শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ব্যাকরণ

ভারতবর্ষ সারা পৃথিবীতে একমাত্র ব্যতিক্রম। আরব সম্রাজ্যবাদীরা বা ইউরোপের আক্রমণকারী ঔপনিবেশিকরা যেখানেই গেছে সেখানেই প্রাচীন সভ্যতার সব চিহ্ন শেষ হয়ে গেছে। প্রাচীন মিশর কত উন্নত ছিল। সংস্কৃতিতে, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে। আরবদেশ থেকে মুসলমান আক্রমণকারীরা এসে মাত্র পঞ্চাশ ষাট বছরের মধ্যে মিশরের সংস্কৃতি শেষ করে দিয়েছিল। ৬৩৯ সালে উমর-ইবন-অল-আস ৪০০০ আরব উপজাতি সেনা নিয়ে মিশর আক্রমণ করেছিল। ৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাচীন মিশর ধুয়ে মুছে। সাফ হয়ে গেল। দু একটা বাদ দিলে পিরামিডগুলো ফাঁকা করে দিয়েছিল। আরব আক্রমণকারীরা। আজকের মিশরে তুতেন খামের বা রামেসাম নামের কোনো মিশরীয়কে কায়রোর রাস্তায় ঘুরতে দেখবেন না।
মায়া, আজটেক বা ইনকা সভ্যতাও অনেক প্রাচীন ছিল। মায়ারা পাঁচ হাজার বছরের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিল, জ্যোতির্বিদ্যার বহু বিষয় তারা বুঝতে পারত, তাদের ভাষা ছিল, লিপি ছিল, সাহিত্য ছিল। খ্রিস্টফর কলম্বাস ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর আমেরিকা আবিষ্কার করলেন। এরপর শুরু হলো অমানবিক অত্যাচার। লড়াই করেছিল রেড ইন্ডিয়ানরা। কিন্তু নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, গণধর্ষণ আর ধর্মান্তরণের ফলে মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল ইনকা, মায়া, আজটেক সভ্যতা। আজ সৃষ্টির দেবতা সূর্যদেব পাচাকামাকের নিত্য পূজা হয় এমন কোনো মন্দির উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকার কোথাও নেই। স্পেনের আক্রমণকারীরা ১৩০০ বছরের পুরাতন পেরুর সূর্যমন্দির ভেঙে ফেলেছে। কিন্তু আজ পেরুতে বা দক্ষিণ আমেরিকার বা সমগ্র দুই মহদেশে এমন মানুষ আর অবশিষ্ট নেই যে তারা তাদের উত্তরাধিকার দাবি করবে। ইউরোপের খ্রিস্টান আক্রমণকারীর দল আমেরিকার সভ্যতাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে।
ভারতবর্ষেও আক্রমণ কম হয়নি। আশ্চর্যজনকভাবে আরব ও ইউরোপ দুই উপনিবেশ এখানে কায়েম ছিল। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার সহ্য করবার পরেও আজও ভারতবর্ষ টিকে আছে। ভারতবর্ষের এই অসাধারণ বিজয়ের পিছনে আছেন বহু যুগাবতার পুরুষ। যাঁরা যুগে যুগে সমাজকে সঠিক পথ দেখিয়ে এই অসাধ্যসাধন করেছেন। | যদি জগদ্গুরু আদি শঙ্করাচার্য না আবির্ভূত হতেন তাহলে ভারতবর্ষের কী অবস্থা হতো! বৌদ্ধধর্ম যেদিন তার দর্শনের ধার হরিয়েছে। কেবল আচার সর্বস্বতা আর বিকৃত তন্ত্র ধর্মটার আসল শক্তিটাই নস্ট করে দিয়েছিল। তাই কেবল বৌদ্ধ শক্তি দিয়ে সেদিন ভারতবর্ষ আরব সাম্রাজ্যবাদী ইসলামকে রুখতে পারত না। শঙ্করের প্রভাব কয়েকশো বছর
ভরতবর্ষকে বাঁচিয়েছিল। তারপর যখন প্রায় সমগ্র দেশটাই ইসলামের কবলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন যে সমস্ত মহাপুরুষ এসেছিলেন তাদের মধ্যে গুরুনানকদেব (১৪৬৯-১৪৩৯) এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৪) নাম আসে সবার আগে । একজন পশ্চিম ভারতকে রক্ষা করেছিলেন, অন্যজন পূর্বভারতকে।
