ভারতবর্ষের সংবিধানে সংসদ সদস্যদের মূলত তিন ধরনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দায়িত্ব হল তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রের উন্নয়নমূলক কাজকর্মের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ। দ্বিতীয় দায়িত্ব হল, সংসদ সদস্য হিসাবে সংসদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা, বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নেওয়া এবং তার মাধ্যমে প্রশাসনের দুনীতি, ব্যর্থতা ও অপকর্মগুলির সমালোচনা করা। তৃতীয় দায়িত্ব হল, তিনি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে পালামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলের সদস্য হিসেবে কর্তব্য পালন করা। সাধারণভাবে প্রতিটি সংসদ সদস্যেরই উচিত ন্যূনতম এই দায়িত্বগুলি পালন করা এবং প্রয়োজনে তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রের ভোটার ও নাগরিকবৃন্দ এবং সামগ্রিকভাবে গোটা দেশের জনগণের প্রশ্নের জবাব দেওয়া। কারণ প্রতিটি সদস্যই নিবার্চনে প্রার্থী হন বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির পশরা নিয়ে সেই প্রতিশ্রুতিগুলি পালন না করলে জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়াটাও প্রত্যেক সংসদ সদস্যের কর্তব্য।
গত পাঁচ বছর ধরে, যেদিন থেকে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী প্রধানমন্ত্রী পদের মুখ হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিতে পা রেখেছেন। সেদিন থেকেই দেখা গেছে প্রতিবাদে সোচ্চার একজনই, তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪-র প্রাক নির্বাচনী সময় থেকে ২০১৯-এর নির্বাচনী সময় পর্যন্ত সম্ভবত একটি দিনও বাদ যায়নি যেদিন তিনি মোদীজীর বাপান্ত না করে জলস্পর্শ করেছেন। মোদীজী হলেন মমতার জাতশত্রু। যদিও মমতাকে শত্রুর মর্যাদা দিতেও একেবারেই রাজি নন মোদীজী, তা তাঁর গত পাঁচ বছরের আচরণেই স্পষ্ট।
অভিযোগ অঢেল। মোদী দাঙ্গাবাজ। মোদী সাম্প্রদায়িক। মোদী দেশদ্রোহী। মোদী ভারত বিভাজনের চেষ্টায় রত। মোদী দুর্নীতিবাজ। তিনি আদানী-আম্বানীদের পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করেন। মোদী চোর। রাফাল বিমান কেনায় তিনি আর্থিক দুর্নীতি করেছেন। মোদী যুদ্ধবাজ। ভোটের স্বার্থে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জিগির তুলেছেন। মোদী ড্রাকুলা। তাঁর অপদার্থতার জন্যই পুলওয়ামায় ৪০ জন জওয়ানের প্রাণ গেছে। সেনার রক্ত ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। মোদীর গাফিলতিতেই ব্যাঙ্ক প্রতারণা করে বিদেশ পালিয়েছেন বিজয় মালিয়া, নীরব মোদীরা। তিনি জনবিরোধী। তার প্রমাণ নোটবন্দী। তার প্রমাণ জিএসটি চালু করা। মোদীজী মিথ্যাবাদী। কারণ তিনি বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করতে পারেননি। মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মাথাপিছু ১৫ লক্ষ টাকা জমা পড়েনি। মোদী আন্তর্জাতিক অপরাধী। কারণ, পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সত্যতা প্রমাণে মোদী ব্যর্থ এবং মোদীজীর হাঁটাচলা, কথাবার্তা সবকিছুই শোলে সিনেমার ডাকাত-সদার গব্বর সিংয়ের মতো। মানুষ তাঁকে ভয় পায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীজীকে নিত্যনতুন উপমা এবং উপাধিতে ভূষিত করেন এবং গোটা ভারতবর্ষেই একটা বার্তা ছড়িয়ে দেন, মোদী বিরোধিতায় তিনি এককাট্টা এবং একমেবাদ্বিতীয়। কারণটা সহজেই অনুমেয়। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন এবং বিশ্বাস করেন, নরেন্দ্র মোদী অটলবিহারী বাজপেয়ী নন, যিনি মমতাজীর টালির চালের ঘরে পা রেখে তাঁর মা (এখন প্রয়াত)-কে প্রণাম করবেন না। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, হাজার চেষ্টা করেও চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারির অভিযোগ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের এবং দলকে রেহাই দেননি মোদীজী। তাঁর বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারে একজনই— তিনি নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদী।
সে না হয় হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব অভিযোগ না হয় রাজনৈতিক প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে মেনেও নেওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, পার্লামেন্টে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি সদস্যদের ৯০ শতাংশই এই টানা পাঁচ বছর ধরে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন? সৌগত রায়ের মতো দু-একজন সদস্য ছাড়া বাকিরা কোনও প্রসঙ্গেই মোদীজীর বিরুদ্ধে অভিযোগে সোচ্চার হলেন না কেন?
