গত ৯ ফেব্রুয়ারি পি. পরমেশ্বরনজীর পরলোকগমনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ এবং তার কেরলের সহযোগী সংগঠনগুলি তাদের সবথেকে প্রিয়, বিখ্যাত, শ্রদ্ধেয়, সর্বজনস্বীকৃত চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, কবি এবং শিক্ষাবিদকে হারালো।
পরমেশ্বরনজী ছিলেন একজন উঁচুমানের শিক্ষাবিদ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাঁর শিক্ষাগত উৎকর্ষতা স্বীকৃতি পেয়েছিল। ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিদ, পি. গোবিন্দ পিল্লাই এবংই.কে. নায়নারের মতো মার্কসবাদীনেতা, কে. করুণাকরণ, এ.কে. অ্যান্টনি, ওমেন চাণ্ডির মতো কংগ্রেসি নেতৃত্ব এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিথালা পরমেশ্বরণজীর দার্শনিক জ্ঞানের গভীরতা এবং ত্যাগের মানসিকতাকে স্বীকৃতি এবং প্রশংসা করেছেন। কেরলের বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পরমেশ্বরনজীকে ‘ঋষি’ বলে উল্লেখ করে বলেন তিনি তার দৃঢ়বিশ্বাসের প্রতি স্থির সংকল্প ছিলেন। | পরমেশ্বরনজীর মৃত্যু কেরলের রাজনীতি ক্ষেত্রে এক ব্যাপক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। যদিও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখতেন, তথাপি রাজ্যের দৈনন্দিন বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রভাবিত করত। পরমেশ্বরনজী ছিলেন একজন অসাধারণ এবং নিয়মিত লেখক। কেরলের সমসাময়িক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির ওপরতার মন্তব্য সবাই দেখত এবং নিয়মিত তার চর্চা হতো।
১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে জনতা পার্টির সরকার গঠিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন এবং স্বল্প সময়ের জন্য দিল্লিতে দীনদয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পদে ছিলেন। ওই সময় আমার সঙ্গে পরমেশ্বরনজীর ঘনিষ্ঠতা হয়। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয় ১৯৬৯ সালে। তিনি তখন ভারতীয় জনসঙ্রে জেনারেল সেক্রেটারি (সাধারণ সম্পাদক) ছিলেন। কেরলের ছোট্ট শহর চেঙ্গায়ূরে একটি পথসভায় তিনি বক্তব্য রাখছিলেন, সেখানে কোনো চেয়ার, টেবিল, বা মঞ্চ ছিল না। রাস্তার ধারে মাইকের সমনে দাঁড়িয়ে তিনি জনসঙ্ঘের মতাদর্শ এবং উত্তর ভারতের সংযুক্ত বিধায়ক দল সরকারে জনসঙ্ঘের অসাধারণ প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, একদিন ভারতের মানুষের স্বাভাবিক পছন্দের তালিকায় জনসঙ্ স্থান পেতে বাধ্য। তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসঙ্ কেরলে একেবারে নতুন।
জনসঙ্ঘকে কেরলে স্থাপনের পেছনে পরমেশ্বরজী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ সাল কোঝিকোড়ে জনসঙ্ঘের বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক জাতীয় অধিবেশন হয়েছিল। তখন পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় ভারতীয় জনসঙ্রে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই সম্মেলন রাজ্যের মানুষের মধ্যে এক আগ্রহ সৃষ্টি করে। সংবাদমাধ্যমও এই অধিবেশনের প্রচার করে। ওই অধিবেশনের মূল স্থপতি ছিলেন পরমেশ্বরনজী। তার ছিল অসাধারণ বাগ্মিতা, যা তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। যেখানেই তার ভাষণ হতো, অনেক জনসমাগম হতো সেখানে।