বঙ্গদেশের বীরেরা বহুদিন পর্যন্ত আরবদের আক্রমণ থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করেছিলেন। বঙ্গের শস্যশ্যামলা ভূমি, শিল্পকার্য, ধাতুশাস্ত্রে নৈপুণ্য বা ধনসম্পদের কথা বহুদিন থেকেই বিদেশি আক্রমণকারীদের জানা ছিল। বাঙ্গলা, গুজরাত আর কেরলের বণিকেরাই মূলত আরবদের সঙ্গে বাণিজ্য করত। তাই বাঙ্গলার সমৃদ্ধি তারা হাতের তালুর মতোই চিনতো। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ – বিন-কাশেমের সিন্ধুপ্রদেশ আক্রমণের মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলমান আগ্রাসন শুরু হলো। ১০২৫ সালে গজনির সুলতান মামুদ গুজরাতে সোমনাথ মন্দির লুঠ করল। তখন বাঙ্গলাশাসন করছেন মহীপাল। তারও অনেক পরে ১২৫৪ সালে এক ইয়েমেন থেকে আসা সুফি ভেকধারী শাহ জালালের প্রতারণাতে হেরে গেলেন শ্রীহট্টের রাজা গৌরগোবিন্দ।
মহারাজ গৌরগোবিন্দের পরাজয়ের পর শ্রীহট্ট শ্রীহীন হতে থাকে। যে শ্রীহট্ট সংস্কৃত শিক্ষায়, ন্যায় শিক্ষায় সারা ভারতবর্ষে অগ্রগণ্য ছিল, সেখান থেকে পণ্ডিতেরা অত্যাচর সহ্য না করতে পেরে পালিয়ে আসতে শুরু করেন। বাঙ্গলার হিন্দু রাজত্ব রক্ষার চেষ্টা যশোরের প্রতাপাদিত্যও করেছিলেন। কিন্তু ১৬১১ সালের জানুয়ারি মাসে মুঘল সেনা মহারাজা প্রতাপাদিত্যের নৌবহর আক্রমণ করল। রাজা প্রতাপাদিত্যের পরে আর বাঙ্গলাতে কোনো আশা থাকল না।
ভারতের আকাশে এমনই ভয়ানক সঙ্কটময় সময়েই পূর্বভারতের পরিত্রাতা হয়ে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ। মহাপ্রভূর পিতৃদেব জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্টের ঢাকা দক্ষিণ গ্রাম থেকে আসেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপ তখন নব্যন্যায়ের নতুন তীর্থক্ষেত্র। বাসুদেব সার্বভৌম মিথিলার মহাপণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রের কাছ থেকে নব্যন্যায়। শিক্ষা লাভ করে নবদ্বীপে তার চর্চা শুরু করেন। তারই শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণিকে প্রাচ্যের। সক্রেটিস বলা হয়। রঘুনাথও সম্ভবত শ্রীহট্টের পঞ্চখণ্ড থেকে নবদ্বীপে পড়তে এসেছিলেন। জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র নিমাইও মহাপণ্ডিত হলেন। তবে ন্যায় বা নব্যন্যায়ে নয়, হলেন ব্যাকরণে। ব্যাকরণ মূলত যুক্তিনিষ্ঠ, খানিকটা বিজ্ঞান অনুসারী। মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এক অভিজ্ঞ বৈয়াকরণিকের ছাপ সুস্পষ্ট। | গয়াতে বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনের পরে নিমাই পণ্ডিতের মনের আমূল পরিবর্তন হলো। মহাপণ্ডিত, অসীম সাহসী, তার্কিক, পরম গৃহস্থ একজন সফল সম্পন্ন মানুষ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ব্রত নিলেন। সেই সময় সমাজকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল ত্যাগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের। এবিষয়ে পরবর্তী জীবনে ছোটো হরিদাসের প্রতি গৌরাঙ্গের কঠোরতা সেই রেজিমেন্টালাইজেশন এই কঠোরতার শিক্ষাই দেয়। ছোটো হরিদাস ভিক্ষা করতে গিয়ে গৃহস্থ মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন মাত্র। মহাপ্রভূ তাকে ভৎসনা করেন। হরিদাস মনঃকষ্টে আত্মহত্যা করেন। মহাপ্রভু তাঁর শেষদর্শনও করেননি। এই সুশৃঙ্খল সন্ন্যাসী বাহিনী সমাজ আর রাষ্ট্র রক্ষা করবে। নিজের জীবনেও তিনি মা শচীকে দুপুরের খাবার। দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে সন্ন্যাস আশ্রমে কখনো দেখা করেননি। এই রেজিমেন্টালাইজেশন বঙ্গদেশে তারই আবিষ্কার।
