই এমন একটা অনুভূতি চাউর করা হচ্ছে- কেন যে সত্যিটা এনে এমন জব্বর প্রতিবাদী চরিত্রের গপ্পোটা মাটি করলে! হায়রে!
হরিশ সালভে
(লেখক ভারতের প্রাক্তন সলিসিটার জেনারেল এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী)
2020-03-13