আমি তখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম। আমি গেলাম এবং তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। তিনি আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং আদর্শবাদের জন্য কাজ করে যেতে বললেন। পড়াশোনা শেষ করার পর যখন আমি ইউএনআই-তে সহ-সম্পাদকের কাজের প্রস্তাব পেলাম, তখন তার আমন্ত্রণেই ১৯৭৯ সালে দিল্লিতে এলাম। তিনি আমাকে কিছুদিনের জন্য ডিআরআই-তে এবং তারপর ঝাণ্ডেলওয়ালায় কেশব কুঞ্জে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সঙ্রে তৎকালীন বৌদ্ধিক প্রমুখ বাপুরাও মোঘের আগ্রহে এবং পরমেশ্বরনজীর উপদেশক্রমে আমি ‘জরুরি অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংগ্রাম’ বিষয়ে একটি বই রচনা করার জন্য তথ্যাদি সংগ্রহের কাছে লিপ্ত হই। এই কাজটির পথপ্রদর্শক ছিলেন ঠেংড়ীজী। ১৯৮১ সালে পরমেশ্বরনজীর দিল্লি ছেড়ে চলে আসার আগে পর্যন্ত আমি কেশবকুঞ্জে তার সঙ্গে থাকতাম। এই সময় আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ সঙ্-প্রচারক। তিনি খুবই উদার মনের মানুষ ছিলেন কিন্তু আদর্শবাদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোশহীন। যুবকদের প্রতি তার আগ্রহ ছিল অনেক। তিনি তাদের আদর্শবাদের শিক্ষা দিতেন।
পরমেশ্বরনজীর আগ্রহেই ১৯৮০ সালে আমি যখন আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাই, মায়ের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতে তিনি। আমাকে ৫০ টাকা দিয়েছিলেন। অদ্ভুত এক স্নেহ এবং উদারতা ছিল তার মধ্যে। প্রচারক হিসেবে টাকা খরচের ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। তবুও মিষ্টি কেনার জন্য তিনি আমাকে ৫০ টাকা দিয়েছিলেন। স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে তার এরকম আবেগের সম্পর্ক ছিল।
তারই অনুপ্রেরণায় আমাদের সাপ্তাহিক মালয়ালম্ প্রকাশনা ‘কেশরী’তে সাপ্তাহিক স্তম্ভ লেখা শুরু করি। কয়েকমাস পরে ‘কেশরী’ মানিঅর্ডারে আমাকে চারশো টাকা পাঠায়, সেই টাকা আমি গ্রহণ করি এবং পরমেশ্বরনজীকে পুরো ব্যাপারটা বলি। তিনি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেশরী’ থেকে সাম্মানিক নিতে পারবে?তুমি একজন প্রচারক। উত্তর দেওয়ার কোনো ভাষা আমার ছিল না। নিজেকে অপরাধী মনে হলো এবং কেশরী’র সম্পাদক এস.এ. কৃষ্ণানকে আমাকে সাম্মানিক পাঠানোর জন্য বললাম।
টাকা পয়সার ব্যাপারে পরমেশ্বরনজীর এরকম চিন্তা ভাবনা ছিল। প্রচারক হিসেবে সঙ্ঘের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা থেকে তিনি কোনোরূপ বিচু্যতি পছন্দ করতেন না। মাঝে মধ্যে তিনি সঙ্রে কর্মপদ্ধতি, ব্যবহারিক দিক এবং আদর্শবাদ নিয়ে গভীর চিন্তন করতেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি তার সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা করতাম। বিভিন্ন বিয়য়ের ওপর বিতর্ক তিনি খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি যদি কোনো বিষয়বিন্দু নিয়ে জেদ করতাম, তাহলে তিনি গম্ভীর হয়ে যেতেন, যার অর্থ ছিল তিনি ওই বিষয়ে আর আলোচনা চালানোর পক্ষপাতীনন। এই রকম ক্ষেত্রে তিনি দু একদিন ধরে কোনো কথাই বলতেন না। তারপর তিনি একটু হাসতেন এবং স্নেহ ও উৎসাহ দিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিতেন। পরমেশ্বরনজী যখন দিল্লিতে থাকতেন, তখন কেশবকুঞ্জ কর্মোদ্দীপ্ত থাকত।বাপুরাওজী, ভাউ রাউ দেওরস, দত্তোপম্ভোজী, রজ্জভাইয়াজী, অশোক সিংহলজী এবং আরও অনেক প্রবীণ প্রচারক সেখানে থাকতেন।
ডি. আর. আই. (দীনদয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট) থেকে হয়ে তিনি কেরলের উদ্দেশে রওনা দিলেন ভারতীয় বিচর কেন্দ্র তৈরির জন্য। পরবর্তীকালে তিনি কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ কেন্দ্রের প্রধান হয়েছিলেন। এই সময়কালে মার্কসবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তিনি মালায়ালম ভাষাতে অনেক বই লিখেছেন। বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তির লেখা সংগ্রহ করে তিনি ভগবদগীতা এবং স্বামী বিবেকানন্দের ওপর দুটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সঙ্রে কেরল শাখা যে কয়েকজন বিরল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কার্যকর্তাকে তৈরি করেছিল, পরমেশ্বরনজী তাদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, লেখক এবং সুবক্তা, যাঁর মানসিক ঝোক ছিল আধ্যাত্মিকতার দিকে।
