রঙে ভুবন ভরিয়ে দেওয়ার এক সুতীব্র আকুতিতেই ইন্দ্রধনুর সাতটি রঙের বাহার প্রকৃতির বুকে। মধুমাসের সূচনায় ওই রঙের আবেশে বক্ষ তখন দুরুদুরু, এক অপার্থিব পুলক আসছে। সেই আনন্দঘন মুহূর্তেই আসে দোল। রেঙে ওঠার ও রাঙানোর উৎসব এই দোল।
দোল হলো মূলত রাধা-কৃষ্ণের লীলারঙের একটি তরঙ্গ। প্রথমিকভাবে এটি হলো একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মন্দির থেকে বের করা হয় শ্রীরাধা-কৃষ্ণকে। দোলমঞ্চে। দোলায় স্থাপন করা হয় যুগল মূর্তিকে অথবা শুধুই নারায়ণ শিলাকে। পুজোর অঙ্গ দোলায় বিগ্রহকে দোল দেওয়া। পুজো। শেষে আবিরে রাঙানো হয় বিগ্রহকে। আর তারই পরে ধর্মের আঙিনা ছেড়ে একটি বৃহৎ লৌকিক উৎসবে পরিণত হয় দোল। রঙের খেলায় মেতে ওঠে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই।
প্রাকৃতজনের সেই রঙের খেলায় বস্তুত থাকে না কোনো জাতপাত অথবা বয়সের ভেদাভেদ। এই রঙের উৎসবের অন্যতম অঙ্গ সংগীত। কখনও একক, তবে বেশিরভাগ সময়ই সময়ই সংগীতের লহরীতে মত্ত হয় জনচিত্ত। দোল যদি হয়। জল-রঙের খেলা, তবে বিকেল সন্ধ্যায় শুধু ফাগ ওড়ানো। সুগন্ধি অবিরের উৎক্ষেপে। বিকেল থেকেই যেন চারিদিকে নেমে আসে এক সুগন্ধির হালকা কুয়াশা। তারই মধ্যে বৈঠকি গানের আসর।
এমনটাই ছিল কিছুদিন আগেও। এখন সে রূপ লেগেছে বিবর্তনের ছোঁয়া। একদা এই আসর মুখরিত হতো রাধা-কৃষ্ণের প্রেমবিহারের পার্থিব-অপার্থিব রূপ নিয়ে। কীর্তন-ভজন ও বৈঠকি গানে। এখনও তাই হয়। তবে বদলে গেছে সংগীত। পরিবেশনের রূপ ও ধারা। নাগরিক সংস্কৃতি বদলে দিয়েছে এই সংগীতের বিষয় এবং আঙ্গিককেও। কিন্তু অন্তরলোকে বয়ে চলেছে সেই একই সনাতনী সুর। একই আনন্দতরঙ্গ যেন ওঠে উথলি উথলি।
দোল রঙের উৎসব। কিন্তু এটাই একমাত্র সংজ্ঞা নয় দোলের। দোল হলো মিলনের উৎসব। এই মিলন শ্রীমতী রাধাসহ গোপীজনের সঙ্গে নটবর শ্রীকৃষ্ণের। এই মিলন পুরুষ ও প্রকৃতির। এ মিলন ভগবানের সঙ্গে ভক্তের। এ মিলন। দেবতার সঙ্গে মানবের। এই মিলন প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের। এই মিলন মানুষের সঙ্গে মানুষের। ওই মুহূর্তে সবধরনের ভেদাভেদ মুক্ত মানবমনের এ এক অপূর্ব মহা-মিলন।
পুরাণ কথা, বৃন্দাবনে কৃষ্ণলীলার একটি তরঙ্গ এই দোল উৎসব। রাধা এবং গোপিনীরা সবসময়ই ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে। বিভোর। তাদের চিত্তবাসনা মেটাবার জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কার্তিকী পুর্ণিমায় রত । হয়েছিলেন রাসলীলায়। তারপরও আরও অন্তরঙ্গ হওয়ার বাসনা জাগে তাদের চিত্তে। আর সেই চিত্তরঞ্জনের জন্যই কৃষ্ণ মাতেন