রবীন্দ্রনাথের গান্ধারীর আবেদন কবিতায় অনিষ্ট অনার্য দুর্যোধনকে শাস্তি দিতে বলেছিলেন গান্ধারী স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে। বলেছিলেন, ‘শুধু অধর্মের মধুমাখা বিষফুল তুলি/আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি/ সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে; কেড়ে লও, ফেলে দাও কাঁদাও তাহারে’। আজ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লজ্জাজনক ঘটনার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই পঙ্ক্তি দুটি বারবার মনে আসছে। ঘটনার ভয়াবহতায় ইস্তফা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বাংলার সংস্কৃতি, গৌরব আর আত্মমর্যাদার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন যেসব প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ, সেই রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ বা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অসম্মান সত্যিই বাংলার পাঁজরকে নাড়িয়ে দেয়। রবীন্দ্রসংগীতের বিকৃতি করে একদল ছাত্রছাত্রী যে মহাপাপ করেছেন, তার জন্য কি কেবল কটি ছেলেমেয়েই দায়ী? নাকি আজ ভাববার সময় এসেছে যে সমাজের কোনও কোনও প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উৎসাহ পেয়ে আজ এই ভয়ানক চেহারা নিয়েছে?
একশ্রেণির ছাত্রছাত্রীর মনে ধারণা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চত্বরে যা খুশি কৰা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের মেরুদণ্ড রাজনৈতিক কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে আজকে এ রাজ্যের একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম ‘ন্যুইসেন্স ভ্যালু’কেই বেশি গুরুত্ব দেয়। অসভ্যতা করার ক্ষমতার দাম সৃজনশীলতার থেকে বেশি হয়ে গেছে আজকে ওই সব এগিয়ে থাকা সংবাদমাধ্যমে। রবীন্দ্রভারতীর ঘটনায় প্রথম দায়ী ওই শ্রেণির সংবাদমাধ্যম।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বিগত কয়েক বছরে রাজনীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেটুকু ন্যূনতম পরিবেশ থাকা প্রয়োজন তা একটু একটু করে বিলুপ্ত হচ্ছিল। ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে ছাত্র নেতারা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন। আবার ওই বিতর্কিত ছাত্র নেতাকেই পুরস্কৃত করা হল। যেন বাহুবল দিয়ে ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক দখলটাই আসল লক্ষ্য। সেটা পাড়ার মস্তানির পর্যায়ে এসে গিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারীদেরও একদল গুন্ডা এক অতিপ্রভাবশালী নেতার কথায় চরম অত্যাচার করছে। গতবছর একটি ভিন্ন কর্মচারী সংগঠন করার অপরাধে কয়েকজন বরিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। সেদিন বহু রাত্রি পর্যন্ত আটকে নির্যাতন করা হয়েছিল এই কর্মচারী সংগঠনের সদস্যদের। এমনকী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে দেওয়া হয়নি। ছাত্র ও কর্মচারী সবাইকেই ওই দু-তিন জন পরিচিত অসামাজিক ব্যক্তির গুন্ডারাজ মাথা পেতে মেনে নিতে হয়।
তপশিলি উপজাতিভুক্ত বলে এক অধ্যাপিকাকে চুড়ান্ত অপমানিত হতে হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এত অনাচারের পরেও প্রায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শিক্ষাঙ্গনটা রাজনীতি আর পেশিপ্রদর্শনের উন্মুক্ত অঙ্গন নয় সেটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাদফতরের মনে হয়নি? একটি ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে মস্তানদের আখড়া তৈরি হচ্ছে, সেটার প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করতে পারার স্বপ্ন থাকে বহু ছাত্র ছাত্রীর। যাঁরা এই বড় প্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়ার সুযোগ পান না তাদের অনেকেই দারিদ্র্যের জন্য বা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত হওয়ার অপরাধে এই ঐতিহ্যবাহী সংস্থাগুলির পাঁচিলের বাইরে থেকে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ওই বিদ্যাৰ্চনার শেষ অনুষ্ঠান। সেটা আসলে পাঠক্রমেরই অংশ। অন্যদিকে ভারতবর্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এখানে সংবিধানসম্মতভাবে সংসদের উভয়কক্ষে পাশ হয়েছে একটি বিল, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অত্যাচারিত সর্বশ্রান্ত মানুষদের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কাজ। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সঙ্গে এর কোনও দূরবর্তী যোগ নেই।
তাহলে ওই ছাত্রছাত্রীরা সমাবর্তনের দিনে এই সব নাটক করলেন কেন? প্রথম কারণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ বুঝিয়েছেন এই ধরনের অভদ্রতা করে পরিবেশ নষ্ট করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদণ্ডহীন কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেবে না। তাদের কেরিয়ারে কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সংবাদ মাধ্যমের কেউ এসে সেই নাটকের স্ক্রিপ্ট দিয়ে গেছেন। সময়মতো এসে ছবি তুলেছেন। সম্পাদকের উৎসাহে প্রথম পাতায় ছাপিয়েছেন। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের প্রচারের প্রতি মোহকে কাজে লাগিয়ে এক দল তথাকথিত শিক্ষিত পরিণত বুদ্ধির মানুষ সম্পূর্ণ বেআইনি কাজটি করিয়েছেন।
