চার দেওয়ালের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে মানুষের কল্যাণে

তখন তার ষোলো বছর বয়েস। লখনৌ গিয়েছিলেন পড়াশোনা করবেন বলে।কয়েকদিন থাকার পর শহরটাকে তার বেশ ভালো লাগল। তখনও তিনি শহরের অলিগলির সঙ্গে পরিচিত নন। যেদিন পরিচয় হলো সেদিন থেকে তার ভালোবাসা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ল। তিনি লক্ষ্য করলেন স্টেশনের আশেপাশে অসংখ্য ভিখিরির বাস। ভিখিরিরা প্রায় সকলেই ড্রাগের নেশা করেন এবং রাতে একটি সুপরিচিত হোটেলের লাগোয়া ফুটপাথে ঘুমোন।
নিদারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ সেই ষোলো বছরের কিশোর। যার নাম শারদ প্যাটেল। কষ্ট অনেক সময় মনের ইচ্ছেগুলো স্পষ্ট করে দেয়। সেদিন শারদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আজকের পরিণত শারদ স্মৃতিরোমন্থন করে বলেন, “আমার মনে হয়েছিল ওদের সাহায্য করার জন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতেই হবে।” এগিয়ে যাওয়ার ভাবনার সেই শুরু। কিন্তু তারও তো একটা প্রস্তুতি চাই।
কলেজর পরীক্ষায় পাশ করার পর শারদ বাড়িতে জানিয়ে দিলেন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সমাজসেবা নিয়ে পড়াশোনা করতে চান। এও জানালেন, ভবিষ্যতে তিনি সমাজসেবাকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করবেন। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ তাদের ছেলেমেয়েকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাবার কথা ভাবেন। সেখানে সমাজসেবা? নৈব নৈব চ! ভাগ্য ভালো শারদের দাদা ভাইয়ের পাশে ছিলেন। তারই অনুপ্রেরণায় শারদ ফিরে গেলেন লখনৌতে। সেখানে কয়েকদিনের মধ্যে ঘটা একটা ঘটনা তার সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে তোলে। একদিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার পথে এক ভিখিরির সঙ্গে দেখা। অশক্ত মানুষটি শারদের কছে টাকা চাইলেন। টাকা না দিয়ে শারদ সেদিন তকে পেটভরে খাইয়েছিলেন।
কিন্তু কতজনকে তিনি খাওয়াতে পারেন? কতদিনই বা পারেন? শীঘ্রই শারদ বুঝলেন এভবে হবে না। কোনও একটি বিশেষ বিষয়ে ওই মানুষগুলোকে দক্ষ করে তোলা দরকার। তবেই কর্মসংস্থান সম্ভব। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে লখনৌ শহরে একটি আর্থ সামাজিক সমীক্ষা করলেন শরদ। জানা গেল, শহরে মোট ৩,৫০০ ভিখিরির বাস। ওদের মধ্যে কেউ কেউ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিত। মাধ্যমিক পাশও দু-একজন আছেন। কিন্তু যার ওপর ভিত্তি করে অর্থ রোজগার করা সম্ভব, সেরকম কোনও বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা এদের কারোরই নেই।
তা হলে? না, হতাশ হননি শারদ। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর তিনি ‘ভিক্ষাবৃত্তি মুক্তি অভিমান’ শুরু করেন। উদ্দেশ্য, ভিখিরিদের সমস্যা যতটা সম্ভব দূর করা এবং তদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। শহরের যেসব অঞ্চলে ভিখিরির সংখ্যা বেশি, কাজের শুরুতে সেইসব জায়গা বেছে নিয়েছিলেন শারদ। আধুনিক নাগরিক সভ্যতায় পরিত্যক্ত মানুষগুলোর বিশ্বাস অর্জন করা খুব সহজ কাজ ছিল না। তদের সমাজের কেউ নন, এমন একজনকে প্রথম দিকে প্রত্যাখ্যানই করেছিলেন ভিক্ষুকেরা। দমে যাননি শারদ। কিছুদিন মেলামেশার পর বুঝতে পেরেছিলেন দু’বেলা খাবার জোটানোই মানুষগুলোর প্রধান সমস্যা। রেশন কার্ড করানোর ওপর গুরুত্ব দিলেন শারদ। কিন্তু রেশন কার্ড হয় কী করে? কারোও কাছেই তো ঠিকনার কোনও প্রমাণপত্র নেই। কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ব্যবস্থা করলেন শারদ। রেশন কার্ড মিলল। চাল ডাল আটার একটা সমাধান হলো। শারদও অর্জন করলেন সেই দুর্লভবস্তু বিশ্বাস!
কথায় বলে, অন্নচিন্তা চমৎকারা! সেই চিন্তার সুরাহা হলে মাথা তোলে বাসস্থানের প্রশ্ন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় খোলা ফুটপাথে পড়ে থাকা মানুষগুলের কাছে মাথার ওপর ছাদ সম্ভবত দিবাস্বপ্ন। কিন্তু সেই দিবাস্বপ্নও পূরণ হলো শারদের সৌজন্যে।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় চারশে জন বাড়ি পেলেন। রাস্তায় জন্মানো বাচ্চাদের কোনও স্কুল ছিল না। শারদ তারও ব্যবস্থা করেছেন। শারদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শতাধিক বাচ্চা এখন সুর করে পড়া মুখস্থ করে। ২০১৫ সালে শারদ তৈরি করেছেন তার এনজিও। নাম, বদলাও। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, বদল।
বাইশজন ভিখিরি এখনও পর্যন্ত ভিক্ষে করা ছেড়েছেন। তাদেরই একজন বিজয় বাহাদুর ভোলা। এখন রিকশা চালান। এমন একটা আনকোরা নতুন জীবন পেয়ে তিনি খুশি। রিকশার গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, “ছেলেবেলায় আমি এই শহরে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ভিক্ষে করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। শারদভাই এই রিকশা কিনে দিয়ে আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।”
তবে শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকা নয়। বদলাওয়ের প্রত্যেক কর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং বদলে যাওয়া প্রত্যেক ভিক্ষুককের কাছে শারদ অন্য এক বার্তাও পৌঁছে দেন। মানুষের অজ্ঞতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে প্রকৃতির নাভিশ্বাস ওঠার বার্তা। কিছুদিন আগে লখনৌ শহর দেখেছে প্রায় নর্দমায় পরিণত হওয়া গোমতীর বুক থেকে কীভাবে শারদের সেনাবহিনী বর্জ পদার্থ তুলে নদীকে তার স্বাভাবিক রূপ ফিরিয়ে দিয়েছে।
গোমতী ভারতীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ নদী। সেই নদীকে জঞ্জালমুক্ত করে শারদ শুধু পরিবেশ বান্ধবের ভূমিকা পালন করেননি, পরম্পরাকেও রক্ষা করেছেন। এরপর আর যাইহোক, ইতিহাসের শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহে অন্তত কোনও ছেদ পড়বে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.