দ্বিতীয় আবিষ্কার নগর সংকীৰ্ত্তন আর হরিনাম প্রচারযজ্ঞ। সেটি আসলে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। যে জাতি পরাধীন, বীর সাহসী ক্ষাত্ৰতেজের যেখানে অভাব সেখানে। এই শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মে উন্নত একটি জাতিকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় ছিল না। একসঙ্গে এতজন মানুষ এক হয়ে সঙ্ঘবদ্ধতা অনুভব করত। মনে জোর আসত যে এই হিন্দুদের আঁচড়ানো, কামড়ানো, ছিড়ে ফেলা সহজ হবে
।নবদ্বীপে যখন অদ্বৈত আচর্যের ঘরে প্রবেশ করে মৌলানা সিরাজুদ্দিন ওরফে হাবিবুর রহমান ওরফে চঁাদকাজি সংকীর্তন বন্ধের নিদান দিয়েছিলেন, তার প্রতিক্রিয়ার কাজির তীক্ষ্ণবুদ্ধিতে ধরা পরেছিল যে হিন্দুদের এই একত্রিত শক্তি প্রদর্শন আসলে নবজাগরণ। মহাপ্রভূ সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। চারদিক থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে মশালের আলোতে এগিয়ে চলল নগর সংকীর্তন। গন্তব্যস্থল চঁাদকাজির প্রাসাদ। ভীতসন্ত্রস্ত কাজি আত্মসমর্পণ করলেন। সেদিন মহাপ্রভূ নগর সংকীর্তন করার পাশা’ অর্থাৎ অনুমতি ফলক নিয়ে ফিরেছিলেন। এই জয় বাঙ্গলার হিন্দুদের বেঁচে থাকার ছাড় পত্র হয়েছিল। আজও পশ্চিমবঙ্গে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু আর পাকিস্তানের ভয়াবহ সন্ত্রাসের পরেও পূর্ববঙ্গে ৮ শতাংশ হিন্দু নামধারীর অস্তিত্ব তার ছাড়পত্র নিয়ে সেদিন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূ ফিরেছিলেন। | তার তৃতীয় আবিষ্কার নীলাচলে। বাঙ্গলা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। ওড়িশা তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্র তখন তিন দিকে তিন শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন। রাজা প্রতাপরুদ্র দেব বাঙ্গলার হুসেন শাহের সেনাপতিকে মারতে মারতে হুগলীর মন্দারণ দুর্গ পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন। লড়াই করছেন গোলকুণ্ডার কুতুবশাহির সঙ্গে। একইসঙ্গে তার ভয়ানক প্রতিপক্ষ ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্য। এই ত্রিমুখী লড়াই লড়ে গজপতি সাম্রাজ্যের অমিত বিক্রমশালী সামরিক শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েগিয়েছিল।
এই জিঘাংসার কোনো একমূখী লক্ষ্যও ছিল । হিন্দুর বিরুদ্ধে হিন্দুর লড়াই যে ওইভয়ানক সময়ে কতটা মূর্খতা সেটা বুঝেছিলেন মহাপ্রভু। গজপতি রাজ পুরুষোত্তম দেব কাঞ্চি জয় করে কাঞ্চির আরাধ্য দেবতা ‘গণেশকে নিয়ে এসেছিলেন। আজও পুরীর মন্দির পরিসরে শ্রীমন্দিরের পশ্চিম দিকে সাক্ষীগোপাল মন্দিরের পাশেই অবস্থান করছেন সেই কাঞ্চি গণেশ বা ভণ্ড গণেশ বা উচ্ছিষ্ট গণেশ। এই ধরনের সংস্কৃতি হিন্দু রীতি বিরোধী। হিন্দুদের যে শাশ্বত পরম্পরাতে এসবে গভীর আঘাত লাগছিল। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গজপতি মহারাজ প্রতাপরুদ্র অনেক সংহত করলেন নিজের শক্তিকে।