ওই উৎসাহ প্রদানকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা, সংবাদ মাধ্যমের যারা এই নাটক মঞ্চস্থ করছে, যে সম্পাদক জেনেবুঝে এই ‘ন্যুইসেন্স ভ্যালু’কে সেদিন প্রথম পাতায় ছাপিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছিলেন, এনারা সকলে সমানভাবে দায়ী।
কিছুদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাননীয় রাজ্যপালকে ঢুকতে দেওয়া হল না। শাসকদল থেকে অতিবামপন্থী সকলেই কমবয়সি ছাত্রছাত্রীদের উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির রুটি সেঁকার কাজ শুরু করেছিলেন। রাজ্যপালের উপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধান সম্মত পরম্পরাগত পদ্ধতি। হাতে গোনা কটি মানুষের কায়েমি স্বার্থের জন্য বাংলার সমগ্র সংস্কৃতি কলুষিত হল। এরাজ্যের সুশীল সমাজ একযোগে এই অসভ্যতার প্রতিবাদ করেছিলেন কি? রবীন্দ্রভারতীর ঘটনা তারই যেন চপেটাঘাত। ‘নো এনআরসি, নো সিএএ’ নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে যে নাটুকে চিত্রনাট্য তাঁরা লিখেছিলেন, রবীন্দ্র ভারতীর অসভ্যতা যেন তারই পরিসমাপ্তি। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান করার সঙ্গে সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার আবীর দিয়ে লেখা হল ‘নো এনআরসি, নো সিএএ’। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মতো একটি মানবিক প্রচেষ্টা বাধা দিয়েছে যে রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থের গোষ্ঠী, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণতির জন্য তারা অবশ্যই দায়ী।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং সংস্কৃতি জগতের আরেক ব্যক্তিত্ব অগ্নিমিত্রা পলকে হেনস্থা করা হল সেদিনও আমরা দলমত ভুলে অসভ্যতার প্রতিবাদ করিনি।
বহুদিন পরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়ায় যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। মানে প্রযুক্তি বিভাগে এবিভিপি প্রধান বিরোধী শক্তি। তারা কেমিকাল ইনজিনিয়ারিং বিভাগের একটি হলের মধ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানেই এসেছিলেন বাবুল আর অগ্নিমিত্রা। একটি গণতান্ত্রিক দেশে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিরোধী মতের কথা বলাটা অপরাধ? হলের ভেতরেও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম করতে দেওয়া হবে না? প্রচার মাধ্যমে উঠে এল একটি ছাত্র বাবুলের চুল-দাড়ি ধরে টানছে, অগ্নিমিত্রাকে অসম্মান করছে কয়েকজন। এগিয়ে থাকা সংবাদ মাধ্যম সেদিন এই বর্বরতাকেই উৎসাহ দিয়েছিল। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিজের নিজের মতের প্রচার করেছিলেন, সম্পূর্ণ নীতিহীন বর্বর আচরণের বিরোধিতা করেননি। ছাত্রছাত্রীদের বলেননি যে ছাত্রটি এমন কাজ করেছে, সে বাইরের ছাত্রই হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়েরই হোক–এতটা অসহিষ্ণুতা পাপ!
২০১৮ সালের মার্চ মাসে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ভাঙা হল, কালিমালিপ্ত করা হল ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মর্মর মূর্তি। একটি অতিবিপ্লবী ছাত্র সংগঠন এই ঘৃণ্যতম অপকর্ম করেছিল। সেদিন সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাস্তায় রাস্তায় ধিক্কার হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ড. শ্যামাপ্রসাদ না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বই থাকত না। সমগ্র বাংলা পাকিস্তানের অংশ হত। শ্যামাপ্রসাদের অপমানের দিন আমরা সমবেতভাবে এই পাপের প্রায়চিত্ত করতে পারিনি। রবীন্দ্রভারতীতে কবির অপমানে বোধ হয় এরাজ্যের পাপের বোঝা পূর্ণ হল।
আসলে ছাত্রদের নামে হলেও আসল অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক একদল কায়েমি স্বার্থান্বেষী মানুষ। এই দলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, পরিণতবুদ্ধির রাজনৈতিক নেতা, সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক, পরিকল্পিত চিত্রনাট্য লেখা তথাকথিত সাংবাদিক, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখক সকলে দায়ী। যারা সুকুমার মতি ছাত্রছাত্রীদের মনে ঢুকিয়েছেন যে সৃজনশীলতার থেকে ন্যুইসেন্স ভ্যালু মানে অসভ্যতা করার ক্ষমতা অাজকের প্রচারের যুগে বেশি দামি।
কিন্তু এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত্র হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তাই এর প্রতিকারটাও তাঁরাই করতে পারেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগের একটি গল্প খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে আজ। ১০ম পাঠে বিদ্যাসাগর মহাশয় ভুবনের গল্প বলেছিলেন। যে ভুবনকে তার মাসি প্রশ্রয় নিয়ে, শাসন না করে এক পাকা চোর তৈরি করছিলেন। ভুবনের যখন শাস্তি ঘোষণা হল, তখনি আদালতে মাসিকে দেখে ভুবন বলেছিল “নিকটে এস, কানে কানে তোমায় একটি কথা বলিব’।
মাসি কাছে গেলে ভুবন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে কামড়িয়ে দাঁত দিয়ে একটি কান কেটে নিয়েছিল। তারপর সে ভর্ৎসনা করে বলল, “মাসি, তুমিই আমার এ ফাঁসির কারণ।’ এরাজ্যে ভুবনদের সব মাসিদের জন্য এই পুরস্কারই অপেক্ষা করছে।
ড. জিষ্ণু বসু