আর এক লীলায়। তারই নাম দোললীলা। এই লীলায় সক্রিয় অবশ্যই। গোপ-গোপিনীরাই। ফাল্গুনের সেই পূর্ণিমা তিথিতে প্রত্যহের মতোই কৃষ্ণ এবং গোপবালকরা গিয়েছিলেন গোঠে গো-পাল নিয়ে গো চারণে। প্রতিদিনের মতোই। সেদিনও সবত্স গাভীদের মাঠে ছেড়ে দিয়ে তারা মেতে ওঠেন ক্রীড়ারঙ্গে। এদিন গোপ বালক-বালিকারা রাধা ও কৃষ্ণকে। দোলায় বসিয়ে দিতে থাকে দোল।
দোল-দোল-দোল! দে দোল-দোল! দোলায় বসে দোল খেতে খেতে রাধা-কৃষ্ণ যেমন আবেশবিহ্বল, গোপ, গো, বালকরাও ক্রীড়াকৌতুকে অনাবিল আনন্দে.. মত্ত। সেই আনন্দকে আরও রূপ ও রঙ্গময় ও করতেই অকস্মাৎ তারা ওই যুগলমূর্তিকে। রাঙিয়ে তোলেন প্রাকৃতিক নানা রঙে। রাধা-কৃষ্ণকে রং দিতে দিতেই তারা । পরস্পরের দিকেও বর্ষণ করতে থাকেন নানা রঙের বারিধারা। রঙিন হয়ে ওঠার সেই মুহূর্তটিই সূচিত করে পরবর্তী দোল উৎসবের। সখ্য ও প্রেম রঙের যে এক আশ্বর্য মিলন মেলা।
দোল একটি সর্বভারতীয় উৎসব। ফাল্গুনী চতুর্দশী পূর্ণিমা তার পরদিন পর্যন্ত এই উৎসবের ব্যাপ্তি। প্রথম দিন চঁাচর তাকে কেন্দ্র করেই বহূৎসব। এদিন রাধা-কৃষ্ণ। এবং নারায়ণের বিশেষ পূজো শেষে শুরু হয় বহূৎসব। বঙ্গদেশে যার পরিচিতি বুড়ির ঘর পোড়ানো বা নেড়াপোড়া নামে।
পাটকাঠি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি বিশেষ ঘরে আগুন দিয়ে সমাপ্তি চঁাচরের। তারপরই ছেলেপিলেদের বড়ো সাধের নেড়াপোড়া। সারা বছরের যাবতীয় আবর্জনা, বাঁশ কাঠ, ইত্যাদি নানা দাহ্য। পদার্থ দিয়ে রূপ দেওয়া হয় একটি মূর্তির। তারপর তাতে আগুন দিয়ে বালকদলের উচ্ছাস এবং ছড়া কাটা—
আজ আমাদের নেড়া পোড়া কাল আমাদের দোল। এখন বদন ভরে বলো সবাই শুধু হরিবোল-হরিবোল।
ওই আগুনেই পোড়ানো হয় সদ্য খেত থেকে ওঠা আলু। তারপর সেই আলু। পোড়া দিয়ে শুরু হয় যেন এক গণভোগ।
এই যে বুড়ি পোড়ানো—তার মধ্যে যেন । দেখা যায় দশেরার রাবণবধের প্রতিরূপ। অবাঙ্গালিরা এই আগুন খেলায় ব্যবহার করেন আখ এবং রবিশস্য ছোলা। আখ একবারে মাথার পাতা সমেত এবং কঁচা ছোলা সমেত ছোলাগাছ আগুনে আহুতি দেওয়া তাদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
কেবল তাই নয়, এই বৎসবের সময়ই মাঠ থেকে কেটে নেওয়া গম এবং অনান্য দানাশস্যের গাছের গোড়া ইত্যাদি কৃষি বর্জেও দেওয়া হয় আগুন। আগুনে ভস্মীভূত ছাই সার হিসেবে বাড়ায় খেতের উর্বরাশক্তি। অন্যদিকে ওই আগুনে পুড়ে ছাই হয় অবাঞ্ছিত কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়। ফলে প্রকৃতি হয় নির্মল। তবে ব্যাপক হারে গম ইত্যাদি রবিশস্যের অবশিষ্ট বা খড় পোড়ানোর ফলে আবার ধুনো এবং ধোঁয়ায় ঘটে বায়ুদূষণও।