এরপর থেকে ওড়িশা পূর্বভারতের পরম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। উত্তর ভারত থেকে, পূর্ব ভারত থেকে মানুষ এসে আরয় গ্রহণ করল, ওড়িশার এক একটি অনুন্নত, জঙ্গলের দায়িত্ব নিতে এসেছিল হিন্দু রাজন্যবর্গ। ওড়িশার এই উত্তরণের শুরুটা হয়েছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে। তাই বাংলা এবং উড়িষ্যার মধ্যেকার সম্পর্ক যেমন মহাপ্রভূ স্থাপন করেছিলেন, তেমনই ওড়িশাকেও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন।
যদিও ভক্তি আন্দোলনের শুরুটা দক্ষিণ ভারতে তবু পূর্বভারত আর উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই বিজয়ী আন্দোলনের প্রচার প্রসারে মহাপ্রভূর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এপ্রসঙ্গে মহাপ্রভূর চতুর্থ আবিষ্কার হলো ‘বৃন্দাবন। ভগবান কৃষ্ণের বাল্যলীলা, ভক্তিরসের প্রেমধারার মূলভূমি তো বৃন্দাবন। বৈষ্ণব রসসাহিত্য যে বৃন্দাবনের উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী কয়েকশো বছর এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ভিত হয়ে উঠেছিল তার জন্য বৃন্দাবন আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ লীলাক্ষেত্র খুঁজে বের করার উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলার ওই জঙ্গলে। এরপর থেকে সেইস্থান ধীরে ধীরে এক ধর্মনগরী গড়ে উঠল। ষড় গোস্বামীর আবির্ভাবে তা পূর্ণ হয়েছিল। সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট ও জীব গোস্বামী এই শক্তপোক্ত দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিলেন যা সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গিয়েছিল। নরসিংহ মেহতার বিখ্যাত গান, ‘বৈষ্ণব জন তো তেন কহিয়ে / যে পীড় পরায়ী জানে রে’মানে যিনি অপরকে ভালোবাসতে জানে তাকে বৈষ্ণব বলে। এই কালজয়ী ভাবনা বিদেশি আক্রমণের শেষভাগে ভারতবর্ষকে বাঁচিয়েছে। তার কেন্দ্রে ছিল বৃন্দাবন। যা আধুনিক যুগে আবিষ্কার করলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
মহাপ্রভূর পঞ্চমতম আবিষ্কার অবশ্যই আচণ্ডালে হরিনাম বিলিয়ে দেওয়া। জাতিভেদ হিন্দু সমাজের কর্কটরোগ। ওই একটি দোষ সর্বগুণ, সর্বশক্তি সম্পন্ন হিন্দুজাতিকে বিলুপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মধ্যযুগে হিন্দুসমাজ বিলুপ্ত হয়ে যেত যদি শ্রীচৈতন্যের মতো মহাপুরুষ না আবিভূর্ত হতেন। হরিনাম জপ করলে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল সকলে উদ্ধার হবে এটা যুগান্তকারী সুত্র ছিল। আজও পশ্চিমবঙ্গে যে জাতিভেদের কুৎসিত চেহারা অনেকটা কম দেখা যায় তার মূল কারণ ওই নিমাই পণ্ডিত। শিক্ষাষ্টকমের তৃতীয় স্তোত্রে চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন— ‘তৃণাদপি সুনীচেন বরোবহপি সহিষ্ণুণা। অমানিনা মানদেন কীর্তনীয় সদা হরি।।
