বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক অবনমন ও বামপন্থা

দোল উৎসব উপলক্ষ্যে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি গানকে বিকৃত করে মহিলাদের পৃষ্ঠদেশে লেখা হয়েছিল। এর গোড়াপত্তনটি অবশ্য আরও আগে। এক বিকৃতমস্তিষ্ক গায়ক রোদুর রায়। অশ্লীল শব্দ যুক্ত করে রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো বিকৃত করে বিকৃত সুরে তা। উচ্চারণ করেছিল। সেই ভিডিয়োটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর রোদ্র রায়ের পক্ষে অনেককে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল। বস্তুত এই প্রবণতা অনেক দিনের। এক সময় শক্তি, সুনীলের মতো কবিরা লিখেছিলেন ‘তিনজোড়া লাথির ঘায়েলুটাইতেছে রবীন্দ্র রচনাবলী’র মতো পঙক্তি, বাঙ্গালির নবজাগরণের পর্ব অতিবাহিত হওয়ার পর একটা বিষয় আমরা বুঝে গিয়েছি যে, মনীষীদের অবমাননা করলে আমরা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারব। এই সামাজিক অবক্ষয়কে পরবর্তীকালে নকশাল আন্দোলনের রূপে পেয়েছি। সাতের দশকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনা আমাদের স্মরণে থাকতে পারে, এতকাল এই ধরনের অসভ্যতাগুলোকে, মনীষীদের অবমাননা করাকে বিপ্লব হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম এবং এখনও সম্ভবত আছি। নইলে সাতের দশকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনাকে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকপত্রে সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হতো না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালি ভাষার অবক্ষয়ও ঘটেছে, যে ভাষা কয়েক দশক আগে পর্যন্ত গালিগালাজের অভিধানেও ঠাই পেত না, আজ প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ হচ্ছে না। ঘটনাটি নারী দিবসের প্রাক্কালে নারীর শরীরকে ব্যবহার করে ঘটানো হলো। এর উৎসটা কোথায় আমাদের বুঝতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী যে বিজাতীয় ভাবধারা আমাদের আকৃষ্ট করেছিল বা মনীষীদের অপমান করতে শিখিয়েছিল, সামাজিক উচ্ছ্বঙ্খলতাকে মদত দিয়েছিল তা এতদিন বিপ্লবের বহ্নিশিখা হিসেবে দেখা হয়েছে। সুতরাং এখন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল ফেলে লাভ নেই যে বাঙ্গালির সংস্কৃতি বিপর্যস্ত। এই বিপর্যয় সেদিনই শুরু হয়েছিল যেদিন রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলা হয়েছিল, বিবেকানন্দকে বেকার যুবক, শ্রীরামকৃষ্ণকে মৃগীরোগী, নেতাজীকে তোজোর কুকুর বলা হয়েছিল, সেদিনই বাঙ্গালির চেতনা ও সংস্কৃতির জগৎ কলুষিত হয়েছিল আর আজকে মতাদর্শগত ভাবে যারা এখনো বামপন্থী, যারা তৃণমূলের পোশাক পরে আছে, তারা জাতপাতের বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে, তারা অবাঙ্গালিদের ‘গুটখাখোর, ‘ধোকলা ইত্যাদি অপমানসূচক কথা বলে আদতে বঙ্গ সংস্কৃতিরই সর্বনাশ করছে। মুশকিল হচ্ছে যে আগে বামপন্থীরা নির্দিষ্ট একটি দলভুক্ত থাকায় তাদের চিহ্নিত করা সহজ ছিল। কিন্তু এখন মানুষ সেই দলটিকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করায় সেই ভেকধারীরা বিভিন্ন দলে আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ কোন দলের হাতে রয়েছে সেটি দেখার চেয়ে এটা বোঝা জরুরি যে এটা হলো আবহমান বাম সংস্কৃতির অঙ্গ।
গত কয়েক বছর যাবৎ ফেসবুক জুড়ে যে ‘ইতরামো’র উৎসব চলছে আমরা তার সাক্ষী আছি। দেশের প্রধান মন্ত্রী,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামে অবমাননাকর ‘মিম’, গালিগালাজ যে কখনো বাঙ্গালি রসবোধের পরিচায়ক হতে পারে না সেটা বোঝা দরকার কিংবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদীদের আহত করার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় যে পৈশাচিক উল্লাস দেখা যায় সেটা বাঙ্গালিয়ানার সঙ্গে কখনো খাপ খায় না। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাব থেকে আমরা এগুলো করছি কিনা তা আজকে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের মনের মধ্যেও যে বিদ্বেষ তাকে বাড়িয়ে নেওয়ার নানা কৌশল আছে। সেটা বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমরা দেখেছি। সুতরাং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা এই বাঁধা গতের ম্যধ্যই পড়ে। এটা ঠিক বাঙ্গালির যে সার্বিক অবনমন তাকে এতকাল বিপ্লবের খোয়াব দেখিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর্যৰ্তা তাকে অতিক্রম করে গেছে বলেই আজ বাঙ্গালি শিউরে উঠছে। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, এখনোও সময় আছে সংশোধন করে নেওয়ার বা সংশোধিত করে দেবার, সেই বিজাতীয় ভাবধারা থেকে যা বিশ্ব সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকর তার শিকড় উপড়ে ফেলা, আমাদের মূল সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার, নচেৎ আগামীদিনে আরও বড়ো ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন আমরা হতে য চলেছি তা হলপ করেই বলে দেওয়া যায়।
বিশ্বামিত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.