উত্তম রাজনীতিকদের যুগ ফিরে আসা খুব জরুরি ভদ্র মানুষ যেন মনে করেন রাজনীতিতে তারও জায়গা আছে


কংগ্রেস সরকার, বাম শাসন এবং তৃণমূল জামানা — এই ত্রিবিধ যুগ পেরিয়ে চতুর্থ শাসনের দোরগোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু যোগ্য, নীতিনিষ্ঠ, মনুষ্যত্বের গুণ-সমন্বিত রাজনীতিকদের উদয় হল কই? আজও যোগ্যকে গুরুত্ব দেবার যুগ চালু হল না; দু একটা ছিটকে-ছাটকা নেতার কথা আলাদা। উচ্চ নেতৃত্বের পক্ষে যেহেতু নিম্নতর নেতৃত্বের যোগ্যতা বিচারের রোজনামচা দেখে উপরে তুলে আনার সুযোগ কম, ভালো মানুষ হিসাবে নিচুস্তরের নেতাকে চেনার সময় নেই; তাই চারপাশে লোভীর মতো ঘুরেবেড়ানো সুযোগসন্ধানী সহচরের নিত্য-পূজার আবেগ তাকে পেয়ে বসে। দলীয় গণতান্ত্রিকতার পথ ছেড়ে, নানান ঘুর-পথ অবলম্বন করে নিজের নেওটার প্রতি আস্থা রেখে নিজের পদ বহাল রাখেন সেই উচ্চ নেতা। বাঙালি দেখে এসেছে, বড় নেতা চান তার পরের ধাপের নেতা যেন তার অন্ধ-উপাসক হন; তার সমস্ত সিদ্ধান্তে চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে সর্বদাই ‘যো হুজুর’ বলে তাকে মেনে নেন। এটা দল ভালো চলার লক্ষণ নয়, একটা দলে নানান মতামত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হলেও গণতান্ত্রিক নিয়মে সর্বজনগ্রাহ্য ও সুদূরপ্রসারী মতাদর্শ ও বিচার-ধারাতেই দল চলবে; রাষ্ট্রচেতনা ও সাধারণ মানুষের মঙ্গলেচ্ছাই দল চালনার চাবিকাঠি হওয়া উচিত, স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি নয়। যারা উচ্চ নেতৃত্বকে ভুল বুঝিয়ে মিস-গাইড করেন ও ভালো নেতাকে সরিয়ে দেবার প্রয়াস করেন, তারা আসলে চামচ-নেতা বা চামচা, এরাই আসলে গামোছ-নেতা বা গামছা। বড়-নেতা ভেসে যান এদেরই তৈলমর্দনে, সামগ্রীতে আর পরিষেবায়; অধীনস্থ নেতা বড়কে ভাঙিয়ে দলের মধ্যেই উপদল তৈরি করে বসেন, সে জগদ্দল পাথর সরানো পরবর্তীকালের নেতার পক্ষেও মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায়। বড়র আশীর্বাদ-পুষ্ট মেজো, মেজোর খেয়ালখুশিতে সেজো-নেতারা দলের নানাবিধ অসাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী হন। দল তখন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কিছু পেটোয়ার সামর্থ্যে আর গুণ্ডামিতে ভোট কিনে বাঁচা ছাড়া বড় নেতার গত্যন্তর থাকে না।

রাজনৈতিক এই পরিস্থিতি দেখেই নীচুস্তরের মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যান, তারা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন; আর নেতার বিরুদ্ধাচারণ করার ফল যা হতে পারে তার নমুনা দেখে ভয়ে চুপসে যান সাধারণ মানুষ, শিউরে ওঠেন তারা, প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলেন। যারা যথার্থই মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ যারা, সেই নেতারা যখন দলের কাজে হতাশ হয়ে যান, তখন ধরে নিতে হবে সেই দল তখন মৃত। অভিজ্ঞতা এই, মৃতদলের শক্তি জীবন্ত দলের চাইতেও বেশি। কারণ কোনো মৃতদল তারই জীবন্ত দলের চাইতে বেশি ভোট ও জনপ্রতিনিধি পায়, তারই বাঁধা-খদ্দের হয়ে ওঠে মাস-মিডিয়া। একটি কায়েমি শক্তি মৃতদলকে ভীড় করে রাখে; জনগণ রাজার মৃতদেহ দেখতে পায় না বলে, তখনও জয়ধ্বনি দিয়ে যায়! একেই বলে নেই-রাজার দল। দেখা যায়, এই মৃতদলের মূল মাথা হল কিছু সুযোগসন্ধানী শিক্ষাবিদ আর বুদ্ধিজীবী, তার লেজ হল অসংখ্য অগণিত সমাজবিরোধীদের দল। ভালো মানুষ, আম জনতা থেকে সেই দল বিচ্ছিন্ন।