বহূৎসব সম্পর্কেও রয়েছে এমনই একটি কাহিনি। বিষ্ণুদ্বেষী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ পরম বিষ্ণু ভক্ত। আর সেটাই ক্রুদ্ধ করে তোলে। হিরণ্যকশিপুকে। নানাভাবে চেষ্টা করেন। তিনি প্রহ্লাদকে হরিনাম ভোলানোর জন্য। নানা ষড়যন্ত্র করেন। এমনকী শেষে পুত্রকে। হত্যার চক্রান্ত করতেও দ্বিধা করেন না। হিরণ্যকশিপু। বিষপ্রয়োগ, পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া, মত্ত হাতির পায়ের তলায় পিশে মারা ইত্যাদি আরও বিভিন্নভাবে। অবশেষে শরণ নেন তিনি হোলিকার।
হোলিকার পরিচয় সম্পর্কে শোনা যায় বিভিন্ন কথা। কেউ বলেন, হোলিকার তার অন্যতম সহচরী এক রাক্ষসী। আবার কারো মতে তিনি রাজা হিরণ্যকশিপুর বোন।
হোলিকা বিশেষ বিদ্যার সাহায্যে আগুনে অদগ্ধ অবস্থায় থাকতে পারত। তাই ঠিক। হয়, এক ঘরে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে বসবে হোলিকা। তারপর আগুন দেওয়া হবে । তাতে। হয়ও তাই।
এবার অপেক্ষা হিরণ্যকশিপুর। আশা, আগুনে পুড়ে মরবে প্রহ্লাদ আর হাসি মুখে বেরিয়ে আসবে হোলিকা। সত্যিই হাসি মুখে বেরিয়ে এল—হোলিকা নয়, প্রহ্লাদ। হরিনাম করতে করতে বাবাকে প্রণাম করে প্রহ্লাদ। আর ভস্মীভূত হয়ে যায় হোলিকা। সেই ঘটনা স্মরণেই এই বহুৎসব বা বুড়ির ঘর পোড়ানো।
বঙ্গদেশে এবং কিছু কিছু জায়গায় এই বুড়ির ঘর পোড়ানো হয় দোলের আগের দিন। বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ উত্তরভারতেও হয় তাই। তবে ওইসব অঞ্চলে দোলের নাম হোলি। আর হোলি হয় বঙ্গদেশে দোলের পরদিন। তবে কোনো কোনো বছর তিথি অনুযায়ী দোল এবং হোলি পালিত হয় একই দিনে।
দোল বা হোলি একটি বসন্তোৎসব। বাসন্তিক ফসল ঘরে তোলার সময়ের সঙ্গে যোগ রয়েছে এই উৎসবের নানাভাবেই। নতুন ফসল তোলা এবং নতুন শস্য বোনার। প্রস্তুতিকালের সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই উৎসবের। শুধু ধর্ম বা লৌকিক আচার নয়, দোলের উৎসে রয়েছে এক সামাজিক মূল্যবোধও। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক বিবর্তনেরও এক ধরনের ইতিহাস। রয়েছে নারী-পুরুষের সহজ সম্পর্কের এক উদ্ভাস। রয়েছে দেশের কৃষি এবং কৃষি সভ্যতারও এক ধরনের সংযোগ। রয়েছে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক চিন্তারও কিছু প্রকাশ। রাধা-কৃষ্ণকে দোলায় বসিয়ে দোল দেওয়ার সঙ্গে পৃথিবীর অয়নবলয়েরও এক ধরনের আভাস দেখেন অনেকেই।
সব মিলিয়ে ভারতীয়দের জীবনে দোল শুধু রেঙে ওঠা নয়, রাঙিয়ে তোলার, সকলের সঙ্গে একাত্ম হওয়ারও অনুষ্ঠান বা উৎসব।
নন্দলাল ভট্টাচার্য
2020-03-10