১৭৪০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে সরফরাজ খানকে (Sarfaraz Khan) পরাজিত ও নিহত করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নিয়ে তৈরি সুবা বাংলার নবাব হলেন আলিবর্দি খান (Alibordi Khan)। কিন্তু নিহত সরফরাজ খানের শ্যালক তথা উড়িষ্যার নায়েব-নাজিম ( উপ-শাসনকর্তা) রুস্তম জঙ্গ অস্বীকার করলেন আলিবর্দির আধিপত্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ হলো।
বালাশোরের কাছে ফুলওয়ারির যুদ্ধে আলিবর্দি রুস্তম জঙ্গকে পরাস্ত করে নিজের ভাগ্নেকে উড়িষ্যার নায়েব-নাজিম পদে বসিয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ফিরলেন।
এদিকে রুস্তম জঙ্গ ফের প্রতিশোধ নিতে নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্য চাইলেন। মারাঠাদের (Marathas) সাহায্যে রুস্তম জঙ্গ পুনরায় ফিরে পেলেন উড়িষ্যার অধিকার ।
ফের আলিবর্দি উড়িষ্যায় এসে রুস্তম জঙ্গকে পরাস্ত করেন। কিন্তু এবার মুর্শিদাবাদ ফেরার আগেই রঘুজী ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র বাহিনী বাংলায় পাঠিয়ে দিলেন। পাঞ্চেত হয়ে মারাঠা বাহিনী বাংলায় প্রবেশ করলো।
ছত্রপতি শিবাজীর আদর্শে তৈরি মারাঠা বর্গি বাহিনী এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিল। বাংলায় আলিবর্দির শাসন উৎখাত করে হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে তাঁরা বাংলায় “চৌথ” কর আদায়ের অনুমতি পেয়েছিল এবং সেই “কর” আদায়ের পাশাপাশি গোটা ভারতবর্ষে এক অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের মূল লক্ষ্যে অভিযান চালাচ্ছিল তারা।
সুবা বাংলার নবাব আলিবর্দিকে রীতিমতো কোণঠাসা করে ফেলেছিল তারা।
মারাঠা আক্রমণের ভীতি আছড়ে পড়লো শহর কলকাতায়। আর শহর কলকাতার বুকে ব্রিটিশ ফোর্ট উইলিয়ামকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছিল বেনিয়া ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাছে।
কলকাতার পশ্চিমে স্বয়ং মা গঙ্গা প্রাকৃতিক প্রহরী, কিন্তু পূর্ব দিক তো ফাঁকা।
মারাঠা আক্রমণ আটকাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তখন একের পর এক পরিকল্পনা করছে আর বিলেতে পাঠাচ্ছে। কিন্তু সাগর পার থেকে কোনো জুতসই ব্যবস্থা হচ্ছে না।
শেষে একদিন বাগবাজার ঘাটে এলো জাহাজ “টাইগ্রিস” এবং সেখান থেকে নামলো সাতটি কামান। শহর কলকাতার সাতটি জায়গায় সেগুলি বসিয়ে দেওয়া হলো।
কিন্তু খুশি হলো না কলকাতাবাসী। শহর কলকাতায় তখন মুচি-কামার-কুমোরের মতো ছা-পোষা সাধারণ মানুষের সঙ্গে শেঠ-বসাকদের মতো ধনপতিরা মারাঠা সম্পর্কে নবাবের পেটোয়া কবির “ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়োলো, বর্গি এলো দেশে”-র মতো ছড়ার প্রচারে আতঙ্কিত।
ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি চাইলো, তাদের ফোর্ট উইলিয়াম বাঁচাতে হবে। অন্যদিকে, কলকাতাবাসী চাইলো, বর্গি হানা থেকে রেহাই পেতে। তাই কলকাতাবাসী ঠিক করলো, তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে। এরজন্য খাল খোঁড়া হবে। বাগবাজার থেকে অনেকটা বৃত্তাকারে পুবে ঘুরে দক্ষিণে যাবে এই খাল। লম্বা হবে ৭ মাইল, চওড়া ধরা হলো ৪২ গজ। হিসেব করে দেখা গেল, খরচ হবে ২৫ হাজার টাকা।
ফোর্ট উইলিয়াম বাঁচানোর স্বার্থে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি (East India Company) এই টাকাটা ধার দিল।
শুরু হলো কলকাতার পূর্বদিকে বৃত্তাকারে খাল কাটার কাজ। ৬ মাসে কাটা হলো ৩ মাইল—বাগবাজার থেকে বেকবাগান। এই খালের নাম হলো ” মারাঠা ডিচ্।” লোকমুখে এলাকার নাম হয়ে গেল, খাল পাড়।
এরপর খবর এলো, আফগান সেনা মুস্তাক খানের সাহায্যে সন্ধির অছিলায় ডেকে এনে ভাস্কর পণ্ডিতকে মেরে ফেলেছেন নবাব আলিবর্দি।
আর বর্গি আক্রমণের ভয় নেই। সুতরাং, বন্ধ হয়ে গেল খাল কাটার কাজ।
এরপর পলাশির যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এদেশের শাসক হয়ে বসলো। ততদিনে সুন্দর ফাঁকা জায়গা পেয়ে বিগত ৪০ বছর ধরে কলকাতাবাসী আবর্জনা ফেলে নরক বানিয়ে ফেলেছে মারাঠা ডিচ্ ।
লর্ড ওয়েলেসলি খাল বুজিয়ে দেবার হুকুম দিলেন। এরপর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে সার্কুলার রোড তৈরির সময় মারাঠা ডিচ্ বুজিয়ে দেওয়া হলো। বর্তমানে আপার সার্কুলার রোডের নাম—আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড এবং লোয়ার সার্কুলার রোডের নাম—আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড।
মারাঠা ডিচের বাকি অংশটা ১৮৯২-৯৩ খ্রিস্টাব্দে হ্যারিসন রোড ( মহাত্মা গান্ধী রোড ) তৈরির সময় মাটি ও জঞ্জাল দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়।
তবে বাগবাজারের একটি ছোট্ট রাস্তার নাম আজও “মারাঠা ডিচ্ লেন।”