বিরিয়ানির গন্ধ নাকে এসে লাগলে আর রক্ষে নেই! কেউ কেউ একাদশী ভঙ্গ করে দৌড়ে এসে হেঁশেলে ঢুকে পড়েন। বিরিয়ানি কথাটি এখানে রূপক। আসল কথাটি হলো জল যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে দেখে রাহুল গান্ধী মওকা বুঝে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন।
উনিশের লোকসভা নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদে সোনিয়া গান্ধী ফিরে এসেছিলেন। রাহুল গান্ধী চলে গিয়েছিলেন অন্তরালে। বলা যেতে পারে, দল তার মতো পরাজিত সেনাপতিকে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গান্ধীপরিবারের উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতার মোহ থেকে বা দিল্লির তখতে বসার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা থেকে কতদিনই বা দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব! তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন গৃহীত হবার পর দেশের কয়েকটি জায়গায় এই আইনের বিরোধিতার নামে নাটক শুরু হওয়া মাত্র তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর প্রতি কংগ্রেসের নীচুতলার কর্মীদের রোষ উপেক্ষা করে ফিরে এসেই তিনি টুইটারের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে তিনটি প্রশ্ন করেছেন। বলা বাহুল্য, রাহুলের প্রশ্নগুলি গত বছর পুলওয়ামায় জঙ্গি-আক্রমণে নিহত সিআরপিএফের ৪০ জন জওয়ানকে নিয়ে। এ বছর সারা দেশের মানুষ যথার্থ শ্রদ্ধায় এবং সম্মানে পুলওয়ামা কাণ্ডের বর্ষপূর্তি পালন করেছেন। স্মরণ ও মননের মাধ্যমে বীর জওয়ানদের প্রতি অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আবালবৃদ্ধবণিতা। মোদী সরকারের কাছে তিনি জানতে চেয়েছেন, (১) পুলওয়ামার ঘটনায় কে সব থেকে বেশি ফয়দা লুটেছে? (২) পুলওয়ামা কাণ্ডের যে তদন্ত এন আই এ করছে তা থেকে কী জানা গেছে? (৩) পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ড ভারতীয় গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার চরম উদাহরণ। এর জন্য মোদী সরকারের কোন কোন মন্ত্রী দায়ী?
টুইটটি ভালো করে পড়লে বোঝা যায় রাহুলের লক্ষ্য এক এবং একমাত্র নরেন্দ্র মোদী। লোকসভা নির্বাচনের বহু আগে থাকতেই তিনি নরেন্দ্র মোদীকে চাঁদমারি বানিয়ে একের পর এক গোলাগুলি নিক্ষেপ করে আসছেন। রাফাল-ডিলে নরেন্দ্র মোদী দুর্নীতি করেছেন, এই অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীকে চোর বলতেও ছাড়েননি। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে দেশের চৌকিদার বললে রাহুল চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলে তাকে কটাক্ষ করেছেন। মানুষের ভোটে নির্বাচিত দেশের প্রশাসনিক প্রধানকে কোনও প্রমাণ ছাড়াই চোর বলার সমুচিত প্রতিফল তিনি পেয়েছেন কিন্তু শিক্ষা নেননি। এবারও তার লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদী। এবারও তার উদ্দেশ্য প্রধামন্ত্রীকে অপমান করা।
রাহুল গান্ধীর লক্ষ্য যে নরেন্দ্র মোদী সেটি তার প্রশ্নগুলি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। প্রথম প্রশ্নে তিনি জানতে চেয়েছেন, পুলওয়ামা কাণ্ডে সব থেকে বেশি কে উপকৃত হয়েছেন? পুলওয়ামায় জঙ্গির হামলা করেছিল ঊনিশের ফেব্রুয়ারিতে। আর ওই বছরেরই মে মাসে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ রাহুল গান্ধী এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে পুলওয়ামা কাণ্ডে সব থেকে বেশি উপকৃত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু শুধু এইটুকু বোঝানোই কি রাহুলের উদ্দেশ্য ছিল? অবশ্যই না। বিশেষ করে পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তান-যোগ প্রসঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে বিবৃতি দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে রাহুলের উদ্দেশ্য ছিল আর ও সুদূরপ্রসারী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের প্রাক্কালে ইমরান পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তান-যোগ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এই হামলা সম্পূর্ণতই কাশ্মীরের মাটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে পুলওয়ামা হামলার দাবিদার জইশ-ই-মহম্মদ মূলত পাকিস্তান কেন্দ্রিক সংগঠন হলেও তারা কাশ্মীরেও যথেষ্ট সক্রিয়। হামলার প্রধান পাণ্ডা আদিল আহমেদ দার নিজেও কাশ্মীরের লোক। ইমরান দাবি করেছিলেন, ভারতীয় সেনার অত্যাচারের ফলেই নাকি দার সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। সব মিলিয়ে ইমরানের বক্তব্য ছিল, পুলওয়ামা হামলার ছক কষা হয়েছিল ভারতের মাটিতে এবং তার পিছনে ছিল কোনো বড়ো মাথা। রাহুল গান্ধীর প্রথম প্রশ্নের আড়ালেও রয়ে গেছে সেই বড়ো মাথার প্রসঙ্গটি। ভোটে জিতে যদি নরেন্দ্র মোদী সব থেকে উপকৃত হন তাহলে তিনিই সেই বড়ো মাথা যিনি ভোটে জেতার জন্য চল্লিশ জন জওয়ানকে খুন করিয়েছিলেন। এই ধরনের একজন মানুষকে পাপ্প-টাঙ্গু বলে যারা আত্মপ্রসন্ন হতে চান, হোন কিন্তু একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, রাহুল গান্ধী মোটেই পাঞ্জু নন। তিনি এবং তাঁর দলটি ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান লবির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। সেই ভারতবিরোধী রাজনীতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাহুলের এবং কংগ্রেসের রাজনীতিতে।
