সন্তে দোলের আশেপাশেই ফুটতো সেই ফুল, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, জুনিয়ার হাইস্কুলের দিকে প্রাচীর ঘেঁষে। ছিল অনুচ্চ একটি বৃক্ষ, তার বিটপ ও কচি কিশলয় নুইয়ে নেমেছে লজ্জায়, তারই ফুলের থোকা টুকটুকে লাল হয়ে অধোমুখী, যেন নববধূ!
ব্রাউনিয়া ফুলের প্রেমে তখন ছিলাম মুগ্ধ। বসন্ত কী এলো! এলো কী ফুলেল অভ্যর্থনা! অপেক্ষায় কাটতো স্কুলের দিনগুলি। রহড়া আশ্রমে রোপিত কয়েকটি আনকমন গাছের অন্যতম ছিল ব্রাউনিয়া। আশ্রমের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ স্বামী পুণ্যানন্দ মহারাজ বড় সাধ করে লাগিয়েছিলেন সেই গাছ। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে আনিয়েছিলেন চারা, কিন্তু ফুল দেখে যেতে পারেন নি। বিধু বাবু বলেছিলেন সে কথা, আমাদের সংস্কৃতের শিক্ষক, বালকাশ্রমের প্রথম আশ্রমিক শ্রী বিধূভূষণ নন্দ। হয়তো আমার মতোই মুগ্ধ ছিল তাঁর চোখ, অথবা আরও সে গভীর মুগ্ধতা! পাছে আশ্রমের ইমারত বেড়ে গিয়ে গাছটি কাটা পড়ে, তাই হাইস্কুলের বিল্ডিং ছেড়ে প্রাচীরের ধার ঘেঁষে লাগিয়েছিলেন সেই গাছ। আমি ক্লাস সিক্স থেকে টেন অবধি প্রতি বছর ফুল ফুটতে দেখেছি; কেমন মনে হয়, ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে গাছটির সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিলাম একমাত্র আমি! বছরের নানা সময় তার ঝোলা, গুচ্ছ কচি পাতা বের হত, যেন এক একটা ঐশী পত্রলিপি আকাশ ছেড়ে নেমে আসতে চায় মাটির বুকে! প্রথমে হাল্কা সবুজ, তারপর হয়ে ওঠে বাদামি-গোলাপী, শেষে ফের সবুজ পাতা। যৌগিক পত্র, তাতে ১২ থেকে ১৮ জোড়া পত্রালিকা (Leaflets)। ফুলের গুচ্ছটি গোলাকার; পুষ্পবিন্যাসের কুঁড়িটি সুদৃশ্য, তার আগাটি সূঁচালো। গাছের শাখাগুলি বেশ শক্তপোক্ত, কাণ্ডটি ধূসর-বাদামী, বল্কল-গাত্র সামান্য নালিময়। গাছটি শেষ পর্যন্ত কাটা পড়েছিল কেন তা জানি না। স্কুল ছেড়ে বেরোনোর পরও উঁচু প্রাচীর ছাপিয়ে তার পত্রল মাথা বেরিয়ে থাকতো, দেখতাম বাইরে থেকে। তারপর হঠাৎ একদিন দেখলাম নেই গাছটি, কাটা পড়েছে, সেখানে ইমারত গড়ে উঠেছে তাও নয়। চেনা ব্রাউনিয়া গাছটি হারিয়ে গেলো, আজও কখনও কোনো ব্রাউনিয়া গাছে ফুল, কচি পাতা বেরোতে দেখলে স্কুল বেলার গাছটির কথা মনে হয়।
Brownea grandiceps, কেউ বলেন এর বাংলা নাম ‘সুপ্তি ফুল’; হয়তো তাই হবে! শীতের সুপ্তি কাটিয়ে তবে ফোটে তার কুঁড়ি। ইংরেজি নাম ‘Scarlet Flame Bean’, ফ্যাবেসী পরিবারের একটি গাছ, আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা, ‘ভেনিজুয়েলা-গোলাপ’-ও বলে থাকেন কেউ। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলে দেখাতে পাবেন তার সৌন্দর্য, এখনই ফুল এসেছে। সারা বিশ্বের ক্রান্তীয় উদ্যানের অন্যতম শ্রীময়ী বৃক্ষ ব্রাউনিয়া, এই গাছটি না থাকলে যেন গ্রীষ্মের কুসুমোদ্যান পরিপূর্ণ হয় না! কিন্তু বড্ড ধীরে বেড়ে ওঠে এই গাছ, খুব বড় গাছের উচ্চতা ৬ মিটারের আশেপাশে। আমার পরিচিত ব্রাউনিয়া সাড়ে তিন-চার মিটার উচ্চতায় কাটা পড়েছিলো।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
চিত্র ঋণ: ইন্টারনেট।