সে প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব। তার আগে সেই উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য কতকগুলি তথ্যের উপর নজর দেওয়া যাক। সংসদ সদস্যদের সংসদের বাইরে কোন ভূমিকায় দেখা গেছে? তা বিচার করবেন জনগণই। কারণ তাঁরা নিজেরাই দেখেছেন, খোলা মঞ্চে ঝিঙ্কু মণিদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের কাউকে কাউকে কোমর দোলাতে। কেউ বা মাসের পর মাস জেলবন্দী থেকেছেন। কেউ বন্দী অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় দিন গুজরান করেছেন। কেউ বা দিবালোকে নারদার অর্থ হস্তগত করেছেন, মানুষ তাও দেখেছেন।
আমাদের বিবেচ্য সংসদের অভ্যন্তরে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদদের ভূমিকা কেমন ছিল ?
সংসদে প্রত্যেক সদস্যের ভূমিকা সংসদ অধিবেশন চলাকালীন প্রতিদিন লিপিবদ্ধ হয়। এই তালিকায় থাকে, সদস্য সংসদ অধিবেশনের কত শতাংশ সময় উপস্থিত ছিলেন। আবশ্যিক দায়িত্ব হিসাবে কটা প্রশ্ন করেছেন। ক’টা বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। সেগুলির বিষয় কি ছিল। বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসাবে তাঁরা কতটা দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সরকারি হিসেবে একটু চোখ বোলানো যাক। ২০১৪-তে যাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের হিসাবটা আগে দেখা যাক। চিত্রতারকা দেব (দীপক অধিকারী) পাঁচ বছরে সংসদে উপস্থিত থেকেছেন মাত্র ১১ শতাংশ অধিবেশনে। মাত্র দুটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। সাকুল্যে তিনটি প্রশ্ন করেছেন তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র বা অন্য বিষয়ে। মুনমুন সেন (শ্রীমতী দেববর্মা) সংসদে হাজির ছিলেন ৬৯ শতাংশ অধিবেশনে। কিন্তু মাত্র একটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। প্রশ্ন? না, একটাও করেননি। বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র তারকা সন্ধ্যা রায়। ৭৭ বছর বয়স। প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তবুও ৫৩ শতাংশ অধিবেশনে হাজির ছিলেন। তিনটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। না, উনিও একটা প্রশ্নও করেননি গত পাঁচ বছরে। রূপালী পর্দার আর এক তুখোড় নায়িকা শতাব্দী রায়। হাজিরা দিয়েছেন ৭৪ শতাংশ অধিবেশনে। চারটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন? হ্যাঁ, মাত্র দুটি। কাঁথির রাজনৈতিক জমিদারী যাঁর হাতে সেই শিশির অধিকারী (যাঁর কৃপায় নন্দীগ্রামে আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল) ৪৬ শতাংশ হাজিরা দিয়েছেন, কিন্তু একটা বিতর্কেও অংশ নেননি। ওই জমিদারের কনিষ্ঠ তনয় দিব্যেন্দু অধিকারী বাবার চেয়ে দুই শতাংশ হাজিরায় এগিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু বিতর্কে অংশগ্রহণ ? নৈব নৈব চ।
আরও আছে। শুনুন, মমতাবালা ঠাকুর, যাঁকে ঘিরে মতুয়া সম্প্রদায়ের কোন্দল তুঙ্গে, তিনি হাজির থেকেছেন ৭৩ শতাংশ অধিবেশনে। কিন্তু প্রশ্ন? না, না। ওসবের ধারও মাড়াননি তিনি। তবে কোনওরকমে দুটি বিতর্কে দু-চার কথা বলেছেন। দশরথ তিরকে হাজির থেকেছেন ৬৭ শতাংশ অধিবেশনে। প্রশ্ন করেননি কখনও। বিজয়চন্দ্র বর্মন হাজিরা দিয়েছেন ৫৩ শতাংশ অধিবেশনে। প্রশ্ন করেননি কখনও। ব্যতিক্রম দু-চারজন। যেমন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৌগত রায়। এঁরাই বেশিরভাগ বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন অনেক। সেরা সৌগত রায়ই। ৯০ শতাংশ হাজিরা। ২২৭টি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। আর প্রশ্ন করেছেন ৫৭৩টি। দেখা যাচ্ছে, মোদীর বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলি নিয়ে একমাত্র তিনিই নাড়াচাড়া করেছেন। চিত্রতারকা তাপস পাল, যিনি সিপিএম ক্যাডারদের বাড়ি বাড়ি তৃণমূল কর্মী ঢুকিয়ে পরিবারের সদস্যাদের ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিলেন তিনিও মোদীর বিরুদ্ধে একটিও প্রশ্ন করেননি। ৪৭ শতাংশ অধিবেশনে হাজির থেকে প্রশ্ন করেছেন মোট সাতটি— সবই অন্য বিষয়ে। বেশিরভাগ তৃণমূল সংসদ সদস্যের একই হাল। রহস্যটা এখানেই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্মকে তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্যরা ব্যবহার করেননি কেন? কার নির্দেশে তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন? শুধুই জনগণের অর্থের অপচয় করেছেন। কেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দুনীতির চেয়ার থেকে হঠাতে সংসদ ভবনকে ব্যবহার করেননি তাঁরা আর কেনই বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় বসে শুধু চীৎকার করে গেছেন মোদীর বিরুদ্ধে ?
সাংসদদের এই হিসাবই প্রমাণ করে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাবাজী শুধুই রাজনৈতিক নাটক। যদি সত্যিই অভিযোগ থাকতো তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশেই দলীয় প্রতিনিধিরা সংসদে বিতর্কে অংশ নিয়ে দলে দলে রেকর্ড রাখার চেষ্টা করতেন। তা তিনি করতে দেননি। তারও একটা কারণ সহজেই অনুমেয়। মোদীর বিরুদ্ধে চিৎকার করে তিনি শুধু মোদীজীর বিরুদ্ধে আক্রমণের রাজনীতি করেছেন। কারণ চিটফাণ্ড কাণ্ডে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে কোনরকমেই রেহাই দিতে রাজি হননি। মমতার হাজার অনুরোধ দূরে ঠেলে দেন নির্দ্বিধায়।
কিন্তু মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বিজেপি বিরোধী নন। কারণ তিনি জানেন হয়তো ২০১৯ সালের নির্বাচনেই বিজেপির হাত ধরতে হবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। জোট রাজনীতির কাছে তো দিল্লি এখনও দূর অস্ত।
যাঁরা ভাবেন, মমতা পাগল, মমতার রাজনৈতিক বুদ্ধি কাঁচা, তাঁরা একটু তলিয়ে দেখবেন। বুঝতে পারবেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি রাজনীতি পরিকল্পিত অঙ্কের ফর্মুলা মেনে। তিনি জানেন, কোন বিষয়ে দল সাংসদ কী ভূমিকা নিলে তা সাধারণ মানুষ কোনওদিনই তলিয়ে দেখেন না। তিনি জানেন, হাজারবার চীৎকার করে একটি জ্বলজ্যান্ত মিথ্যাকে মানুষের মনে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায়।
কিন্তু সমস্যা হল, তিনি এটা জানেন না, চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ সম্পাদন সম্ভব নয়। প্রাথমিক স্তরে সাফল্য মিললেও দূরাগত দিনে তা ধরা পড়বেই। তারপর আর রাজনীতির জগতে তাঁর কোনও কদর থাকবে না।
২০১৯ সালের নির্বাচন হল সেই নির্বাচন যেখানে এই সব চালাকি ধরে ফেলার নির্বাচন। ২০১৯-এর নিবার্চন হল সেইনির্বাচন যেখানে মানুষ জবাবদিহি করবে প্রার্থীদের। উত্তর না পেলে গলাটা নামিয়ে দেবে প্রার্থী তালিকা থেকে। ‘২০১৯ বিজেপি ফিনিশ’ শ্লোগানটি কেবল শ্লোগান হয়েই ঝুলবে কালীঘাটের গলিতে। কারণ শান্তি পেতে গেলে মমতাকে বাঁচতে হবে ওই শ্লোগানটুকুকে আঁকড়েই ২০২১-এ সব ভ্যানিশ হওয়ার আগেই।
2019-03-26