এই ‘অমানিনা মানদেন’ সমাজকে এক রেখেছে। এই অদৃশ্য শক্তি বঙ্গদেশকে আফগানিস্তান হতে দেয়নি। যার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ক্ষণজন্ম পুরুষ যাঁরা তাদের ভাবনাকে কেবল সমকালের বিচারে ভাবলে ভুল হবে। আবহমানকালের প্রেক্ষাপটে ভাবা প্রয়োজন। বাঙ্গলার মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে আধুনিক কালের শিল্প সাহিত্য পর্যন্ত যুক্তিবাদী বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মানবদরদি শ্রীচৈতন্যের প্রভাব বিদ্যমান। বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল লিখেছেন ১৪৮৪ সালে। সেই ‘পদ্মপুরাণে’ দেবী মনসাচঁদ সদাগরের পুত্রদের মৃত্যুতে জয়ের হাসি হাসছেন। কবি বিপ্রদাস পিপিলাই ১৪৯৫ সাল নাগাদ ‘মনসা বিজয়’ লেখেন। তার জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়াতে। সেদিনও মহাপ্রভুর ভাবনা সারা বঙ্গদেশে ছড়িয়ে যায়নি। কিন্তু চৈতনোত্তর যুগে যাঁরা ‘মনসামঙ্গল’ লিখলেন সেখানে দেবী মনসার এক অপরূপা দয়াময়ীভাবের প্রকাশ দেখা গেল। সপ্তদশ শতকের কবি কেতক দাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যের দেবী মনসা কেঁদে ফেললেন চঁাদের পুত্রদের মৃত্যুতে। এ এক সাংস্কৃতিক উত্তরণ। এই মানবিক শক্তি একটি সমাজকে কালজয়ী জাতিতে পরিণত করে। বাঙ্গলার শক্তিশালী সাহিত্য যা পরবর্তীকালে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে সমগ্র ভারতবর্ষকে মুক্তি প্রদানের অন্যতম সহায়ক হয়েছিল সেই বাংলাসাহিত্য সংস্কৃতিকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে পরিণত করাটা ছিল চৈতন্যদেবের অপর এক আবিষ্কার। তা কেবল কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ বা বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের ‘চৈতন্যভাগবত’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আধুনিক সাহিত্যে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চুয়াচন্দন’ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে।
এইসব আবিষ্কার আর তার প্রয়োগের মধ্যে এক বিজ্ঞানমনস্কতার আগে আছে এক বাস্তববোধসম্পন্ন মানুষের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সেইসঙ্গে এক বৈয়াকরণিকের যুক্তিবোধ। আরব সাম্রাজ্যবাদ ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার পরেও ভারতবর্ষ বেঁচে আছে। আরব সাম্রাজ্যবাদের প্রবেশস্থল সিন্ধুপ্রদেশ ভারতীয় সংস্কৃতির এককালের কেন্দ্রস্থল ছিল। আজ তা একটি মৌলবাদী ইসলামি দেশের অংশ। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবেশস্থল ছিল বঙ্গদেশ। পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু আজও ভারতীয় সংস্কৃতিকে বহন করছে। বাংলাদেশে এত মৌলবাদী অত্যাচারের পরেও ‘ভজ নিতাই গৌর রাধেশ্যাম, বলো হরেকৃষ্ণ হরে রাম’সংকীর্তন বন্ধ হয়নি। ১৯৭০ সালে খানসেনারা ফরিদপুরের জগদ্বন্ধু মঠের শ্রীরঙ্গম আশ্রমের মাঠে ১১জন সংকীর্তনরত সন্ন্যাসীকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল। কিন্তু আজও হরিনাম সেখানে বন্ধ হয়নি। ২০২০ সালের গৌরপূর্ণিমার দিনও কেউ ফরিদপুরে গেলে দেখতে পাবেন হরিনামে নেচে গেয়ে মাতোয়ারা ভক্তের দল। | প্রাণের গৌর যে আমাদের সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে গেছেন, নিমাই পণ্ডিতের ব্যাকরণ ভুল হবার নয়। এই বঙ্গভূমিকে শেষ করবে এমন ক্ষমতা কারো নেই।
জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.