দ্বিতীয় প্রশ্নে রাহুল জানতে চেয়েছেন। পুলওয়ামা কাণ্ডের তদন্তের কী হলো? প্রশ্নটি বিভ্রন্তিমূলক। কারণ যে তদন্ত এখনও শেষ হয়নি তার ফলাফল কীভাবে জানানো যেতে পারে। এটা বোধহয় লোকসভা নির্বাচনোত্তর দীর্ঘ একাদশী পালনের সাইড এফেক্ট। যাই হোক, তৃতীয় প্রশ্নে রাহুল জানতে চেয়েছেন, পুলওয়ামা কাণ্ডের জন্য দায়ী যে গোয়েন্দা ব্যর্থতা তার জন্য বিজেপির কোন কোন মন্ত্রী দায়ী? এই প্রশ্নটি করেছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমও। তার অভিমত, পুলওয়ামায় নিহত জওয়ানদের জন্য কোনও স্মারক নির্মাণের প্রয়োজন নেই। কারণ এই স্মারক নাকি গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাই তুলে ধরে।
মহম্মদ সেলিম কোনো নতুন কথা বলছেন না। মনে রাখতে হবে, পুলওয়ামা কাণ্ডের অব্যবহিত পর থেকেই বামপন্থী শিবির থেকে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাটি ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে এ বিষয়ে স্পষ্টবার্তা দেওয়া হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা চালাচালি বন্ধ হয়নি। এর উদ্দেশ্য আর কিছুই নয় পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তানের ওপর বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক চাপ কমাতে সাহায্য করা। এবং অবশ্যই ভারতীয় মুসলমানদের এই বার্তা দেওয়া যে এ দেশের বামপন্থীরা পাকিস্তানের পাশে আছে। কিন্তু এসব করে কোনও লাভ হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান চীন ও কয়েকটি ইসলামিক দেশ ছাড়া কাউকে পাশে পায়নি। আমেরিকা স্পষ্টতই পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দিয়ে বলেছে, গত পনেরো বছর ধরে পাকিস্তান ক্রমাগত তাদের মিথ্যে কথা বলে এসেছে। পুলওয়ামা কাণ্ডে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মুখ পোড়ার পিছনে দায়ী মূলত দুটি ঘটনা, (১) ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ, এবং (২) শরিফের ভাগ্নীর বিয়েতে নরেন্দ্র মোদীর নিমন্ত্রণ রক্ষা। এই দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে মোদী সারা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন যে ভারত পাকিস্তানের শত্র নয়। ফলে পাঠানকোট এবং পুলওয়ামা হামলার পর সারা বিশ্বে পাকিস্তান-বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে নরেন্দ্র মোদীকে বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা সম্ভব, দেশীয় ক্ষেত্রে তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? আর সম্ভব হলেই বা শুনছে কে! বিশেষ করে শাহিনবাগে যেখানে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলন বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে এবং প্রতিবাদ-চত্বরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বোরখা-পরা মুসলমান মহিলারা। সুতরাং এটাই পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তানকে ক্লিনচিট দেবার উপযুক্ত সময়। এর ফলে তিন তালাক বিরোধী আইন পাশ করার জন্য মুসলমান মহিলামহলে মোদীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে এবং দিল্লির নির্বাচনে যার লাভ ঘরে তুলবে কংগ্রেস। নির্বাচনে কী ফল হয়েছে সবাই জানেন। ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে কংগ্রেস।
প্রশ্ন হলো, এই লজ্জাজনক হার থেকে কি রাহুল এবং তার দল শিক্ষা নেবেন? না, নেবেন না। নিলে ভারতের স্বাধীনোত্তর ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাভাবনা এবং মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া কংগ্রেসের চরিত্র। নয়। সুতরাং রাহুল তার প্রপিতামহের মতোই ভারতে ইসলামিক সন্ত্রাসের শিকড়টিকে সযত্নে আড়াল করবেন। পাকিস্তানকে বারবার ক্লিনচিট দেবেন। এবং এইসব করে তিনি তার বাবা, পিতামহী এবং প্রপিতামহের মতো জিইয়ে রাখবেন সমস্যাটিকে। যাতে খুড়োর কল সামনে রেখে ভোটের রাজনীতি করা যায়। এই কাজে তাদের দোসর বামপন্থীরা। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী শিবিরের মধ্যে রাজযোটক মিল। দু’পক্ষই সুযোগ পেলে হিন্দুর গোরু চুরি করে। তারপর সন্ধ্যেবেলায় সেজেগুজে হাজির হয় মুসলমানের দেওয়া দাওয়াতে।
সন্দীপ চক্রবর্তী
2020-03-04