কোনো দলের পক্ষে অযোগ্য নেতা তাকেই বলবো, যিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী যোগ্য নেতাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নিজের রাজনৈতিক পাপোশটির সুরক্ষায় রত হন। বাংলায় স্বার্থশূণ্য নেতা নেই বললেই চলে। রাজনীতি তারই করা উচিত যার কিছু চাবার নেই, বাংলায় রাজনীতি তারই করা উচিত জনগণ যাকে মনে এবং মেনে নেবে। যোগ্য নেতা তিনিই হবেন, যিনি যোগ্য প্রার্থী বাছতে পারবেন। চাইলেই কাউকে রাজনৈতিক উচ্চাসনে বসানো উচিত নয়। আজকাল সরাসরি চেয়ার বসিয়ে দেবার রাজনীতি চলছে; গড়ে নেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। গড্ডালিকা প্রবাহে দল তো এমনিই চলে; দলে যোগ্য রাজা না থাকলেও দল চলে যায়। তাই জনগণ যথার্থ রাজনৈতিক নেতার চাহিদা বুঝতে পারেন না। তবে ভালো রাজনীতিবিদ একটা Unfelt Need; প্রস্তুত-পোস্ট তারই অনুষঙ্গে লেখা।
ভালোমানুষ দলের সম্পদ হবেন কেন? যথার্থ ও যোগ্য মানুষ যখন নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করেও রাজনীতিতে বহুকাজের উদ্দেশ্য নিয়ে এসে নিজের দলের মধ্যেই বিরাট হোঁচট খান, বিরূপতার সম্মুখীন হন, তখন তিনি সেদিনই মরে যান, তার উৎসাহ ও উদ্দীপনা সেখানে, সেই মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়; যখন দেখেন এর প্রতিকার পাবার সুযোগ আপাতত সেই দলে নেই, নিকট ভবিষ্যতেও পাবার সম্ভাবনা নেই; তখন তিনি যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়েন। মানসিকভাবে মৃত সেই নেতার নামটি তখন ব্যবহার করে তার দল, শারীরিকভাবে তিনি দলে থাকলেও মানসিকভাবে তিনি দলে অনুপস্থিত। বিপরীত দলের সঙ্গে লড়াই করার চাইতেও নিজের দলের মধ্যে লড়াই আরও আরও কঠিন, এটা বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা। দলবিরোধী কোনো কথা প্রকাশ্যে বলে ফেললে শাস্তি তো দলীয় নিয়মে হবেই, হওয়াই উচিত; কিন্তু অনেক সময় নিজের দলীয় কর্মীদের লেলিয়ে দেবেন তারই দলের অসাধু নেতা। আর বাইরে ওঁৎ পেতে বসে আছে বিরোধী শিবিরের হিংস্র হায়নারা; ঘরে-বাইরে বিপদ। এমতাবস্থায় ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নীরব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন প্রতিশ্রুতি-সম্পন্ন নেতারা। Enough is enough বলে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে তিনি কেবল প্রাথমিক এক সদস্য থেকে যান; এক চরম হতাশা গ্রাস করে তার সকল সামর্থ্য। তার দুরবস্থা দেখে অন্য যোগ্য ও ভালোমানুষরা রাজনীতির পথ মাড়ান না। রাজনীতি বলতেই তখন মানুষ এক ঘৃণ্য, অসভ্য কাজ মনে করেন অনেকে। সে দিকটি পরিস্কার করার, সংস্কার সাধনের উদ্যোগ তেমনভাবে পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনৈতিক দল করে ওঠেনি।
মানুষ এটা খেয়াল করেছেন ক্ষমতায় যেতে পারে এমন কোনো নতুন দলে নীতিনিষ্ঠ মানুষ দলটা দাঁড় করান, প্রচার প্রসারে নীরবে আম জনতার মধ্যে শয়নে-স্বপনে কাজ করে চলেন কিছু দলীয় মানুষ। আর Political Investment মনে করে, কিছু সুবিধাবাদী লোভী মানুষ তদানীন্তন শাসকদলের সঙ্গে কৌশলগত দহরমমহরম রেখে দলে ভীড় করেন, পদ দখল করেন; ভালো ও যোগ্য মানুষ এলে তাকে সরাতে ক্রমাগত অবহেলা ও অবিচার করেন, কারণ টিকিটটা একমাত্র তারই চাই যে! কিছু নেতার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার যোগ্যতা ও ইচ্ছা বেশি, তার সার্বিক গুণাবলী নেতৃত্বের জন্য উপযোগী, তা হলেও তিনি প্যাঁচে পড়ে দল ছাড়তে বা দলে নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য হন। দলে যদি এই অনাচার দেখার কেউ না থাকেন, তবে সে দলকে আজ যতই প্রমিনেন্ট মনে হোক না কেন, সে দল পতনকে সঙ্গে নিয়েই চলছে। পশ্চিমবঙ্গে আগামী দিনে যে নতুন দলটি ক্ষমতা পাবে, বিগত দল তাদের জন্য বিপুল অঙ্কের এক ঋণের বোঝা চাপিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সেই দলের পক্ষে জনপ্রিয় হওয়া খুব কঠিন কাজ হবে। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে না পারলে, তার নিকট পরাজয় অবশ্যম্ভাবি হবে। মানুষ অত ঋণের কথা, সার্বিক অর্থনীতির কথা বোঝে না; বোঝে হাতে-গরম লাভ-লোকসান। এফিসিয়েন্ট নেতার মনোবল প্রথমেই নষ্ট করে দিলে নতুন দলের পক্ষে তা ভালো হবে না।

নতুন দলে সাধারণভাবে বোদ্ধা-নেতার একান্তই অভাব ঘটে, কে দরকারী তা জরিপ করে নেওয়ার মতো ক্ষমতা ও ইচ্ছে থাকে না। অনেকেই লোভ নিয়ে নতুন দলে আসতে চান। তারা আগামীর রঙিন স্বপ্নে মশগুল, টিকিটের জন্য সব কাজই তিনি করতে পারেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, নেতৃত্ব ও কাজের বিচার করে নয়; নতুন দলকে প্রথমে ক্ষমতায় আনেন মানুষই। নেতা ভেবে বসেন, তারই জন্য এলো এই শুভক্ষণ। “ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।” “পথ ভাবে আমি দেব/রথ ভাবে আমি/মূর্তি ভাবে আমি দেব/হাসে অন্তর্যামী।”
এটা কংগ্রেস, সিপিএম-সিপিআই, তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি সব দলের মধ্যেই আছে। আছে এবং থাকবে, কারণ আজকের রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধি হবার গ্ল্যামার মন্দ নয়, টাকাপয়সা, ঠাটবাট, ক্ষমতাও যথেষ্ট।
প্রকৃত নেতা অনেক সময় আদর পান না, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন হিংসুটে সহকর্মী, অথবা তারই নেতা। তারা বড় নেতার কানভারী করেন। বাংলার সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ এই নাটক দেখে আসছেন বেশ কয়েক দশক ধরে। সেখানে মেধার স্থান নেই, প্রায়শ মনুষ্যত্ব বোধের পরত নেই, নতুন চিন্তা-চেতনাকে রাজনৈতিক মঞ্চে স্থাপন করার আগ্রহ নেই। কেবল তাৎক্ষণিক ভোট ও ক্ষমতার দখলই সাফল্যের চাবিকাঠি। যে নেতা জনগণের ভোট চুরি করে দলকে দিতে পারবে, তার দর যদি দলে বাড়ে, তা শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। দলে কারা অ্যাসেট সব দলই নজর দিক। হত্যার রাজনীতি বন্ধ হোক, প্রতিহিংসার রাজনীতি বিলোপ ঘটুক। ভালো মানুষ যাতে অনুধাবন করতে পারেন, রাজনীতি একেবারেই পঙ্কিল নয়, শুভঙ্করী ভাবনার স্থান সেখানে আছে। বড় নেতারা বুঝুন ‘যো হজুরে’ নেতারা ব্যাগ বওয়া, আর সেলফি তোলায় দড় হলেও, তারা একেবারেই নিষ্কর্মা, তারা সকলের সঙ্গে চলতে অপারগ। রাজনৈতিক দলগুলো যেন মিডিওকারদের স্বর্গোদ্যান না হয়ে ওঠে। কাকে সংগঠনে বসাবো, কাকে জনপ্রতিনিধি করবো, তার জন্য যেন নানানভাবে খোঁজ খবর করেন, কারো লিখে দেওয়া প্যানেল পাশ করা নেতৃত্বের গুণ নয়। কোনো মাঝারি নেতার অঙ্গুলি হেলনে যদি বড় নেতা যোগ্যতর কারোর নাম কাটেন, তবে অপেক্ষা করুন, তার দ্বারাই তিনি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভাবে বধ হতে চলেছেন।

কল্যাণ গৌতম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.