তিনি ছিলেন কেরলের ঘরে ঘরে পরিচিত মানুষ। তিনি সংগঠনের রাজ্য ও অখিল ভারতীয় স্তরে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক। দিল্লিতে তিনি আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে ছিলেন। এই তালিকায় ছিলেন— স্বামী রঙ্গনাথানন্দ, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, অটলবিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদবানী, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, পি. রামমূর্তি প্রমুখ। তিনি যখন ডি আর আই-তে ছিলেন তখন বহু সভায় , কর্মশালায় এবং সেমিনারে চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আহ্বান করতেন। ডি আর আই-এর মাসিক বৌদ্ধিক পত্রিকা ‘মন্থন’-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। মার্কস, গান্ধী, দীনদয়াল এবং নবজাগরণের অগ্রদূত নারায়ণগুরুর ওপর তিনি বই রচনা করেছেন। এছাড়াও ইংরেজি ও মালয়ালামে নিয়মিত স্তম্ভও লিখতেন।
পরমেশ্বরনজী ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ও উদার চিন্তাধারার মানুষ। আশির দশকের প্রথম দিকে বিখ্যাত প্লেব্যাক গায়ক যিশুদাসকে গুরুভায়ুর মন্দিরে প্রবেশের পক্ষ পাতী ছিলেন তিনি। তিনি একবার বলেছিলেন, ধর্মীয় গুরুদের ভোটে লড়া এবং রাজনীতির যোগদান করার প্রবণতা ঠিক নয়। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “যদি ধর্মীয় গুরুরা রাজনীতির স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করেন, তাহলে ধর্মের রক্ষা করবে কে?” | কেরলে সিপিএম এবং আরএসএসের সংঘাত নিয়ে পরমেশ্বরনজী খুব ব্যথিত ছিলেন। বহুবার তিনি দু’পক্ষের মধ্য বিজেপির ঊধ্বর্তন নেতৃত্ব অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং সিপিএমের নেতা ই.কে. নায়ানার এবং ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিপাদকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিলেন। তার প্রচেষ্টার ফলে আশির দশকে বহুবছর দু’পক্ষের মধ্যে শান্তির পরিবেশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। দিল্লির দীনদয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতাদর্শে তিনি ভারতীয় বিচার কেন্দ্র (বি.ভি.কে.) স্থাপন করেছিলেন। বি ভি কে সম্প্রতি অনেক বইপত্র প্রকাশ করেছে। নতুন নতুন ক্ষেত্রে তার আদর্শবাদকে স্থাপন করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিবিধ সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাও ছিল। তার আগ্রহের বিষয়।তার সংগঠন নিয়ে অন্যের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের সঙ্গে তিনি অনবরত বার্তালাপ করতেন। তিনি ছিলেন একজন ভালো কবি। তার বহু কবিতা আজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্রে নিত্যশাখায় গীত রূপে গাওয়া হয়।
সঙ্ঘের কেরল শাখা থেকে যতজন প্রচারক বেরিয়েছেন, পি. পরমেশ্বরনজীর মতো জাতীয় স্তরে এত স্বীকৃতি আর কেউ পাননি। বাজপেয়ী সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে এবং নরেন্দ্র মোদী সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। নব্বইয়ের দশকে তাকে রাজ্যসভার সাংসদ করার প্রস্তাব দেয় বিজেপি, কিন্তু তিনি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁর পরিবর্তে ও. রাজাগোপালের নাম প্রস্তাব করেন। তাঁর জীবন ছিল আত্মত্যাগ এবং অঙ্গীকার পূরণের জীবন্ত উদাহরণ।
ড. আর. বালাশঙ্কর
(লেখক সাপ্তাহিক ‘অর্গানাইজার পত্রিকার পূর্বতন সম্পাদক)
2020-03-10